৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮
বৈচিত্র্যপূর্ণ দার্জিলিং জেলার বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী পার্টি সংগঠনকে সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী করতে হবে
সিপিআই(এম) দার্জিলিং জেলা সম্মেলনের আহ্বান
সন্দীপ দে
সিপিআই(এম) দার্জিলিং জেলা সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন সূর্য মিশ্র।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জনবিন্যাসের বৈচিত্র্য, প্রশাসনিক বিভিন্নতা থাকা পাহাড়, সমতল, গ্রাম, শহর, চা বাগিচা, বনাঞ্চল সমন্বিত দার্জিলিং জেলায় পার্টি সংগঠনকে বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি শ্রেণি ঐক্যকে মজবুত করে শ্রেণি আন্দোলনকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে জনগণের জীবন জীবিকার আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে - এই আহ্বান জানিয়ে শেষ হয়েছে সিপিআই(এম) দার্জিলিং জেলা ২৩তম সম্মেলন। ১১ ও ১২ ডিসেম্বর কমরেড অনিল সাহা নগরে (শিলিগুড়ি) কমরেড রাধা ছেত্রী মঞ্চে (মিত্র সম্মিলনী হল) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সম্মেলন মঞ্চ থেকে আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে ডাক দেওয়া হয়েছে - জয়ের লক্ষ্য নিয়েই শিলিগুড়ি পুরসভা ও শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে নির্বাচনী সংগঠনকে মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে। সম্মেলন আহ্বান রেখেছে, অবিলম্বে এই দুই সংস্থার নির্বাচন সহ পাহাড়ে জিটিএ এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন করার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে।
সম্মেলনের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ মহিলা নেত্রী আরতি হোড়রায়। পতাকা উত্তোলন ও শহিদ বেদিতে মাল্যদানের পর পার্টি দপ্তর সংলগ্ন স্থান থেকে মিছিল করে প্রতিনিধিরা উপস্থিত হন সম্মেলন স্থল মিত্র সম্মিলনী হলে।
নতুন নেতৃত্ব
পার্টির দার্জিলিং জেলা ২৩তম সম্মেলন থেকে ৪০ জনের জেলা কমিটি সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হয়েছে। জেলা কমিটির প্রথম বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে জেলা কমিটির নবনির্বাচিত সম্পাদক হয়েছেন সমন পাঠক। জেলা কমিটিতে এবারে নতুন নির্বাচিত হয়েছেন ১৩ জন, এছাড়া মহিলা রয়েছেন ৫ জন। জেলা কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে থাকছেন অশোক ভট্টাচার্য এবং পরিমল ভৌমিক।
সম্মেলনের মঞ্চ থেকে পার্টির আসন্ন রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে ৮ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। বিকল্প প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৭ জন।
সম্মেলন উদ্বোধন
বর্তমান সময়ে দেশের গণতন্ত্র, সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার গুরুত্ব অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দায়িত্ব কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদেরই নিতে হবে। নির্বাচনে আমাদের ভোট কমেছে। কিন্তু সর্বত্র আমাদের পার্টি রয়েছে। আমাদের সংগঠন ও মতাদর্শকে নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, বিকল্পের কথা তুলে ধরতে হবে। পার্টির কলকাতা প্লেনামে গণ লাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়া সহ যে পাঁচ দফা কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল তা কার্যকর করতে আমাদের উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। সিপিআই(এম) দার্জিলিং জেলা ২৩তম সম্মেলন উদ্বোধন করে এই আহ্বান জানান পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে।
তিনি বলেন, দেশে হিন্দুত্বের রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা চলছে। এই লক্ষ্যেই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রামমন্দির থেকে সেন্ট্রাল ভিস্তা নির্মাণ চলছে। অথচ দেশের মানুষ অনাহার-অপুষ্টিতে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। কেন্দ্রের শাসকদল যেভাবে ভীতি প্রদর্শন করে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নির্বাচনে জয়ী হতে চাইছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ত্রিপুরার ঘটনায় আমরা তা লক্ষ করেছি। আজ রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় আরএসএস-র লোক বসানো হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা, সমাজকর্মী, পেগাসাসের মাধ্যমে সবার ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। দেশজুড়ে আজ ফ্যাসিস্ট দৌরাত্ম্য ও হিংস্রতা বাড়ছে। আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হচ্ছে। বাবরি মসজিদ নিয়ে রায় তার নিদর্শন। উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি, কর্পোরেট শক্তি দেশ চালাচ্ছে। আমরা যখন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা, রাজ্যগুলির অধিকারের কথা বলছি তখন সিবিআই, ইডি, এনএসএ-কে কাজে লাগাচ্ছে মোদি সরকার। সংসদ আজ বিজেপি’র স্বৈরাচারী, সংবিধান বিরোধী কাজের বৈধতা দেবার জায়গা হয়ে উঠেছে। এসবের ফলে দেশে এক ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই অত্যন্ত জরুরি।
কোভিড মোকাবিলায় কেন্দ্রের সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা, অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয়, এর বিপরীতে কোভিড সংক্রমণ প্রতিহত করতে কেরালা সরকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সময়ে আমাদের পার্টি, বিভিন্ন গণসংগঠন বিশেষ করে রেড ভলান্টিয়াররা আক্রান্ত, বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্তস্থাপন করেছেন। এই সময়ে আমরা বলেছিলাম গরিব অসহায় মানুষের হাতে ৭,৫০০ টাকা করে তুলে দিতে। সেদিকে কর্ণপাত করেনি মোদি সরকার। উলটে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল, তাদের বাধা দিচ্ছে। কেবল আরএসএস পরিচালিত সংগঠনগুলোকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এই সময়ে একদিকে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে, দেশের সম্পদ বেঁচে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি সাংঙ্ঘাতিকভাবে বেড়েছে। তবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলনও তীব্র হয়ে উঠছে। এর ফলে সিএএ, এনপিআর চালু করতে পারেনি কেন্দ্র। এরাজ্যেও গণতন্ত্রের ওপর মারাত্মক আঘাত নেমে এসেছে। স্বাধীন সংস্থাগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। আজ তৃণমূলও বিজেপি’র সুরে কথা বলছে। তলে তলে এরাও বিরোধী ঐক্য ভাঙার খেলায় মেতেছে। আসলে বিজেপি’র সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রেখেই চলতে চাইছে। এসবের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পথেই আমরা অগ্রসর হতে পারব।
অশোক ভট্টাচার্য, কে বি ওয়াতার, দিলীপ সিং, ঝরেন রায়, প্রতাপ কুজুর, স্নিগ্ধা হাজরা, বাবলু রবিদাস, গৌতম রাজ রাইকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করেন।
সম্মেলনে শহিদ স্মরণে ও শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করেন অশোক ভট্টাচার্য।
খসড়া প্রতিবেদন উত্থাপন
সম্মেলনে সম্পাদকীয় খসড়া প্রতিবেদন উত্থাপন করে বিদায়ী জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার বলেন, এই সময়ে আমাদের পার্টির সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভারতের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে কবজা করতে কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদল যে চেষ্টা চালাচ্ছে - তা রুখে দেওয়া। দেশে হিন্দুত্ববাদী শক্তির পাশাপাশি কর্পোরেট সংস্থাগুলি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এমনই একটা অবস্থায় মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন ও সংগ্রামকে হাতিয়ার করে আমাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের পার্টি, গণসংগঠন ও রেড ভলান্টিয়াররা দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছে। আবার এই সময়েই কেন্দ্রের তিন কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের সাফল্য ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির সর্বভারতীয় ধর্মঘট উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নির্বাচনে আমাদের পরাজয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারমধ্যেও আমরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন ও মহকুমা পরিষদে জয়লাভ করে পরিচালনা করতে সচেষ্ট থেকেছি। এই সংস্থাগুলির উপর নানাভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। মেয়র আক্রান্ত হয়েছেন। তবুও মানুষের স্বার্থে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
তিনি পাহাড়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, লড়াই আন্দোলনের ক্ষেত্রে দার্জিলিং পাহাড়ের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পাহাড়ের মর্যাদা রক্ষায়, সর্বোচ্চ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আমরা সরব থেকেছি। নেপালি ভাষাকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলে অন্তর্ভুক্তির জন্য আমরাই লড়াই করেছি। পাহাড় ও গোর্খা জাতির বিকাশের জন্য আমরাই লড়েছি। কিন্তু তৃণমূল-বিজেপি নির্বাচনের স্বার্থে গোর্খাল্যান্ডের ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করছে। ওরা পাহাড়ের মানুষকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নামে বিভাজিত করেছে। জিটিএ দখল করে ভ্রষ্টাচার, দুর্নীতি, অরাজকতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
জীবেশ সরকার আরও বলেছেন, আমাদের পার্টি বিপ্লবী পার্টি। সক্রিয়দের সংগঠন। তাই পার্টি কর্মীদের মতাদর্শগত নেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করতে হবে। তরুণদের বেশি বেশি করে নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক কম্পাস হচ্ছে মতাদর্শ। কাজেই পার্টির মুখপত্রকে বাদ দিয়ে মতাদর্শের প্রচার সম্ভব নয়। তাই পার্টিকে মজবুত করতে, পার্টির মর্যাদা রক্ষায় মতাদর্শগত ভিতকে বৃদ্ধি করতে হবে। পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত চর্চা বাড়াতে হবে। শোষণহীন সমাজ গড়ার চেতনাকে প্রসারিত করতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি হচ্ছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। তা জেলা থেকে শাখা সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পার্টি প্লেনামের আহ্বান অনুযায়ী গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে তিনি উল্লেখ করেন, আমরা অবিলম্বে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন ও মহকুমা পরিষদের নির্বাচন চাই। সেই লক্ষ্যে পাহাড়ে জিটিএ এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনেরও দাবি করছি। এই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচনী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, আমরা শিলিগুড়ি কর্পোরেশন ও মহকুমা পরিষদে জয়ের লক্ষ্য নিয়েই লড়াই করব।
প্রতিনিধিদের আলোচনা
পার্টির দার্জিলিং জেলা ২৩তম সম্মেলনে সম্পাদকীয় খসড়া প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় প্রতিনিধিরা পার্টি সংগঠনকে মজবুত করা, পার্টি কর্মীদের মতাদর্শগতভাবে চেতনা দীপ্ত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একই সঙ্গে প্রতিনিধিরা উপলব্ধি করেছেন, পার্টির রাজনীতি ও মতাদর্শ নিয়ে মানুষের কাছে বারে বারে যেতে হবে, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেই তাঁদের দাবি দাওয়ার আন্দোলন করার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর গণআন্দোলনে সাধারণ মানুষকে শামিল করতে হবে।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় শিলিগুড়ি সহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে করোনা মোকাবিলায় এবং বিপন্ন মানুষদের সাহায্যে ছাত্র-যুবকর্মীদের নিয়ে গড়ে ওঠা রেড ভলান্টিয়ারদের অনন্য ভূমিকার কথা গুরুত্বের সাথেই উঠে আসে। তাঁরা বলেছেন, নির্বাচনে বিপর্যয় সত্ত্বেও করোনা রোগীদের বাড়িতে অক্সিজেন, ওষুধপত্র, খাবার পৌঁছে দেওয়া, করোনার অভিঘাতে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো, করোনা আক্রান্তের মৃতদেহ দাহ অথবা কবর স্থানে নিয়ে যাবার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করে গেছে রেড ভলান্টিয়াররা। খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি, বাগডোগরা, শুশ্রুতনগর, আঠারো খাই, এনজেপি, ডাবগ্রাম, শিলিগুড়ি সহ পার্বত্য অঞ্চলেরও কিছু কিছু জায়গায় রেড ভলান্টিয়ারদের উদ্যোগ অব্যাহত থেকেছে। তাদের উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী প্রদান, বিনামূল্যে বাজার, কমিউনিটি কিচেন পরিচালিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, রেড ভলান্টিয়ারদের কাজে যে সমস্ত ছাত্র-যুব অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেককেই পরবর্তীতে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে, আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো সম্ভব হয়েছে।
পাহাড়ের প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পাহাড়বাসী যে অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছিল। তা এখন নস্যাৎ হতে বসেছে। বামপন্থীরাই পাহাড়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধান স্বীকৃত স্বশাসিত পরিষদের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। আনন্দ পাঠক এই মর্মে সংসদে বারে বারে দাবি উত্থাপন করেছিলেন।
নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ পাহাড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল পার্টি ও বামপন্থীরা। পরবর্তী সময়ে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি যখন সামনে চলে আসে তখন রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য লড়াই করায় আক্রান্ত হয়েছে সিপিআই(এম)। তাদের গোর্খাল্যান্ড বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় দলই তাদের কপট রাজনৈতিক স্বার্থে বিভেদকামী শক্তিকে মদত দিয়েছে। পাহাড়ের মানুষ এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন এরা পাহাড়ের জন্য কিছুই করবে না। পাহাড়ের প্রতিনিধিরা বলেছেন, চা শ্রমিকরা এখন নানাভাবে বঞ্চনার শিকার। মাত্র ২০২ টাকা মজুরিতে তাদের পরিবার নিয়ে দিনযাপন করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রেশন অপ্রতুল। মিলছে না পাট্টার জমি। এই অবস্থায় পাহাড়ের সমস্ত অংশের মানুষের স্বার্থে লড়াই আন্দোলনই একমাত্র পথ। সেজন্য জরুরি সংগঠনকে শক্তিশালী করা। তাঁরা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং জিটিএ নির্বাচন হচ্ছে না। দুর্নীতি, বেনিয়ম মাত্রাছাড়াভাবে বাড়ছে। তাই অবিলম্বে পাহাড়ে পঞ্চায়েত এবং জিটিএ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেছেন প্রতিনিধিরা। পাহাড় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবিও তাঁরা সোচ্চারে উত্থাপন করেছেন।
সম্মেলনে প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেছেন, এই আন্দোলন আসলে সামাজিক অধিকারের আন্দোলন- যা শক্তিশালী করবে শ্রেণি আন্দোলনকে। তবে সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে - এই আন্দোলন করতে গিয়ে যেন পরিচিতি সত্তার রাজনীতি যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে। তাঁরা আরও বলেছেন, আদিবাসী জনজাতিদের উপর নানাভাবে আক্রমণ নেমে আসছে। তাই তাদের স্বার্থে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি ন্যায়ের আন্দোলনের সাথে অধিকারের আন্দোলনকেও মেলাতে হবে। এছাড়া সম্মেলনে তৃণমূলের জমানায় বস্তিবাসীদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ, বিভিন্ন জায়গায় জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য, নানা স্থানে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের উপদ্রবের কথাও উঠে এসেছে প্রতিনিধিদের আলোচনায়।
সম্মেলনে সূর্য মিশ্রের অভিনন্দন
দার্জিলিঙের মতো জেলায় জনজাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা, আলাদা জাতিসত্তা রয়েছে। পাহাড় তরাই ডুয়ার্সে বসবাস করেন নানা ধরনের ভাষাভাষির মানুষ। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে পার্টিকে খুবই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়েছে একথা বলা যাবে না। এখানে নানারকমভাবে বিভেদ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়া জুড়ে একে ব্যবহার করছে। ওদের লক্ষ্যই হচ্ছে ভাগ করে লুঠ করো। তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকেই রাজ্যের আদিবাসী, তফশিলি মানুষ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলা যাবে না। এদের সংগঠিত করার পাশাপাশি নিজেদের শক্তিকে বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, তৃতীয় বারের জন্য বিজেপি দেশের শাসন ক্ষমতার এলে এই সরকার ফ্যাসিস্ট না আধা ফ্যাসিস্ট তা ভাবার অবকাশ থাকবে না। দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসেই ওরা এনআরসি-সিএএ চালু করতে চেষ্টা করেছিল। আবারও ওরা ক্ষমতায় এলে ভয়ংকর বিপদ তৈরি হবে। তাই এখন আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত দিল্লি থেকে বিজেপি-কে হঠানো। কিন্ত এখানে তৃণমূলকে ক্ষমতায় রেখে বিজেপি-কে হঠানো যাবে না। এই তৃণমূলই এরাজ্যে বিজেপি-কে ডেকে এনেছিল। ওরাই হচ্ছে বিজেপি-র স্বাভাবিক মিত্র।
সূর্য মিশ্র তাঁর ভাষণে পার্টির কলকাতা প্লেনামে সংগঠন সম্পর্কিত ৫টি বিশেষ দিক্নির্দেশের পর্যালোচনা করে বলেন, পার্টিতে তরুণদের নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁরাই কলে কারখানায় যাবে, কৃষক খেত মজুরদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে। আমাদের পার্টির সামনে যে সমস্ত বাধা প্রতিবন্ধকতার পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
তিনি গরিব সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তীব্র শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গ্রাম পঞ্চায়েত সহ অন্যান্য স্তরে দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি দিল্লির কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, সংগ্রামের ময়দান থেকেই সংগ্রামী কর্মী গড়ে উঠবে।
পরিশেষে তিনি বলেন, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে পার্টি সংগঠনকে গড়ে তুলে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন ও মহকুমা পরিষদের নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর ৪৭ জন প্রতিনিধি আলোচনা করেছেন।
প্রতিনিধিদের আলোচনার পর জবাবি ভাষণে বিদায়ী জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার বলেন, শাখা থেকে জেলা কমিটি স্তর সর্বত্র সজীবতা আনতে হবে। আমাদের আন্দোলন সংগ্রামকে ছড়িয়ে দিতে হবে জেলার সর্বত্র। নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, গোর্খা জাতির বিকাশের লড়াই এসবই ছিল আমাদের নীতির লড়াই। অনেক গৌরবজনক ঐতিহ্যবহনকারী আমাদের পার্টি। এর ভিতের উপর দাঁড়িয়ে পাহাড় সমতল সর্বত্র সংগঠনকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়া চা শ্রমিকদের মজুরি ও বাস্তুজমির দাবিতে আন্দোলনকেও শক্তিশালী করতে হবে আমাদের। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আদায়যোগ্য দাবিগুলি নিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ধারাবাহিকভাবে লড়াই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আমাদের। পরিশেষে তিনি বলেন, গণ লাইন ও গণফ্রন্ট নিয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে, লাল ঝান্ডা নিয়ে সংগ্রামের পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
সিপিআই(এম) দার্জিলিং জেলা ২৩তম সম্মেলন থেকে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন, শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ সহ পাহাড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করার দাবিতে, গোর্খা স্বশাসিত পরিষদ গঠনের দাবিতে, চা শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও বসবাসের জমির পাট্টার দাবিতে, ২৩-২৪ ফ্রেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করা, রাজ্য সরকারের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী অগণতান্ত্রিক কাজের বিরুদ্ধে, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা, রেলসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলো বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, কর্মসংস্থানের দাবিতে, নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবিতে, বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমগুলোর লুঠতরাজের বিরুদ্ধে, আঠারোখাই-মাটিগাড়া অঞ্চলে পৌরসভা গড়ে তোলা, কৃষকদের জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য সলিল আচার্য ও জিয়াউল আলম।
বিদায়ী সম্পাদকের জবাবি ভাষণের পর প্রতিবেদন সহ বিভিন্ন প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গ্রহণ করা হয়। সম্মেলনের সমাপ্তি লগ্নে নবনির্বাচিত সম্পাদক সমন পাঠক বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি যৌথ নেতৃত্বে চলে। আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এবং সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ ঐকমত্যের ভিত্তিতে রূপায়ণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষে সমাপ্তি ভাষণ দেন অশোক ভট্টাচার্য।