৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮
জনসাধারণই হলো ইতিহাসের প্রকৃত স্রষ্টা
আবু বকর
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম দেশ ও দুনিয়ার মানুষ প্রত্যক্ষ করলেন ভারতের বৃহত্তম কৃষক আন্দোলন।‘সংযুক্ত কৃষক মোর্চা’র নেতৃত্বে দেশের কৃষক সমাজ ৭১৫ জন কৃষকের শহিদিবরণের বিনিময়ে জয় ছিনিয়ে নিলেন। দীর্ঘ ৩৭৮ দিনের জেদি ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ফলে তারা এই ঐতিহাসিক জয় লাভ করেছেন। এই দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে। কোনো জাতি, ধর্ম ও বর্ণ এখানে স্থান পায়নি। প্রায় ৫০০টি কৃষক সংগঠন এই মহতী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সেখানে সঙ্ঘের কৃষক সংগঠন থাকার কোনো প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের কৃষক সংগঠনও এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি। অবশ্য তৃণমূলের চরিত্রগত কারণে অংশ না নেওয়ারই কথা।
এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর। ওই দিন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। তিন কৃষি আইন বাতিল করা ও বিদ্যুৎ বিল যাতে পেশ করা না হয় তার প্রতিবাদে ছিল এই কৃষক আন্দোলন। এই ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে গিয়ে সংযুক্ত কৃষক মোর্চাকে নানা অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে - যেমন কখনো দেশদ্রোহী, কখনো জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ, আবার কখনো পাকিস্তানের এজেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ সবটাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সেইসাথে সমবেত কৃষক সমাজ এটাই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে - ‘‘What does parliament street can undo’’ অর্থাৎ সংসদ যে আইনই করুক না কেন রাস্তা তা বাতিল করতে পারে।
এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয়নি, স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। মোর্চাও ভেঙে যায়নি। আগামীদিনে প্রয়োজনে আরও বৃহত্তর আন্দোলন হতে পারে। ক্ষতিকর তিন কৃষি আইন ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চার দাবিমতো অবশিষ্ট দাবিগুলো সরকারিভাবে চিঠি দিয়ে মেনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই অনৈতিক আইনগুলির মাধ্যমে কৃষকদের পাঁজর ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে।
১৮৪৫ সালে মার্কস ও এঙ্গেলস যৌথভাবে রচনা করেছিলেন, “The Holy Family, or a Critique of Critical Criticism against Bruno Bauer and Co.” এই ‘পবিত্র পরিবার’ গ্ৰন্থটি ছিল সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দর্শনের ইতিহাসের সর্বপ্রথম একটি বস্তুবাদী বিশ্লেষণ।
কার্ল মার্কসের জীবনীকার ইয়েভগেনিয়া স্তেপানভা এই ‘পবিত্র পরিবার’ সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেনঃ “ব্রুনো বাউয়ের অ্যান্ড কোং মনে করতেন যে, কেবল ‘বাছা বাছা ব্যক্তিমানুষ’ ইতিহাস সৃষ্টি করে। তাঁদের আত্মমুখী ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে মার্কস ও এঙ্গেলস উত্থাপন করলেন ঐতিহাসিক বস্তবাদের অন্যতম মূল নিয়ম - পৃথক পৃথক ‘নায়ক’ নয় ব্যাপক জনসাধারণই হলো ইতিহাসের প্রকৃত স্রষ্টা। তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে উত্তরোত্তর ব্যাপক জনসাধারণ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সচেতন ও সক্রিয় কর্মী হতে থাকবে। এই ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যের উপর জোর দিয়ে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ‘গভীরতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলির একটি’ বলে লেনিন তার চরিত্র নিরুপণ করেছেন।’ (পৃষ্ঠাঃ ৩৬-৩৭)
মার্কস ও এঙ্গেলসের বহু পূর্বে অর্থাৎ ১৮৪৫ সালের বক্তব্য কত সঠিক ছিল তা ভারতের কৃষক সমাজ আবার প্রমাণ করে দেখালেন।
সংযুক্ত কৃষক মোর্চার এই দীর্ঘদিনের আন্দোলনে শ্রমিক, ছাত্র-যুব,মহিলা সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের যেমন সহমর্মিতা ছিল ঠিক তেমনি বিভিন্নভাবে তাঁরা সহযোগিতা করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই অবস্থানরত কৃষকদের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে। এই সার্বিক ঐক্য বজায় রেখে আগামী দিনে আন্দোলন-সংগ্ৰাম পরিচালিত হলে কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকারকে দিল্লির গদি থেকে হটানো সহজ হবে। সেই সাথে সহজ হবে রাজ্যে স্বৈরাচারী তৃণমূল সরকারকে গদিচ্যুত করতে।