E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯

বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে শুরু সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সম্মেলন

শংকর মুখার্জি


সম্মেলনের উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন সভাপতি এ বিজয়রাঘবন।

শ্রমিক-কৃষকের সর্বব্যাপী ঐক্যই পারে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে আরও বেশি সংখ্যক জনগণকে শামিল করতে। সেই শ্রমিক-কৃষক ঐক্যকে আরও জোরদার করার ডাক দিয়ে শুরু হলো সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন।

গ্রামীণ সর্বহারাদের শ্রেণি সংগঠন হলো সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন। এই সংগঠনের প্রধান দায়িত্ব হলো ভূমিহীনদের জমি ও খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথেই শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গ্রামীণ ভারতের সমস্ত শ্রমজীবীকে এই শ্রেণি সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছে সম্মেলন। এই সমগ্র বিষয়টি মূর্ত হয়েছে সম্মেলনের স্লোগানেওঃ ‘‘জনগণের কাছে যাও, শ্রেণি ঐক্য গড়ে তোলো এবং বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করো।’’ হাওড়ার শরৎ সদনে কমরেড জ্যোতি বসু নগরে ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে এই সম্মেলন। সম্মেলন চলবে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রকাশ্য সমাবেশ হবে ১৭ ফেব্রুয়ারি। প্রকাশ্য সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।

১৯৮২ সালে সারা ভারত কৃষক সভার মেদিনীপুর সম্মেলনে প্রতিষ্ঠা হয় সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন। সেটাই প্রথম সম্মেলন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই সংগঠন গড়ে উঠেছে মাত্র কয়েক বছর আগে। অর্থাৎ রাজ্যে সংগঠন গড়ে ওঠার পর এটাই প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে ২০টি রাজ্য থেকে ৬৭১ জন প্রতিনিধি উপস্থিত আছেন। যদিও সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে ১৬টি রাজ্যে। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে কমরেড সারঙ্গধর পাশোয়ান মঞ্চে। সম্মেলন কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে কমরেড কুমার শিরালকার হল।

সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সভাপতি এ বিজয়রাঘবন। সাধারণ সম্পাদক কে ভেঙ্কট পেশ করেন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে তিনটি আশু কাজ নির্ধারিত হয়েছে। ৫ এপ্রিল কৃষান মজদুর সংঘর্ষ র্যা লিকে সফল করা; ১৪ মার্চ দলিত ইস্যু নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে প্রতিবাদ এবং যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস পালন। আগামী ৫ এপ্রিলের সমাবেশকে সফল করতে সর্বাত্মক সাংগঠনিক উদ্যোগ নেওয়ার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এই সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবও সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষক সভা এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন যৌথভাবে এই সমাবেশের ডাক দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, সারা ভারত কৃষক সভা, সিআইটিইউ, এসএফআই, ডিওয়াইএফআই’র সঙ্গে যৌথভাবে পালন করা হবে।

সার ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের নবম সম্মেলন হয়েছিল ২০২০ সালের ১-৩ জানুয়ারি কেরালার কান্নুরে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরবর্তী তিন বছরে ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে সদস্য সংখ্যা হয়েছে ৭৫ লক্ষ ৫৬ হাজার। কান্নুর সম্মেলনের সময়ে ১৬টি রাজ্যের ২০৫টি জেলায় ইউনিয়নের কাজকর্ম হতো। বর্তমানে ২০টি রাজ্যে ২৬৭ টি জেলায় ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাজ প্রসারিত হয়েছে।

সম্মেলনের শুরুতে ইউনিয়নের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সভাপতি এ বিজয়রাঘবন। ইউনিয়ন ও গণ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণআন্দোলনের বরিষ্ঠ নেতা বিমান বসু উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন মঞ্চে শোকপ্রস্তাব ও শহিদ স্মরণে প্রস্তাব পাঠ করা হয়। সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি শ্রীদীপ ভট্টাচার্য।

সভাপতির ভাষণ

করপোরেট-হিন্দুত্ববাদী আঁতাতের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ঐক্যের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা গণসংগ্রামই কেন্দ্রের জনবিরোধী শাসনকে বাতিল করতে পারে। খেতমজুর ইউনিয়ন এই সংগ্রামে খেতমজুর এবং গ্রামীণ ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সভাপতির ভাষণে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এ বিজয়রাঘবন। প্রসঙ্গত, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সম্মেলন উদ্বোধন হয় সংগঠনের সভাপতির ভাষণ দিয়ে।

বিজয়রাঘবন বলেন, দেশের ঐক্য-সংহতি এবং সংবিধানের সামনে সবচেয়ে বড়ো বিপদ আরএসএস-বিজেপি। দ্বিতীয় মোদি সরকার সরকারি প্রশাসন, গৃহীত নীতি, শিক্ষাব্যবস্থা সবকিছুর মধ্যদিয়ে ঘৃণার রাজনীতিকে ছড়াচ্ছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষকে বিভক্ত করে দাও, যাতে তারা কোনো বাধা ছাড়াই পুঁজিবাদীদের অনুকূলে নীতি গ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেন, খেতমজুরদের ৫০ শতাংশের বেশি হচ্ছে দলিত সম্প্রদায়ের। হিন্দুত্ববাদী শক্তি রাজনৈতিক লাভের জন্য জাতপাতের রাজনীতি, পরিচিতিসত্তার রাজনীতিকে ব্যবহার করে। আবার অন্যদিকে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে দলিতদের ওপর আক্রমণ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না।

বর্তমান সময়ে দেশের কৃষি পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন বিজয়রাঘবন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা কৃষি সংকট ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষিকাজ ছাড়তে বাধ্য করছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই খেতমজুরদের সংখ্যা বাড়ছে দেশে। কিন্তু কমে যাচ্ছে তাদের বছরে কাজের দিন, প্রকৃত মজুরি। এর ফলস্বরূপ গ্রামীণ গরিব খেতমজুরদের মধ্যে বাড়ছে কর্মহীনতা, অভিবাসন। অর্থনৈতিক সংকটের জন্য শিল্প বিকাশের হারও মন্থর। তাই এই জনগণের জন্য শহর বা গ্রাম কোথাও বিকল্প কাজের ব্যবস্থা হচ্ছে না। নয়া উদারনীতির সামগ্রিক পরিণতিতে ভূমিহীনতা, গৃহহীনতা বাড়ছে খেতমজুরদের। এই সমগ্র পরিস্থিতি খেতমজুরদের জীবনযাপনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। তিনি বলেন, এখনই দরকার খেতমজুরদের সম্মানজনক কাজ, মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য একটি সুসংহত কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়নের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা।

জমি, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন গতি পেয়েছে

সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত সময়ে খেতমজুর ইউনিয়নের নেতৃত্বে জমি আন্দোলনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। তেলেঙ্গানায় ১৫৬টি জায়গায় জমি আন্দোলন হয়েছে। সবমিলিয়ে এইসব স্থানে ৮২,১৬৮ একর সরকারি জমি দখল করেছেন খেতমজুররা। এই রাজ্যে জেলাভিত্তিতে জমি কনভেনশন হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে জমি কমিটি। বর্তমানে এই রাজ্যের ১৭টা জেলায় জঙ্গলে জমির দাবিতে জঙ্গি আন্দোলন চলছে। কেন্দ্র ও রাজ্য কোনো সরকারই ভূমিহীন মানুষদের জঙ্গলের জমির পাট্টা দিতে রাজি নয়। তারা চায়, এই জমি থেকে মানুষকে উৎখাত করতে। এই জমি আন্দোলনকারীদের লাঠিচার্জ, গুলি, মামলা সহ সমস্ত রকমের পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত ৩১৪ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

অন্ধ্রপ্রদেশে রাজ্য সরকার উন্নয়নের নামে হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জগমোহন রেড্ডির নিজের জেলা কাডাপায় ৪০টা স্থানে জমি আন্দোলন চলছে। ইলুরু জেলায় ১১০০ একর জমি দখল করা হয়েছে, সেখানে খেতমজুর ইউনিয়নের পতাকা পুঁতে চাষ হচ্ছে। চাষের মরশুমে সরকারি অফিসাররা এসেছিল সে জমিতে চাষ বন্ধ করতে। কিন্তু খেতমজুর ইউনিয়নের প্রতিরোধে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। রাজ্যের উপজাতি বসতি এলাকায় কিছু সামন্ত প্রভু জমি দখল করে রেখেছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে খেতমজুর ইউনিয়ন। সামন্ত প্রভুদের গুন্ডারা সরকারি অফিসারদের মদতে ইউনিয়নের রাজ্যনেতা মুথি লামার ওপর আক্রমণও চালায়। কিন্তু এসব করেও তারা আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারেনি। সবমিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার একর জমি দখল এবং বিলি করা হয়েছে এখানে। এই আন্দোলনের সময়েও ১২১২ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ কেশ রুজু হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই জমি আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে খেতমজুর ইউনিয়নের প্রভাব বাড়ছে, বাড়ছে সংগঠনে কর্মী সংখ্যাও।

বিহারে ক্ষুদ্র পরিসরেও হলেও এই সময়ে জমির আন্দোলন হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মধুবনীতে জেলা প্রশাসন ১০২টি পরিবারকে উৎখাত করে। টানা ৯০ দিন আন্দোলন চলে। শেষে প্রশাসন সমস্ত দাবি মেনে নেয়, উৎখাত হওয়া পরিবারগুলি তাদের বাসস্থানের জন্য জমি পায়। একইভাবে বেগুসরাইতে ৫৮টি পরিবার এবং গয়া জেলায় ১০০টি পরিবার খেতমজুর ইউনিয়নের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে জমি পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহারাষ্ট্রের নান্দুরবার,পারভানি, জালনা জেলাতেও জমি আন্দোলন চলছে।

তেলেঙ্গানায় জমির আন্দোলনের পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনেও সফলতা এসেছে। প্রতিবেদন জানাচ্ছে, তেলেঙ্গানার ১১টি জেলার ২৯০টি কেন্দ্রে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এখন আন্দোলন চলছে। বিগত সময়ে এই দাবিতে ২৭৬টি গ্রামে সফল ধর্মঘটও করেছেন খেতমজুররা। বহু গ্রামে এই আন্দোলনের ফলে খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২২ সালের এপ্রিল মাসে রাজস্থানের পিলিবাঙ্গায় খেতমজুররা দীর্ঘ আন্দোলন এবং ধর্মঘট করেন। এখানে টানা ৫ বছর খেতমজুরদের কোনো মজুরি বাড়েনি। খেতমজুর ইউনিয়নের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন মজুরি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। এই সময়েই মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সফল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্টে।

ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অভিনন্দন

সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় নেত্রী কনীনিকা ঘোষ, ডিওয়াইএফআই'র সাধারণ সম্পাদক হিমগ্নরাজ ভট্টাচার্য, এসএফআই’র সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস।