৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯
বারাসত ২ নং ব্লকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সন্ত্রাস উপেক্ষা করে ভয়ভাঙা মানুষের দুর্জয় প্রতিরোধ
সমাবেশে শপথ আরও বড়ো লড়াইয়ের
প্রতিরোধের সমাবেশে বলছেন সুজন চক্রবর্তী। মঞ্চে উপস্থিত মৃণাল চক্রবর্তী, পলাশ দাশ, আহমেদ আলি প্রমুখ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তৃণমূলের সন্ত্রাসে আহত রক্তাক্ত হয়ও দৃপ্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেন মানুষ এবং প্রতিবাদী মানুষের যূথবদ্ধ প্রচেষ্টায় আক্রমণকারী তৃণমূলীদের হটিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো নির্ধারিত সমাবেশ। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লড়াইয়ের এই অনন্য নজির দেখা গেল সন্ত্রাস-কবলিত বারাসত ২ নং ব্লকের কলুপাড়ায়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এম) এবং আইএসএফ’র উদ্যোগে এই নজির সৃষ্টিকারী সমাবেশ হয়েছে। বর্তমানে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের আকাশছোঁয়া দুর্নীতি-অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে লাল ঝান্ডার মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে, সেই আবহে বারাসত ২ নং ব্লকের কলুপাড়ায় সাধারণ মানুষের অকুতোভয় পদক্ষেপ এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সভা নিঃসন্দেহে একটি নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। শাসকদল তৃণমূলের হিংস্র সন্ত্রাসকে প্রতিহত করা গ্রামীণ মানুষের এই লড়াকু মনোভাবকে অভিবাদন জানিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ।
১০ ফেব্রুয়ারি বারাসত ২ নং ব্লকের কলুপাড়ায় সংলগ্ন কেমিয়া খামারপাড়া এবং রোহান্ডা-চণ্ডীগড় অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল। সমাবেশের ডাক দিয়েছিল সিপিআই(এম) এবং আইএসএফ যৌথভাবে। নানা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি ও নানা অপকীর্তিতে জেরবার তৃণমূল কংগ্রেস তাতে আতঙ্কিত হয়ে সমাবেশ বানচাল করতে নৃশংসভাবে হামলা চালায়। শাসকদলের অঞ্চল সভাপতি এবং বারাসত ২ নং ব্লকের এক নেতার নেতৃত্বে প্রায় ৪০ জন দুষ্কৃতী বন্দুক ও কোদালের বাট, বাঁশ, রড, ধারালো অস্ত্র নিয়ে সমাবেশে আসা মানুষদের উপর আক্রমণ চালায়। এতে আহত ও রক্তাক্ত হন বেশ কয়েকজন সিপিআই(এম) কর্মী। তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা সমাবেশে আসা মানুষদের উপর হিংস্র আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি সমাবেশ মঞ্চ ভাঙে ও পতাকা ছিঁড়ে দেয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুলিশের সামনেই শাসকদলের দুষ্কৃতীরা এই হিংস্র সন্ত্রাস চালিয়েছে। এই হামলাকারীদের মধ্যে কিছুদিন আগে ছিনতাইয়ে অভিযুক্ত দুষ্কৃতীরাও ছিল। কিন্তু পুলিশ হামলাকারীদের রুখে দেবার কোনো উদ্যোগই নেয়নি, এমনকী আহত-রক্তাক্ত সিপিআই(এম) কর্মীরা রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তৃণমূলীরা পুলিশের সামনেই মঞ্চ ও মাইক ভেঙে, সমাবেশে যোগদানকারীদের ওপর হিংস্র আক্রমণ ও তাঁদের মোটর সাইকেল ভেঙে দীর্ঘক্ষণ ধরে তাণ্ডব চালালেও পুলিশকে নীরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া কোনো সদর্থক ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। আহতদের মধ্যে অনেককে মধ্যমগ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে ভরতি করতে হয়। একজনকে বারাসত জেলা হাসপাতালেও স্থানান্তরিত করা হয়।
দীর্ঘদিন সন্ত্রাসের আবর্তে থাকা এই অঞ্চলের মানুষ তৃণমূলের এই উন্মত্ততা-হিংস্রতায় আক্রান্ত হয়েও দমে যাননি। তাঁরা প্রতিরোধের মেজাজকে আরও তীব্র করে দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করেছেন। এবং প্রবল জেদ ও প্রতিরোধে মনোভাবকে আরও শানিত করে ফের মঞ্চ বেঁধে সংগঠিত করেছেন সমাবেশ।
আগে থেকে নির্ধারিত না থাকলেও এই হামলার খবর পেয়ে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পলাশ দাশ, পার্টির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আহমেদ আলি সমাবেশস্থলে আসেন এবং পুলিশের মদতে এই নৃশংস হামলার প্রতিবাদ জানান।
এদিন এই হামলার ঘটনা ছড়িয়ে পড়তেই বারাসত ২ নং ব্লকের অন্তর্গত ৭টি পঞ্চায়েত অঞ্চল থেকেই চলে আসেন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ। তৃণমূলের হামলায় জখম-রক্তাক্ত পার্টিকর্মীরা মঞ্চে উঠে দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রতিবাদ জারি রাখার ঘোষণা করেন।
তৃণমূলের হামলাকে প্রতিহত করে অনুষ্ঠিত হওয়া সিপিআই(এম) এবং আইএসএফ-র যৌথ সভায় সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, সমাবেশ বানচাল করতে যারা বন্দুক, কোদালের বাট ইত্যাদি নিয়ে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না। সব অত্যাচার-লুঠের হিসেব নেওয়া হবে।
আক্রমণকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, পুলিশের পাহারায় না থাকলে তৃণমূলের কোনো সাহসই নেই। দিনে দিনে মানুষের ভয় ভাঙছে, তাই আতঙ্কে রয়েছে তৃণমূল।
সমাবেশে পলাশ দাশ বলেন, বখরা যায় বলে পুলিশের একাংশের অফিসারের নির্দেশে পুলিশবাহিনী তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের পাহারা দিচ্ছে। অত্যাচারী-লুঠেরাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। পুলিশ আজ যার হয়ে অত্যাচার করছে কাল সে জেলে যাবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বারাসত ২ নং ব্লকের সব পঞ্চায়েতে লাল ঝান্ডার মিছিল হবে।
পার্টি নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য এদিনের ঘটনার নিন্দা করে বলেন, প্রতিবাদী মানুষের সমাবেশ দেখে এখন ভয়ে পা কাঁপছে বলেই পুলিশের মদতে হামলা করতে হচ্ছে তৃণমূলকে।
আইএসএফ নেতা কুতুবউদ্দিন ফতেহি আইএসএফ’র প্রতিষ্ঠা দিবসের সমাবেশে পুলিশের নৃশংস আক্রমণ ও বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকিকে জেলে আটকে রাখার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, মানুষকে একজোট করেছে দেখেই একমাত্র বিরোধী বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকিকে ভয় পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। চোর, লুঠেরাদের দলে নাম লেখাননি তিনি, এটাই তাঁর অপরাধ। জনগণের পঞ্চায়েত গড়তে আমাদের লড়াই কেউ ঠেকাতে পারবে না। এছাড়াও এই প্রতিবাদী সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টি নেত্রী আত্রেয়ী গুহ। সভাপতিত্ব করেন আহমেদ আলি।
এখন তৃণমূল এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে, কোথাও আবার তৃণমূল দলে নাম লেখানোর জন্য চাপ তৈরি করছে। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে সেদিন সমাবেশে আসার জন্য যাদের উপর হামলা চালিয়েছিল তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। এসব সত্ত্বেও এলাকার মানুষ অটুট মনোবল নিয়ে জোট বাঁধছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন আরও বড়ো লড়াইয়ের।
বারাসত ২ নং ব্লক শাসন এলাকা বলে পরিচিত। এখানে ৭টি পঞ্চায়েত। ২০১১ সালের পর থেকেই এই গোটা অঞ্চল জুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। সিপিআই(এম) সহ বিরোধী দলের কোনো কর্মসূচিই এখানে করা সম্ভব ছিল না। কেবল শাসকদলই নয়, পুলিশও বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে লাল ঝান্ডার কর্মসূচি সংগঠিত করতে বাধা দিয়েছে। এই আবহেই গত ১৩ জানুয়ারি খড়িবাড়িতে ‘গ্রাম জাগাও-চোর তাড়াও’ ও গণতন্ত্র কায়েম করা এবং অঞ্চল সন্ত্রাসমুক্ত করার স্লোগান দিয়ে বিরাট মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এই মিছিলে অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
অথচ এই মিছিল নিয়েও প্রশাসন নানা টালবাহানা করে। ৬ জানুয়ারি মিছিল ও সমাবেশের দিন স্থির হলেও পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন নানা অজুহাত দেখিয়ে এমনকী গঙ্গাসাগর মেলার অছিলাকে সামনে এনে সেই কর্মসূচি বানচাল করে দেয়। এসব কারণে মানুষের মনে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষোভ ক্রমশ দানা বাঁধছিল। এই ক্ষোভেরই দৃপ্ত প্রকাশ ঘটেছে ১০ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদী সমাবেশে।
আসলে এই অঞ্চল বর্তমানে হয়ে উঠেছে শাসকদলের অবাধ লুঠের মৃগয়া ক্ষেত্র। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই অঞ্চলে সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের ফলাফল খারাপ হয়। তখন থেকেই তৃণমূলের দৌরাত্ম্য শুরু হয় এখানে। নিউটাউন লাগোয়া এই গোটা অঞ্চলের হাজার হাজার বিঘে জমি ও ভেরি অঞ্চলকে ঘিরে কোটি কোটি টাকার লুঠের কারবার চলছে তৃণমূলের। পুলিশের মদতেই চলছে এই অবৈধ লুঠের বিশাল কারবার। অনেক ক্ষেত্রে এই কারবারে পুলিশ সরাসরি যুক্ত। এই অঞ্চলে লাল ঝান্ডা শক্তিশালী হলে তৃণমূল ও পুলিশের এই বিশাল টাকার অবৈধ কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এরা অবাধে এই লুঠের কারবার চালানোর জন্যই সিপিআই(এম)’র কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে, পার্টিকর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে।
গোটা রাজ্যে এখন যেভাবে দুর্নীতি-নৈরাজ্য আর সন্ত্রাসকারী তৃণমূল ও তার সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে গর্জে উঠছেন, তারই জেরে বারাসত ২ নং ব্লকেও সন্ত্রাসের আগল ভেঙে মানুষ জোট বাঁধছেন এবং তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গর্জে উঠছেন। ১০ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদী সমাবেশ তারই নজির রেখেছে - যা আগামী দিনে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পেরিয়ে রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও নিঃসন্দেহে আরও বৃহত্তর নজির গড়বে। রাজ্যজুড়ে লাল ঝান্ডার দৃপ্ত মিছিল-সমাবেশ তারই জানান দিচ্ছে।