E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯

কৃষিতে আজ গভীর সংকট

অমল হালদার


এই মুহূর্তে সারা দেশের কৃষি ব্যবস্থা ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি। বৎসরাধিক দিল্লির উপকণ্ঠে লক্ষ লক্ষ কৃষকের শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন সারা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশের অন্নদাতাদের শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে তুচ্ছ করে মরণপণ লড়াই দিল্লির সিংহাসনকে কাঁপিয়ে দি‍‌য়েছিল। মোদিজি নিজের তৈরি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দি‍‌‍‌য়েছিলেন তিনি তা রক্ষা করেননি, দেশব্যাপী সেই কারণেই ‘বিশ্বাসঘাতকতা দিবস’ পালিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত কেরালার ত্রিচুরে সারা ভারত কৃষক সভার ৩৫তম সর্বভারতীয় সম্মেলনের মঞ্চে আমন্ত্রিত সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্ব পুনরায় দেশব্যাপী আন্দোলন সংগ‍‌ঠিত করার আহ্বান জানান। ইতিমধ্যেই ৫ এপ্রিল শ্রমিক, কৃষক ও খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ করে পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে। ২৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও কৃষি ঋণ মকুবের দাবিতে ট্রাক্টর মিছিল সংগঠিত হয়েছে। কৃষক সংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ সরে দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হতে চলেছে। এরই মাঝে কেন্দ্রের বাজেটে কৃষকদের সর্বনাশ করার যে ব্যবস্থা হলো, এর ফলে অন্নদাতা কৃষকরাই শুধু আক্রান্ত হবেন না, সমাজের অন্যান্য শ্রেণি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা হতো তার বরাদ্দ প্রায় ২২ শতাংশ ছাঁটাই করা হয়েছে। কৃষকদের কাছে ফসল সংগ্রহ না করলে যেমন কৃষকের ক্ষতি, তেমনি রেশন ব্যবস্থার উপর কোপ মারা হচ্ছে। এর ফলে গ্রামের গরিবরা আরও বিপদের সম্মুখীন হবেন। কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমানো হয়েছে কমে‍‌ছে মিড-ডে মিলের প্রকৃত বরাদ্দ, ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ ক‍‌মেছে, সার সহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের ভরতুকি কমেছে। কমাবার এই হার দেখেই বোঝা যায় কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের আরও বেশি দুর্বল করে কৃষি ব্যবস্থাকে করপোরেটের হাতে তুলে দিতে চাইছে। কৃষিতে এই ভয়াবহ সংকটে আত্মহত্যাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দে‍‌শের সবুজ বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র পাঞ্জাবে সাম্প্রতিককালে ৬টি জেলায় ১৬,৫৯৪ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের নানা জায়গায় আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশের প্রচার মাধ্যম এক্ষেত্রে নীরব, সরকারও তথ্য চাপা দেবার চেষ্টা করলেও সবটা ঢেকে রাখতে পারছে না। দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথ বারে বারে উল্লেখ করেছেন, প্রচার মাধ্যম গ্রামের মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে ১ শতাংশ সংবাদও পরিবেশন করে না। স্বাভাবিকভাবে দেশের এই অন্ধকারময় করুন চেহারা দেশবাসীর কাছে অনেকটাই অজানা।

উদারীকরণ নীতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে চুক্তির ফলে দেশে যে কৃষি ব্যবস্থার উপর তীব্র আক্রমণ নেমে আসবে সেই সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে কৃষক সংগঠনগুলি যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে দেশের বহু মানুষ তা উপেক্ষা করেছিলেন। বিপদের মাত্রা কোথায়‍‌ পৌঁছতে পারে এখন অনেকেই হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান যে সরকারটি চলছে তা আদ্যপান্ত জনস্বার্থবিরোধী, কৃষক সহ সমস্ত শ্রমজীবী অংশের তীব্র বিরোধী। মোদিজির আগেই প‍‌‍‌শ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এমন একটি বিল আনা হয়েছিল যা শুধু কৃষক বিরোধী নয়, করপোরেটদের লুঠ করার মৃগয়াক্ষেত্র তৈরির ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রথমদিকে কৃষকরা এতটা বুঝতে পারেননি। যতদিন যাচ্ছে কৃষকরা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছেন, একটু মুখ পালটে দই খেতে গিয়ে চুন খেয়ে ফে‍‌‍‍‌লেছেন। গলায় তীব্র জ্বালায় ছটফটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। আত্মহত্যার পরিমাণ ব্যাপক বেড়ে চলেছে। নবান্ন চেয়েছিল কোনোভাবেই যেন আত্মহত্যার কোনো সংবাদ পরিবেশিত না হয়। সাম্প্রতিককালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় পুলিশ রিপোর্ট ফাঁস হলে দেখা যায়, একটি মাত্র জেলাতেই এই ৩ বছরে ১২২জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। সব তথ্য আমাদের কাছে আসে না, একটি জেলায় যদি এই তথ্য সামনে আসে তাহলে প‍‌শ্চিমবঙ্গের চেহারা সহজেই অনুমেয়। যে বর্ধমান জেলাকে শস্যভাণ্ডার হিসাবে চিহ্নিত করা হতো সেখানেও মাত্র ১৫ দিনে ২৩জন কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই রাজ্যে ধান, আলু সহ হরেকরকম সবজির কোনো দাম নেই। কেরালায় কুইন্টাল প্রতি ২,৮৫০ টাকা দিয়ে রাজ্য সরকার ধান ক্রয় করে অথচ এই রা‍‌‍‌জ্যের সরকার ধানের দাম বাঁধলেও ফড়েদের কাছে ১২০০-১৩০০ টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষকেরা। প্রায় এক দশক ধরে কৃষকদের এই যন্ত্রণা সত্ত্বেও রাজ্যের সরকারের কোনো টনক নড়েনি। কৃষকরা নিজ ‍‌জমি চাষ করা ছেড়ে দিচ্ছেন, গ্রামের খেটে খাওয়া কিছু মানুষ ৩/৪ বস্তা ধানের বিনিময়ে চাষ করছেন। ৫ বছর আগে এটা বোরো চাষের ক্ষেত্রে নজরে আসতো, এখন আমনেও ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। আবার যে গরিবরা চুক্তি চাষের মাধ্যমে জমি চাষ করতেন, তাদেরও ফসল বিক্রি নেই, মহাজনের দেনা বাড়ছে, স্বাভাবিকভাবে তাঁরাও চাষ করতে ইচ্ছুক হচ্ছেন না। ধানের পর আলু এরাজ্যে ব্যাপক উৎপাদন হয়। গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রথম দফায় আলু নষ্ট হবার পর কৃষক আশায় বুক বেঁধে দ্বিতীয় বার চড়া দামে বীজ, সার কিনে আলু বসানোর চেষ্টা করেন, ফলন ভালো হয়নি কিন্তু কৃষকদের ধারণা ছিল এবার দামটা বাড়বে। স্টোর ভরতি করার জন্য রাজ্য সরকারের বদান্যতায় বাইরের রাজ্য থেকে আলু এনে কোল্ড স্টোরেজ ভরতি করা হলো এবং সময় বু‍‌‍‌ঝে তা বাজারে চলে‍‌ গেল। রাজ্যের চাষিদের আলু কোল্ড স্টোরেজে থেকে গেল, কারণ বর্তমান দরে আলু বিক্রি করে স্টোর ভাড়া দেবার ক্ষমতা ছিল না। পরবর্তীকালে এমন পরিস্থিতি হলো যে, স্টোর ভাড়া দিয়ে আলু ছাড়াতেই গেল না আলু চাষিরা। অনেকের মনে থাকা উচিত ২০১৮ সালে বর্ষাকালে আলুর দাম ভালোই ছিল, ওই সময়ে প্রতিবেশি রাজ্য ওডিশায় বন্যা হয়, আলুর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়ীরা ওডিশায় আলু নিয়ে যেতে গেলে ট্রাক ভরতি আলু প‍‌শ্চিমবঙ্গ-ওডিশা সীমানায় আটকে দেওয়া হয়, আলু পচতে শুরু করে, তখন তৃণমূল কংগ্রেসের মাতব্বররা সেই আলু তথাকথিত ন্যায্য দামে বিলিয়ে দেয়। প‍‌শ্চিমবঙ্গের আলু চাষিরা দু’পয়সা পেতেন সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। এবার তো আরও সর্বনাশ। আলু উৎপাদনে একর প্রতি কমবেশি খরচ হয় ৭৫ হাজার থেকে ৯৫ হাজার টাকা। এবার আলু উৎপাদন হতে পারে ১২০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি। কম উৎপাদনেও যদি দুর্দশা হয় তাহলে অধিক উৎপাদনে কী হ‍তে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখন যা আলুর দর বিঘা প্রতি ১৩/১৪ হাজার টাকা লোকসান। অতীতে বামফ্রন্ট সরকার অধিক উৎপাদনজনিত কারণে ফলন বৃদ্ধিতে একবার ২০০ কোটি ও দ্বিতীয়বার ৬০০ কোটি টাকা আলুর অভাবী বিক্রি রোধে কৃষকদের স্বার্থে ব্যয় করেছিল। সেটাই ছিল কৃষকদের প্রতি সরকারের দায়িত্ববোধের উজ্জ্বল উদাহরণ। এবার তাই কৃষকসভা দাবি করেছে আলুর ন্যূনতম সহায়কমূল্য কুইন্টাল প্রতি ৯০০ টাকা দিতে হবে, আলুর অভাবী বিক্রি রোধ করতে রাজ্য সরকারকে সহায়ক মূল্যে আলু কিনতে হবে। এই দাবিগুলি নিয়ে রাজ্য আলু চাষি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ২৩ ফেব্রুয়ারি হুগলির চাঁপাডাঙায়। সেখান থেকেই আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আলুর মতো সবজিরও একই দশা। বড়ো সাইজের ফুলকপি মাত্র ১ টাকা, বাঁধাকপি দেড় টাকা কিলো, বেগুন, টমেটো সহ সব ফসলের একই অবস্থা। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় এই চিত্র সংবাদমাধ্যমও চেপে রাখতে পারেনি। সেই কপি যখন কলকাতার মানুষ ২০ টাকায় কেনেন তখন কেউ কেউ ভাবতে পারেন চাষিরা দারুণ দাম পাচ্ছে। মা‍‌‍‌ঝে ১৯ টাকা কার পকেটে ঢুকছে সেটা অনেকেই বোঝার চেষ্টা করেন না।

চারিদিকে একটা হাহাকারের চিত্র, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় গরিবদের কাজ নেই। জমি হারাচ্ছে কৃষক, শালি জমি রেকর্ডে থাকলেও বহুল পরিমাণ জমিতে এখন চাষ হয় না। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বছরে ৩০ দিনও মা‍‌ঠে কাজ জোটে না। কৃষক মরলে গ্রামের খেতমজুরদের জীবন যে অনিশ্চিত হবে এটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। লক্ষ লক্ষ যুবক ছেলে রুটিরুজির জন্য ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে। এইসব দেখে এই সরকারের কোনো লজ্জা নেই। অভাব কেমন বাড়ছে সাম্প্রতিককালে নভেম্বর মাসব্যাপী পদযাত্রায় কিছু বিষয় নজরে এসেছে যা আগে কখনো আমরা ভাবিনি। গ্রামে গ্রামে শিয়ালের উৎপাত মারাত্মকভাবে বেড়েছে। দিনের বেলায় হাঁস, মুরগি, ছাগল টে‍‌নে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছু জায়গায় সন্ধ্যা নামলে বাড়ির বাইরে বের হতে সাহস পাচ্ছেন না। শত শত শিয়াল গ্রামে ঢুকছে, কুকুরের কোনো সাড়া শব্দ নেই, কুকুরের বাচ্চাগুলোকে খেয়ে নিচ্ছে শিয়াল। গ্রামের মানুষ বলছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এক বিপদের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। হঠাৎ এই চেহারা কেন? গ্রামের মানুষের কথায় দিনে দিনে মানুষের অভাবের জন্য এটা ঘটছে। তাঁরাই বলছেন ‘‘আগে প্রত্যেক বাড়িতে ভাত খাওয়ার সময় থালায় কিছু ভাত রাখা হতো কুকুরের জন্য, বাড়ির সকল সদস্যের কিছু কিছু বাড়তি ভাতের জন্য কুকুরের পেট ভরে যেত, এখন মাপা চাল, থালায় আর ভাত থাকে না, গৃহস্থের অভাব যত বাড়ছে ততই কুকুরের আর খাবার নেই।’’ সকলের একই কথা কুকুরের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। জনগণের এই অভিজ্ঞতাটি নিয়ে আমাদেরও চর্চা করা দরকার। গ্রামের মেয়েরা বলছে বাঁচার জন্য দুটো হাঁস, মুরগি বা ছাগল প্রতিপালন করব তারও কোনো উপায় নেই। সব কিছু মিলিয়ে যদি দেখা যায় এ যেন এক দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। সংকট বাড়ছে আরও বাড়বে। এবার রাজ্য বাজেটেও বঞ্চিত কৃষি ও বাংলার গ্রাম। বাঁচার জন্য লড়াই ছাড়া আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই। প্রতিটি গ্রামে শ্রমিক-কৃষক ও খেতমজুরদের নিয়ে একটি জোট তৈরি করতেই হবে। আমরা পদযাত্রা করছি, বড়ো বড়ো সমাবেশ করছি, সবই আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে শুধু পুকুর বানালেই দায়িত্ব শেষ হয় না, সুদক্ষ জেলের মতো মাছ ধরে তুলতে হবে। সেই কাজের দিকে সকলেরই মনোনিবেশ করা দরকার।