E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯

কমরেড নরনারায়ণ গুপ্তুর জীবনাবসান


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিশিষ্ট আইনবিদ ও রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল কমরেড নরনারায়ণ গুপ্তু প্রয়াত হয়েছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি, সোমবার সকালে বিধাননগরে তাঁর নিজের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বেশ কিছু দিন তিনি বয়সজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন।

বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী কমরেড নরনারায়ণ গুপ্তু আমৃত্যু সিপিআই(এম)’র সদস্য ছিলেন। এদিন বিকেলে তাঁর মরদেহ সিপিআই(এম)’র রাজ্য দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রয়াত কমরেডের মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, পার্টি নেতা রবীন দেব, সুখেন্দু পানিগ্রাহী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। প্রয়াত কমরেড গুপ্তুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকজ্ঞাপন করেছেন সাংসদ আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।

কমরেড গুপ্তুর বিদ্যালয়জীবন কেটেছে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর প্রখর বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বামপন্থী মতাদর্শে আকৃষ্ট হন এবং আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর ১৯৫০-এর দশকে তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। এরপরই তিনি বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতায় ফেরেন। ১৯৬১ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। কমরেড গুপ্তু গরিব মানুষের স্বার্থে আইন পেশাকে কাজে লাগানো শুরু করেন। আইন পেশার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। বিলেতে থাকাকালীন সেখানকার বহু অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন। এর সঙ্গেই তিনি লেখক হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখা ‘আদালতের ঘরে বাইরেঃ এক আইনজীবীর ফিরে দেখা’ বইটি এখনও পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়। তাঁর লেখা ‘সিলেকটেড ট্রিবিউটস টু লিগ্যাল লুমিনিয়ারিস অ্যান্ড দ্য গভর্নর অব ওয়েস্টবেঙ্গল’ বইটিও জনপ্রিয়। এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন জ্যোতি বসু। সেই মুখবন্ধে বসু নরনারায়ণ গুপ্তুকে শুধু ‘আইন বিশেষজ্ঞ’ বলে বর্ণনা করেই তিনি থেমে থাকেননি। বসু লিখেছেন, নরনারায়ণ গুপ্তু শুধু আইনজ্ঞ নন, তরুণ বয়স থেকেই গোটা দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাঁর অবদান রয়েছে। ‘রিফ্লেক্সশন অন ল অ্যান্ড সোসাইটি’ নামে একটি গ্রন্থে প্রয়াত গুপ্তু সামাজিক অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন ১৯৮৭ সালে তিনি অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রয়াত আইনজ্ঞ স্নেহাংশুকান্ত আচার্যের সাহচর্যে কলকাতা হাইকোর্টে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সওয়াল করেছেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। আইনজীবী অরুণপ্রকাশ চ্যাটার্জি ও সাধন গুপ্ত ছিলেন তাঁর অতি কাছের মানুষ। বিনা বিচারে আটক আইনের বিরোধিতা করে তিনি নিজেই কর্মচারীদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ‘শম্ভু সরকার’ মামলা এখনও বিখ্যাত হয়ে আছে। সেই মামলায় বিনা বিচারে আটক আইনকে আদালতে অসাংবিধানিক হিসাবে প্রমাণ করে শীর্ষ আদালতের রায় আদায় করেছিলেন।

কমরেড গুপ্তু আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করে সাধারণ মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন। তিনি হাইকোর্ট কর্মচারী সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। অন্যদিকে, তিনি অল ইন্ডিয়া ল’ইয়ার্স ইউনিয়নের (এআইএলইউ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। কমরেড গুপ্তুর মৃত্যুতে এক শোকবার্তায় এআইএলইউ’র সভাপতি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ও সম্পাদক পিভি সুরেন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি একজন সফল আইনজীবী ছিলেন। কমরেড গুপ্তুর মৃত্যুতে গরিব মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষতি হলো। এইআইএলইউ’র রাজ্য সভাপতি ও প্রাক্তন আইন মন্ত্রী রবিলাল মৈত্র এবং সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অরিন্দম ভট্টাচার্য কমরেড গুপ্তুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।

১৩ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত গুপ্তুর মরদেহ কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে বিচারপতি এবং আইনজীবীরা তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। বিচারপতি অরিজিৎ ব্যানার্জি কলকাতা হাইকোর্টের পক্ষ থেকে তাঁর মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বিচারপতি লপিতা ব্যানার্জি, বিচারপতি শুভ্রা ঘোষও প্রয়াত গুপ্তুর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এআইএলইউ’র পক্ষ থেকে রবিলাল মৈত্র, শামিম আহমেদ, সুজিত মিত্র প্রয়াত গুপ্তর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এরপর প্রয়াত গুপ্তুর মরদেহ বার কাউন্সিল অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আইনজীবীরা প্রয়াত কমরেডের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। প্রয়াত কমরেডের পুত্র আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁর দুই কন্যা অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এদিনই কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। শেষকৃত্যের সময় শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন রবীন দেব সহ পার্টি নেতাকর্মী ও আইনজীবীরা।