৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯
‘ফ্যাসিবাদ’-‘একুশের চেতনা’-‘বামপন্থা’
অমিতাভ বিশ্বাস
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’
‘বিশ্ব মাতৃভাষা প্রেমী’ সংস্থাটি ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে জরুরি একটি বিশেষ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’ হিসাবে পালন করার ইস্তাহার তৈরি করে। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া সহ প্রায় পঞ্চাশটি দেশ সমর্থন জানিয়ে স্বাক্ষর করে।
ইউনেস্কো, ১৯৯৯ সালের জেনারেল কনফারেন্সের ৩০তম অধিবেশনে (১৭ নভেম্বর, সমাপ্তি অধিবেশন) ৩০সি/ডি আর ৩৫-এর ০৫২০৪ অনুচ্ছেদে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ গ্রহণের সিদ্ধান্ত (ডি আর ৩৫-এর ০৫২০৪ অনুচ্ছেদে) গৃহীত ও ঘোষণা হয়।
ভাষাচেতনা ও ফ্যাসিবাদ
ব্রিটিশ পণ্ডিত জেমস মিলের লেখা ‘হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ (১৮১৮-১৮২৩) ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সামগ্রিক ইতিহাস। ৩টে পর্বঃ ‘হিন্দু সভ্যতা’, ‘মুসলমান সভ্যতা’ এবং ‘ব্রিটিশ সভ্যতা’। এর মধ্যেই নিহিত সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের সূত্রপাত। শাসকের কাছে সাম্প্রদায়িকতা সবচেয়ে শানানো অস্ত্র। দ্বিজাতিতত্ত্বের দোহাই দিয়ে ভারত ভাগ তো তারই ফসল। যে ভাষা-সংস্কৃতি জাতির শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য, তাকে ছররা করে দিতে পারলেই পোয়া বারো। সুতরাং ভাষা-সংস্কৃতির উপর আঘাত হানো। ঔপনিবেশিক ভারতে যখন ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম দানা বাঁধছিল, ঠিক সেই সময়, ১৯২৫-এ আরএসএস’র জন্ম। যার বীজ নিহিত ছিল ‘হিন্দু সভ্যতা’র গোপন প্রকোষ্ঠে। কিছুদিন আগে মোহন ভাগবত ঘোষণা করে বসলেন - ‘ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্র এবং তা মীমাংসিত সত্য’। শ্রেণি-পরিচয়ের বদলে জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় এইসব ছদ্ম-পরিচয়কে আসল বলে দেগে দেওয়ার কৌশল।
ফ্যাসিবাদের শর্ত হলো উগ্র-জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটিয়ে জনগণকে আচ্ছন্ন করা। যাতে যুক্তি ও বিজ্ঞানবোধ হার মানতে বাধ্য; গণতন্ত্র-টন্ত্র মিছে বুলি - বরং অদূর ভবিষ্যতে এক কল্পিত স্বর্ণযুগের মহাবিকাশ স্বপ্নে বিভোর করা চাই। সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত-জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের ডিগ্রিধারী বড়ো একটা অংশকে উদ্বুদ্ধ ও আচ্ছন্ন করা। সাম্প্রদায়িক দেশাত্মপ্রেমের তুফান তোলা। জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে শত্রুপক্ষ - এই বোধ জীবনযাপনে চর্চাই ফ্যাসিবাদের পথ। দলিত মানুষের অধিকার হরণ, শোষণ, ধর্ষণ, বঞ্চনা যাই হোক, দেখতে হবে সে দেশভক্ত কিনা। তাই রাশি রাশি মিথ্যার ফুলঝুরি আওড়ে দেবতাকে হাটেহাটে বেচাকেনা করে চলে তাদের ড্রইংরুম সাজানো। ফ্যাসিবাদের এইটিই অন্যতম কাজ। কেন্দ্রীয় শাসককে দেখলে এর একটা কথাও এক-চিলতে ভুল প্রমাণ করতে পারবেন না কেউ।
চাই পরিকল্পনা মতো কাজ। অসংখ্য পরিকল্পনা সার্থক হবে ভাষা-সংস্কৃতিকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করলে। যে জাতির ভাষা নেই, তাঁদের সংস্কৃতিও নেই। ভাষা হলো সংস্কৃতির অপরিহার্য মৌলিক একক। তাই আগ্রাসনের সবচেয়ে বৃহত্তর সাফল্য আসবে যদি কোনো জাতির ভাষাটিকে খুন করা যায়। করপোরেট দুনিয়ার পরম বন্ধু ফ্যাসিস্তরা উন্নয়নের সূচক শুধু অর্থমূল্যেই বিবেচনা করে। সেখানে না আছে মনুষ্যত্ব না মানবিকতা, না নান্দনিকতা, না মূল্যবোধ। তাজমহলের অভ্যন্তরে ওরা পায় পাথরের হিসেব অর দামাদাম, অজন্তা-ইলোরায় দেখে উত্তেজনা, খাজুরাহে খোঁজে ন্যুড, শিশু ও নারীর মধ্যে শ্রম আর ভোগের হিসেব-নিকেশ।
এই লক্ষ্যে জনগণের টুটি টিপে ধরতে গেলে আগে ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতির মুখে লাগাম পরাতে হবে, এই উদ্দেশ্যে বিজেপি সরকার বাধ্য করছে আরএসএস’র মোটিভকে রূপদান করতে। দাও লড়িয়ে। চালাও মেধাহীন কেরিয়ারের সুতো কাটাকাটি। ভুলিয়ে দাও ইদ এবং ইগোর স্বেচ্ছাচারে। সংস্কৃতির গোটা এলাকা তছনছ করে ব্র্যান্ডেড লোগো লাগিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। এই জন্যে জনগণের ভাষা শ্রদ্ধার বিষয় কিছু নয়। মামুলি - ওটা ব্যাকডেটেড। এখন চটজলদি দুনিয়ায় কমিউনিকেটিভ ল্যাংগুয়েজ, লে-লে-বাবু ছ-আনা। তুমি হীরক রাজার ‘যন্তর-মন্তর’ ঘর-এর কোর্স করেছ, তোমার স্বাধীন ইচ্ছে থাকতে পারে না।
জনগণের টেস্ট আমূল পালটে ফেলা চাই। সবচেয়ে এফেকটিভ মিডিয়াম হলো - টিভি, কেবল-লাইন আর এফএম। যে কোনো জায়গা থেকে শোনা যায় - দেখা যায়। মনেই হবে না এর আগে কোনো অংশ বাদ গেল। কী হাব-ভাব কণ্ঠস্বর, কী বচন-বাচন। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, এমন কী ছোটো থেকে বড়ো অনেকের মুখের ভাষায় সিরিয়াল-ল্যাঙ্গুয়েজ অথবা এফএম-ল্যাঙ্গুয়েজ হরবকত। শুধু তাই নয়, ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য প্রাইভেট স্কুলগুলোর বেশিরভাগটাই এইসব ভাষার ল্যাবরেটরি। উদ্দেশ্য সফল করার সবচেয়ে সরল জায়গা হলো শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষানীতিতে আনতে হবে আমূল পরিবর্তন।
শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রাসন
এই উদ্দেশ্যে আরএসএস পুষ্ট বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করেছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, তার অভ্যন্তরে ঢুকলে চোখে পড়বে ভয়াল চিত্রঃ সরকার নাকি ৬৭৬ জেলার ৬,৬০০ ব্লকের আড়াই লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে দু’লক্ষ মতামত নিয়েছে। আশ্চর্য! তাহলে আর সমস্যা কোথায়? কস্তুরিরঙ্গন রিপোর্টে নজর দিলেই চক্ষু চড়কগাছ - সরকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটা কেমন ছিল!
কমিটি মতামত সার্ভে করেছে মুখ্যত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান, নানা ধর্মীয় সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে।
কোঠারি কমিশনের প্রস্তাব-জিডিপি’র ৬ শতাংশ বা কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা। ২০২০ শিক্ষানীতিতে রাখা হয়েছে মেরেকেটে ৩ শতাংশ।
কেবল কর্মমুখী-শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে - মৌলিক ও প্রাথমিক শিক্ষার স্থান নেই বললেই হয়। যে সময়টা জীবন-গঠনের জন্যে অত্যন্ত মূল্যবান - সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পরমলগ্ন, সেটা সত্যিই উপেক্ষিত। বিকশিত হবার সুযোগ না দিয়ে সে মোটাসোটা হাইব্রিড ফল দেবে - তেমন পারলেই হলো। স্কুলস্তর যেন দুধেভাতে। শুধু সংস্কৃত শিক্ষার উপর গুরুত্ব, প্রাদেশিক ভাষা-সাহিত্যের গুরুত্ব খারিজ - এইরকম নানান আরএসএস-গন্ধী অ্যাজেন্ডা। চটি-জামা-ব্যাগ-সাইকেল-ডিভাইস উপহার-ভিক্ষার ঢাউস প্রচার আছে। ভিক্ষের গর্তটাকে বড়ো করে তোলাই দুই সরকারেরই উদ্দেশ্য। জনগণকে আতশবাজির চোখ ধাঁধানো আলোয় বিভ্রান্ত করা মাত্র। অনলাইন-শিক্ষার উপর বিশেষ নজর দেওয়া, গুচ্ছ-বিদ্যালয় ব্যবস্থার মাধ্যমে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা প্রাধান্য পেয়েছে।
একাধিক অসম মানের বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করে হায়ার এডুকেশানকে মরজি-মাফিক নিয়ন্ত্রণ করা আর একটি মোটিভ। স্বাধীন গবেষণার মুক্ত পথ রুদ্ধ। এ জন্যে ইউজিসি-এআইসিটিই প্রভৃতি ঐতিহ্যমণ্ডিত উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থা তুলে দিয়ে হায়ার এডুকেশান কমিশন নামে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করছে।
স্বদেশ-প্রেমের নামে ‘ভারতীয়ত্ব’ এবং ‘ভারতবর্ষের ঐতিহ্য’ এইসব শব্দের আড়ালে রাখা হয়েছে মনুবাদী তীক্ষ্ণ দাঁত-নখওয়ালা হিন্দুত্ব-সুলভ আবেগ। পুঁজির লুঠ করার বিষয়টা আড়াল করার জন্যে ‘জাতীয় ঐতিহ্য’, ‘সনাতন আদর্শ’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। এক জাতীয় ইমোশনাল ব্লাক-মেইল।
শিক্ষাকে দেশি-বিদেশি করপোরেটদের মুনাফালাভের মৃগয়াক্ষেত্র বানানোর ব্যবস্থা পাকা। এতে গালভরা মুচমুচে নামের পরিকল্পনা আছে, কিন্তু রূপায়ণের জন্যে অর্থ-সংকুলানের কোনোরকম ব্যবস্থার উল্লেখ কোত্থাও নেই। সরকার সে দায় যেন ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।
তাতে সংরক্ষণের মূলনীতি উপেক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞানকে অন্ধকারে ঢেকে ধর্মের নামে জাত-বিভাজন সামনে রেখে শিক্ষাক্ষেত্রে বাড়বে বৈষম্য, অত্যাচার, শোষণ, লুণ্ঠন, শ্রেণি-বৈষম্য। আবার ব্রাহ্মণ্য-বর্ণবাদী সমাজ গঠনের পথ অবারিত করে দেওয়াই এই শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য।
‘এক জাতি-এক দেশ-এক ভাষা’ বুলি বহুত্ববাদী প্রাণবায়ু শেষ করার চেষ্টা, তাতে সন্দেহ নেই।
একুশের চেতনা ও ভাষা-আন্দোলন
একদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ - মানুষের ভাগ এবং ভাষা-সংস্কৃতির ভাগ সম্পন্ন করতে সফল হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসক। তার বিরুদ্ধে সুচেতন মানুষের ‘একুশের চেতনা’ - একুশের রক্তঝরা সংগ্রামের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চেনা যায় একুশের চেতনাকে। দেশে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারার একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী ছাত্র-সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং তার পটভূমি রচিত হয়েছিল বাহান্নর ভাষা সংগ্রামের ভিতর থেকে। সেই সূত্রে আন্দোলনের সবাই একুশের সন্তান। শহিদ হওয়া রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতদের মতো অসংখ্য বীরেরা রচনা করেছিলেন ইতিহাসের অমরগাঁথা।
বদরুদ্দিন উমরের কথায় - ভাষা-আন্দোলনে যাঁরা সক্রিয় পরিচালনার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা সমর্থক। তাঁদের চিন্তাধারা ও লাইন পার্টি-সার্কুলারের লাইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছিল।
ঢাকায় কুরেশির জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লাইন স্থির হয় পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী। এই কৌশলই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কমিউনিস্ট কর্মীরা চিরদিন সংগ্রামী জনতার সাথে দাঁড়িয়েই লড়াই করেছেন। শহিদ হয়েছেন, শত শত কর্মী-নেতা বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারারুদ্ধ থেকেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী বা প্রগতিশীল বাম-রাজনীতির সক্রিয় সদস্য - আবুল বরকত, আতাউর রহমান, আবদুল কাদের চৌধুরী, ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানি, আব্দুল মতিন, আবদুল কাদের চৌধুরী, অধীরচন্দ্র সাহা, অরবিন্দ কুণ্ডু, আবুল খালেক, কাজী আব্দুল বারি, শহিদ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক কমরেড শহিদুল্লা কায়সার, নাফিসা কবীর, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ। আবদুল গফফার চৌধুরী সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রগতিধারার এক সাংবাদিক কবি - ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’... খ্যাত।
একুশের চেতনা ও বামপন্থা
বামপন্থা - মানবিক চেতনার নাম। মুক্তির চেতনা। যেখানেই সংকীর্ণ বিভেদ-বৈষম্য, মানুষের বিপন্নতা, তার বিরুদ্ধে অধিকার-অর্জনের লড়াই বামপন্থার মজ্জাগত ধর্ম। তাই, বামপন্থা মানেই একুশের চেতনা - বুকের বামদিকে যেখানে হৃদয়...।
শোষণ মুক্তির সংগ্রাম মুখর মানুষ নিজের হাতেই নির্মাণ করে চলেছে সভ্যতা। বুকের বাম দিকে যেখানে হৃদয়, তারই তাগিদে, চেতনার তাড়নায়। বামপন্থা বুঝতে আগে বুঝতে হবে - বুকের বামদিকে হৃদয়বাদের কথাই।
‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর আহ্বায়ক নুরুল হক ভুঁইয়ার লক্ষ্য ছিল - একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, মানবিক দেশ গঠন। রাষ্ট্রভাষা পুনর্গঠনের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবুল কাশেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহর মতো নেতারা।
১৯৩৭ মহম্মদ জিন্না উর্দুকে দাপ্তরিক ভাষা প্রস্তাব করলে বিরোধিতা করেন ফজলুল হক।
বাংলা ও উর্দু সমান মর্যাদা দেওয়ার প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে, ১৯৪০ সালে। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ তোয়াহা এবং ৫২-র অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।
১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত ‘তমদ্দুন মজলিস’। ২ মার্চ, ১৯৪৮-এ ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘তমদ্দুন মজলিস’ ও ছাত্র লিগের ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। আবুল কাশেমের ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ গ্রন্থে স্পষ্ট উচ্চারণ - ধর্মের বাইরে আদর্শের মধ্যে মানুষ ভালো জীবনের নির্দেশ পায়।
ডঃ শহিদুল্লাহ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন - ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি’।
১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবিতে পূর্ব-বাংলায় প্রথম সাধারণ ধর্মঘটের মূল ভূমিকা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির।
সরকার ঘোষণা করেঃ বাংলাদেশের স্থানীয় কমিউনিস্টরা ভারতীয় কমিউনিস্টদের দ্বারা চক্রান্তের শিকার হয়ে এই আন্দোলন করছে।
মুসলিম লিগ সোচ্চার হয়েছিল যে, এই বাংলা ভাষা আন্দোলন কমিউনিস্ট ও হিন্দুদের কারসাজি। পাকিস্তানিরা যেন এই ফাঁদে পা না দেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সংবাদপত্র সূত্রে লিখেছেনঃ ঢাকার মার্কিন দপ্তরের গোপন দলিলে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠায় - ভাষা-আন্দোলন করতে ছাত্রসমাজকে খেপিয়ে তুলেছিল কমিউনিস্টরাই। বলা হয়েছে এরাই ভাষা-আন্দোলনের নাটের গুরু।
বিচ্ছেদের বহ্নিযজ্ঞে যখন ধর্মের শুষ্ক সমিধ জোগানের অভাব থাকে না, তখন আত্মবিসর্জনের দয়াহীন-কুণ্ড দ্বার খুলে দেয় সানন্দে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন - ‘ইতিহাসে যেখানে মানুষ একত্র হয়েছে অথচ মিলতে পারেনি, পরস্পরকে অবিশ্বাস করেছে, অবজ্ঞা করেছে, পরস্পরের স্বার্থকে মেলাতে চায়নি - সেখানে মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠতে পারেনি।’
একমাত্র বামপন্থাই পারে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে - ভাষা-আন্দোলনের অন্দরের অ্যালবাম খুলে তাই-ই বোঝাবার চেষ্টায় এই লেখা।