৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮
সিপিআই(এম) ওডিশা রাজ্য ২২তম সম্মেলন
প্রকাশ্য সমাবেশে বলছেন সীতারাম ইয়েচুরি। মঞ্চে সূর্য মিশ্র সহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ইস্পাত শহর রৌরকেল্লায় ৩০ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো সিপিআই(এম) ওডিশা রাজ্য ২২তম সম্মেলন। সম্মেলন থেকে পার্টিকে আরও শক্তিশালী করতে রাজ্যের বিভিন্ন জ্বলন্ত ইস্যুতে প্রতিদিন মানুষের সঙ্গে গণসংগঠনগুলির যোগাযোগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও প্রসারিত করার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। এই সম্মেলনে মোট ১৫৮ জন প্রতিনিধি এবং ৪৬ জন পর্যবেক্ষক যোগ দিয়েছেন।
৩০ নভেম্বর সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে ওডিশার খনি এলাকা বোনাইয়ের লিলি মোহন গোপ মঞ্চে। আদিবাসী লোকসংগীত, নৃত্য এবং ব্যাপক অংশের মানুষের বর্ণাঢ্য মিছিলের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় প্রকাশ্য সমাবেশ।
রাজ্য সম্মেলনের রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র। এরপর শহিদ স্তম্ভে ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রারম্ভিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
প্রকাশ্য সমাবেশ পরিচালনা করেন বোনাইয়ের বিধায়ক এবং অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান সিপিআই(এম) নেতা লক্ষ্মণ মুন্ডা। সমাবেশে সীতারাম ইয়েচুরি জন রিডের লেখা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ বইটির ওডিয়া অনুবাদ প্রকাশ করেন।
প্রকাশ্য সমাবেশে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, দিল্লিতে কৃষকদের আন্দোলনের বিজয় থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং ফ্যাসিস্ট আরএসএস’র কর্পোরেটমুখী, সাম্প্রদায়িক এবং হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচিবাহী রাজনৈতিক শাখা বিজেপি’কে পরাস্ত করতে হবে।
সমাবেশে সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, বিজেডি সরকারকে রাজ্যে বিজেপি’র সঙ্গে ছদ্ম লড়াইয়ের ইন্ধন জোগানো বন্ধ করে কেন্দ্রের মোদি সরকারের বিভিন্ন জনস্বার্থবিরোধী নীতির প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে হবে।
এর পাশাপাশি প্রকাশ্য সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রাজ্য সম্পাদক অলিকিশোর পট্টনায়েক, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জনার্দন পতি প্রমুখ।
সম্মেলন স্থল রৌরকেল্লা অডিটোরিয়ামের নামকরণ করা হয় বনমালী ধুপাল নগর এবং মঞ্চের নামকরণ করা হয় মার্শা সামাদের নামে। প্রতিনিধি সম্মেলন পর্ব শুরু হয় ৩০ নভেম্বর বিকেলে। প্রতিনিধি পর্বের উদ্বোধনে সীতারাম ইয়েচুরি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি এবং জাতীয় ক্ষেত্রে পার্টির আগামী কাজ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। অতিমারী পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে শোষণসর্বস্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার থেকে উন্নততর তা আরেকবার প্রমাণ হলো। যেখানে সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন এবং কিউবা কোভিডের দুর্বিষহ প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারল, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি মানুষের জীবন রক্ষা করতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়। নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বৈষম্য, দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং বেকারি বাড়িয়েছে। এই সমস্ত জনবিরোধী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে আমাদের দেশসহ গোটা পৃথিবীতে লড়াই আন্দোলন চলেছে। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি চেষ্টা করছে এই আন্দোলনকে বিভাজিত করতে এবং উপড়ে ফেলতে। কর্পোরেটমুখী এবং জনবিরোধী নীতি সমূহ নিয়ে চলা মোদি সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করে তিনি আগত প্রতিনিধিদের বলেন, এই মুহূর্তে আবেগ তাড়িত না হয়ে আমাদের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে এবং তার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক শিক্ষা গ্রহণের ভিত্তিতেই আগামী দিনের কাজ নির্ধারণ করতে হবে।
সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত ওডিশার দুই প্রবীণ কমরেড - প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নারায়ণ মল্লিক এবং রাজ্য কমিটির সদস্য রবি পট্টনায়েককে সম্মেলন মঞ্চে সংবর্ধিত করেন সীতারাম ইয়েচুরি।
এরপর রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া রিপোর্ট পেশ করে রাজ্য সম্পাদক ওলি কিশোর পট্টনায়েক বলেন, কোভিড পরিস্থিতির জন্য সম্মেলন এক বছর পিছিয়ে দিতে হয়েছে। এই রিপোর্টে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, গত চার বছরে রাজ্যে উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে পার্টির বিশ্লেষণ যে সঠিক ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে। যদিও বিজেডি ওডিশার মূল রাজনৈতিক শক্তি, কিন্তু বিজেডি এখন মোদি সরকারের অঘোষিত শরিক এবং সমর্থক হিসেবে উঠে এসেছে। মোদি সরকারের জনবিরোধী কর্পোরেটমুখী নীতিসমূহের এবং প্রজাতন্ত্র বিরোধী নীতি নিয়ে চলার দরুন রাজ্যে লোক দেখানো লড়াই করছে বিজেডি এবং বিজেপি। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এবং কংগ্রেসের শক্তি ক্ষয়ের ফলে বিজেপি রাজ্যে এখন তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে কংগ্রেসকে অনেক দূরে তৃতীয় স্থানে রেখে।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে মালকানগিরি কালাহান্ডি এবং রায়গড় বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায় পার্টির কাজ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। মানুষের মধ্যে পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি করতে এবং আমাদের শক্তিকে সংহত করার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা সংক্রান্ত ইস্যুগুলিকে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৌঁছতে হবে লক্ষ্যে। বিজেপি’র হিন্দুত্বের বিভিন্ন অপপ্রচার সহ অশুভ এবং অর্ধসত্য প্রচারের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য কমরেডদের এবং বিভিন্ন পার্টি ইউনিটকে মতাদর্শগতভাবে আরও সমৃদ্ধ হওয়ার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন ইউনিট এবং ফ্রন্টের মোট ৫৯ জন প্রতিনিধি এই রিপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা করেছেন প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে।
এদিন সম্মেলন স্থলে আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন কমরেড বসন্ত নন্দার। প্রবীণ কমরেড বসন্ত নন্দার আকস্মিক প্রয়াণে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন সম্মেলনে উপস্থিত সকলেই। এই পরিস্থিতিতে জবাবি ভাষণ অলি কিশোর পট্টনায়েক শুরু করার পর তা সম্পূর্ণ করেন জনার্দন পতি।
সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে খসড়া প্রস্তাব সহ উত্থাপিত ১৪টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সম্মেলন থেকে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন অলিকিশোর পট্টনায়েক। পার্টি কংগ্রেসের জন্য ৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলনের সমাপ্তি ভাষণে সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, পরের পর বিপর্যয় ঘটলেও আমরা মার্কসবাদী হিসেবে কখনই হতাশ হয়ে পিছিয়ে পড়ব না। আমরা মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন এবং সংগ্রাম এই চারটি বিষয়কে নজরে রেখে এগিয়ে যাব। তিনি প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, মজবুত পার্টি গড়তে হলে পার্টিতে আরও বেশি করে তরুণ কমরেডদের নিয়ে আসতে হবে। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণফ্রন্টগুলিকে বিস্তৃত করতে হবে, প্রসারিত করতে হবে পার্টির গণভিত্তিকে।