৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯
বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত জনগণের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেই ফিরিয়ে আনতে হবে
সূর্য মিশ্র
লড়াইটা মূলত রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত। যে কোনো কিছুর প্রথমেই আমাদের এটা মনে রাখতে হবে। নির্বাচনকেও রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবেই দেখতে হয়। আমরা সেভাবেই দেখি। আদানিকাণ্ড ঘটার পরে অনেক কিছুই আলোচনায় উঠে আসছে। পোর্ট থেকে কয়লাখনি থেকে বিদ্যুৎ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আদানিরা যখন বিনিয়োগ করে তার পেছনে কার কী স্বার্থ আছে, সেই জায়গায় যে মোদির সঙ্গে আমাদের এখানে দিদির যে কোনো পার্থক্য নেই তা বারবারই প্রমাণ হয়ে গেছে। এখানকার মুখ্যমন্ত্রীও তো আদানির হেলিকপ্টারে চড়ে নির্বাচনে প্রচার করেছেন। এগুলো একটা বিষয়। একভাবে প্রচার করার চেষ্টা। রাম বাম ইত্যাদি তুলে আনার চেষ্টা। কিন্তু এগুলোর মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট রসদ আছে। সেই লড়াই লড়তে হবে রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগতভাবেই। আমরা বিষয়টাকে কীভাবে দেখব সেটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের রাজনীতিটা কী ছিল? আমাদের ভবিষ্যতের রাজনীতিটা কী হবে।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার যখন প্রতিষ্ঠা হলো তখন জ্যোতিবাবু রাইটার্স বিল্ডিং-এ শপথ নিয়েই বলেছিলেন, আমরা রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চালাব না। আমরা গ্রাম, শহর থেকে সরকার চালাব। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চালানো যায়না। আমাদের সেই বোধ ছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সেই বোধ ছিল। সেই অনুযায়ী পরের বছরই ৭৮ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। যে নির্বাচনে বামপন্থীরা ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। সেই বছরই রাজ্যে বিশাল বন্যা হলো। সেই বন্যার মোকাবিলা করা এবং মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেবার কাজ সাফল্যের সঙ্গে করল নতুন পঞ্চায়েত।
সেইসব আমলে, মৌলিক পার্থক্য বোঝার জন্য দু’তিনটে কথা বলা দরকার। আমাদের সবচেয়ে বড়ো কাজ, যাতে সরকার প্রথমেই হাত দিয়েছিল এবং তিন বছরের মধ্যে অনেকটাই করেছিল। যে কাজ ধারাবাহিকভাবে শেষ বছর পর্যন্ত আমাদের সরকার চালিয়েছিল - তা হলো ভূমিসংস্কারের কাজ। যে সমস্ত জমি জোতদার, জমিদাররা আইন ফাঁকি দিয়ে বেনামে লুকিয়ে রেখেছিল সেইসব জমি উদ্ধার করে যারা খেতমজুর, গরিব কৃষক, চাষি - তাঁদের বিলি করে দেওয়া। আর তার সঙ্গে যারা বর্গাদার ছিল তাদের যে আইন ছিল, যেগুলো কার্যকর হচ্ছিল না সেগুলো, স্বাধীনতার আগে থেকে ফ্লাউট কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল, তা রেকর্ড করা হল। এই কাজটা মূলত আটকে ছিল, কারণ বিষয়টা অনেকটা আইন আদালতের মত ছিল। গরিব মানুষ পারবে কেন বড়োলোকদের সঙ্গে। এই বিষয়ে আমরা খুব সহজভাবে যেটা করেছিলাম তা হলো ওদের এইসব অফিসে আসতে হবে না। ওদের পাড়ায় গিয়ে এই কাজ করতে হবে। আগে অফিসাররা গেলে জোতদারের বাড়িতে, বড়োলোকদের বাড়িতে থাকতেন। সেখানে গরিবের বিচার পাওয়া খুব মুশকিল। সেইজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁবু খাটিয়ে কাজ করতে হবে আর মিটিং করতে হবে সন্ধেবেলায়। এটাকেই বলে অপারেশন বর্গা। এর ফলে চাষিরা জমি পেল। এই জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ লক্ষ একরের বেশি। প্রায় সোয়া দু’কোটি মানুষ এর ফলে উপকৃত হলেন। যে জমি তিনি বহুদিন ধরে চাষ করে এসেছেন সেই জমিতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো। ওই জমি থেকে কেউ তাকে আর সরাতে পারবে না। গ্রামের মানুষ ওই মাটিটার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল বলেই গণতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীকরণ করা গেছিল।
সম্পদের কেন্দ্রীভবন না ভেঙে গণতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় না। গণতন্ত্র মানে মানুষ। গ্রামের মানুষ গণতন্ত্রকে প্রয়োগ করতে পারবে। এই রাস্তাটা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়লো। পশ্চিমবাংলা খাদ্যে স্বয়ম্ভর হলো। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য আর বাইরের কারোর ওপর নির্ভর করতে হবেনা। এর আগে বাইরে থেকে, আমেরিকা থেকে খাদ্যশস্য আনতে হতো। অর্থাৎ আমাদের ছোটো চাষি, গরিব চাষি, সরকারি ভাষায় যাকে প্রান্তিক কৃষক বলে, এঁদের প্রায় ৮০ থেকে ৮৪ ভাগ এই কাজে কোমর বেঁধেছিল। এরফলে বড়োদের যে কেন্দ্রীভবন ছিল তা ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তাতে গণতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীভূত করা গেল। মানুষের হাতে দেওয়া গেল।
এই কাজের ফলে যারা জমি পেলেন, বিশেষ করে গরিব মানুষ, যারা সামাজিক বৈষম্যের শিকার, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ তাঁরাই পেয়েছিলেন ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ আদিবাসি, তফশিলি জাতি, সংখ্যালঘুরা। সামাজিক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য - এই দুটোর বিরুদ্ধে লড়াই। বাকি থাকলেন মহিলারা। যদিও মহিলাদের সবেতেই কমসংখ্যক দেখা যায়। যদিও মহিলারা যদি চাকরি বাকরি করেন তাহলেও তাঁদের একটা বড়ো অংশই কিন্তু বাড়ির কাজ থেকে রেহাই পান না। দিনের মধ্যে সবার আগে উঠে তারা সবার শেষে শুতে যান। তাঁরা বাড়িতে যে পরিশ্রম করেন সেই শ্রমের জন্য কোনো মূল্যই পান না। আনপেইড বলা যেতে পারে। যদিও পরিসংখ্যান বলে, পৃথিবী জুড়ে পুরুষরা যা পরিশ্রম করেন, মহিলারা তার দ্বিগুণ করেন। আর অন্যদিকে যদি ক্যালোরির হিসেব করেন তাহলে সারা পৃথিবী জুড়ে মহিলারা যে পরিমাণ খাবার খান, পুরুষরা তার দ্বিগুণ খান। সাম্প্রতিক সংকটের পর এই সমস্ত পরিসংখ্যান আরও বেশি করে মহিলাদের বিপক্ষে গেছে। তাঁদের জন্য আমরা পঞ্চায়েতে এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করেছিলাম। আর শেষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সেই সংরক্ষণ করা হয়েছিল ৫০ শতাংশের কম নয়।
এখন ‘ইনি’ এসে খুব বাহাদুরি করছেন। মানে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। প্রত্যেকদিনই তো তিনি মিথ্যা কথা বলে যান। উনি নাকি ওবিসি সংরক্ষণ করেছেন। এসবই বামফ্রন্ট আমলে করা। পঞ্চায়েতে ওবিসি সংরক্ষণ আমরাই করেছিলাম। মহিলাদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা বলেছিলাম ৫০ শতাংশের কম নয়। ইনি তাকে বদলে করলেন, ৫০ শতাংশের বেশি নয়। এই পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া বোধহয় খুব সহজ এবং এটা মানুষকেও বোঝানো দরকার।
রাজ্যের গরিব মানুষ যখন জমি পেল, রোজগার পেল, তখন পশ্চিমবাংলায় খাদ্য সংকট মিটল। ফাঁকা আন্দোলন করার আর কোনো জায়গা থাকলো না। আমরা চালে, সবজিতে, মাছে এক নম্বর হলাম। বনসৃজনে আমরা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলাম। শিক্ষা প্রভৃতিতেও আমরা এগোলাম। এসএসকে, এমএসকে হলো। যার ফলে মেয়েরা অনেকটাই এগিয়ে গেল। বামফ্রন্টের শেষ বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি ছিল।
সবদিক থেকে এটা হয়েছিল বলেই, গ্রামের মানুষের হাতে পয়সা এসেছিল বলেই নতুন হাট বাজার হলো। গঞ্জ গড়ে উঠলো। ছোটো মাঝারি শিল্প তৈরি হল। যাকে এমএসএমই বলে। ২০১০ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানে আমরা এক নম্বরে ছিলাম। আমাদের পরে দ্বিতীয় যে রাজ্য ছিল তার নাম গুজরাট। যদিও তারা আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। এটাই ছিল বাস্তব।
বড়ো শিল্প না হলে যে হবেনা তা বামফ্রন্ট ৯০-৯১ থেকে বলতে শুরু করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম এর পরে আর কৃষি দিয়ে হবেনা। শিল্প চাই এবং বড়ো শিল্প চাই। কৃষিতে এত মানুষের কর্ম সংস্থান হবেনা। যখন নয়া উদারবাদী নীতি চালু হলো তখন জ্যোতি বাবু বলেছিলেন, এবার দুটো জিনিসের বিদায় হবে। এক মাশুল সমীকরণ নীতি আর দুই হলো লাইসেন্স প্রথা। এর আগে পর্যন্ত মাশুল সমীকরণ নীতির জন্য রাজ্যের ক্ষতি হতো। আমরা বারবার তা বলেছি। আর লাইসেন্সিং ছিল কেন্দ্রের হাতে। যার ফলে শিল্পের লাইসেন্স পেত না রাজ্য। এরপর আমাদের রাজ্যে কিছু শিল্প হলো। রাজ্যে শিল্প, বিদ্যুতের জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা হলো। সবশেষে যে ম্যানুফাকচারিং শিল্পের জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল সিঙ্গুরে তার কী অবস্থা হয়েছে আমরা জানি। যার দাম আজও পশ্চিমবঙ্গকে মেটাতে হচ্ছে। কারণ এই মুখ্যমন্ত্রীর কাজে কোনো শিল্পপতি বিশ্বাস করেন না। এখন অগভীর সমুদ্রে ব্যবসায়ীরা গভীর সমুদ্র বন্দর করবে বলে। ওই আদানিরা যা করবে বলছে। এটাকে শিল্প পুঁজি বলে না। এটাকেই বলে লুটেরা পুঁজি। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম।
বিকেন্দ্রীকরণ মানে হলো মানুষ তাঁর গ্রামে বসে তিনি ঠিক করতে পারবেন তিনি কী চান, তাঁরা কী চান। তাঁদের মিটিং ডাকতে হবে। গ্রামসভা থেকে আরম্ভ করে উন্নয়ন সমিতি পর্যন্ত। বিকেন্দ্রীকরণ এভাবেই ছিল, আর এখন কী হয়েছে তা আমরা জানি। এই প্রসঙ্গে একটা দুটো তথ্য বলা যেতে পারে। যা প্রকাশিত হচ্ছে তার ভিত্তিতেই বলা যায়। ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি'র এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে এখন গরিব মানুষের সংখ্যা ৮০ শতাংশ। যদি গরিবের সংজ্ঞা হয় দিনে পরিবারের সব খরচ ধরে ৪৭ টাকা ব্যয়। এর বেশি হলে আপনি গরিবের আওতায় পড়বেন না। এরা বর্ধমান, পুরুলিয়া, কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলায় স্যাম্পল সার্ভে করেছেন এবং তা থেকেই এই তথ্য উঠে এসেছে। এটা আমরা প্রায় ২০-২৫-এ নামাতে পেরেছিলাম। আমরা যখন সরকারে এসেছিলাম যা ছিল ৭৩ শতাংশ। বাকি ২০ শতাংশ হচ্ছেন মধ্যবিত্ত এবং ১ শতাংশেরও কম হচ্ছেন তথাকথিত ধনী।
আমাদের রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী এখন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছেন। আমরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিইনি। জমি দিয়েছি। যেখানে উৎপাদন হবে। যার ওপর মানুষ দাঁড়াতে পারবে। সেই জমি আবার অনেক জায়গায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেই তথ্যও আছে। এর পাশাপাশি মহিলাদের যেসব স্বনির্ভর গোষ্ঠী ছিল সেগুলোও নেই। ২০১০-এ এই সমস্ত গোষ্ঠীর ছিল ২,৫০০ কোটি টাকা। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই গোষ্ঠীগুলোকে দেওয়া হয়েছিল আরও ৮ হাজার কোটি টাকা। ওদের হাতে মোট ছিল সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ৪ শতাংশ হারে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা নানারকম কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছিল। তা এখন শেষ। দুর্দশার মুখে।
আমরা কী চাই? কী ছিল কী হয়েছে তা মোটামুটি জানা গেল। যা করেছিলাম সেগুলোই আবারও করব। গণতন্ত্র, মানুষের উন্নয়ন - এগুলো তো ছেড়ে দেওয়া যায়না। এখনও আমরা চেষ্টা করি সোজাসুজি গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। পদযাত্রা হলো। এবার রাস্তা ছেড়ে পাড়ায় যেতে হবে। পাড়া থেকে মানুষের বাড়ি যেতে হবে। বাড়িতে গিয়ে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ করতে হবে। কথা বলে যা জানতে পারা যায় তার চেয়ে বড়ো তথ্য আর কিছু হতে পারে না। পারস্পরিক আদানপ্রদান। মনে রাখতে হবে, মানুষই হচ্ছে আমাদের বড়ো শিক্ষক। আমরা পড়ে যা জানি তার চেয়ে অনেক বেশি জানি মানুষের কাছ থেকে শুনে এবং সেইসব মানুষের কাছ থেকে যারা লেখাপড়া শিখতে পারেননি। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে কথা বলেন। সেটাই আমাদের বড়ো শিক্ষা হবে। সেখানেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।