E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ১৭ জুলাই ২০২০ / ১ শ্রাবণ ১৪২৭

সরকারের অপদার্থতা অপশাসন ও শাসকদলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে

প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল রাজ্য


বিনা চিকিৎসায় ছাত্র মৃত্যুর প্রতিবাদে ছাত্র বিক্ষোভে চড়াও পুলিশ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের অপদার্থতা, উদাসীনতা এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং ঘূর্ণিঝড় আমফান-বিধ্বস্ত মানুষের ত্রাণের টাকা নিয়ে শাসকদল তৃণমূলের লাগামহীন দুর্নীতির প্রতিবাদে রাজ্যের সর্বত্র এখন বিক্ষোভে উত্তাল। করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা ক্রমেই সীমা ছাড়াচ্ছে। কিন্তু এর মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের কোনো উপযুক্ত পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রতিরোধে যে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টে সংক্রামিত ও মৃতের সংখ্যা এবং কোভিড চিকিৎসায় বেডের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে জালিয়াতি করতে দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকারকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচারের দামামা বাজিয়ে চলেছেন। তাঁর হাতেই রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ পরিচালনার ভার। অথচ রাজ্যে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে হুহু করে। রাজ্য সরকার বিভিন্ন বিষয়ে যে সমস্ত নির্দেশিকা ও বিধিনিষেধ জারি করছে তার সাথে বাস্তবের কোনো মিল থাকছে না। ফলে সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন আক্রান্ত-বিপর্যস্ত হচ্ছেন, আবার অন্যদিকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন মারাত্মকভাবে।

এই পরিস্থিতিতে আবার শাসকদল তৃণমূলের চূড়ান্ত অমানবিক, নিষ্ঠুর, কদর্য রূপও জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এরা প্রশাসন ও পঞ্চায়েতে দখলদা‍‌রি কায়েমের সুবাদে নির্বিচারে আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষদের প্রাপ্য ত্রাণের টাকা নানা কায়দায় লুঠ করছে। গরিব বিপন্ন মানুষের রেশন ও টাকা হাতিয়ে নেবার মতো কুৎসিত কাজে এদের বিবেক এতটুকু দংশন করছে না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই অপকর্মকে আড়াল করতে গিয়ে বলেছেন, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নাকি একটু আধটু ভুল হয়েছে। আবার ১৫ জুলাই নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, আমফানে ক্ষতিগ্রস্তরা নাকি ৯৯ শতাংশই ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে গেছেন। যাইহোক, রাজ্যের নানা প্রান্তে শাসকদলের নেতা, মাতব্বর ও পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও আত্মসাৎ করে নেওয়া টাকা ফেরতের দাবিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ, মিছিল সমাবেশে শামিল হচ্ছেন হাজার হাজার বঞ্চিত মানুষ। তাঁরা এই দাবি নিয়ে বিডিও এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারলিপি জমা দিচ্ছেন। তারই জেরে বিভিন্ন জায়গায় শাসকদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা ও পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছেন। গরিব অসহায় মানুষদের টাকা নেবার অভিযোগে তৃণমূলের পঞ্চায়েত কর্মকর্তাকে কান ধরে ওঠবস করতেও দেখা গেছে। মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমন করতে শাসকদলের ইচ্ছে অনুযায়ী অনেক জায়গায় আবার পুলিশকে নামানো হয়েছে। কিন্তু শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে কিছুতেই দমন করা যাচ্ছে না, বরং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এই বিক্ষোভ আরও চূড়ান্ত আকার নিচ্ছে।

গত ১৪ জুলাই রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতা আর গাফিলতিতে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে বিনা চিকিৎসায় তিন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্যভবনে বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই। মৃত এই ছাত্ররা হলেন ইছাপুরের ছাত্র শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় (বয়স ১৮), সন্তোষপুরের মনীষা দাস (বয়স ২৫) এবং জয়নগরের অশোক রুইদাস (বয়স ২৬)। মানুষের জীবন নিয়ে রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত অবহেলা ও নিষ্পৃহতার কারণে এভাবে তিন তরতাজা তরুণের জীবন অকালে ঝরে যাওয়ায় এসএফআই রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে। রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম বেহাল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, করোনা ছাড়াও অন্য রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা, বেসরকারি হাসপাতালে জনগণের সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি দাবি সহ বিনা চিকিৎসায় তিন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার তদন্তের দাবিতে এদিন এসএফআই-র ডাকে স্বাস্থ্যভবন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী বিধাননগর টেকনো ইন্ডিয়ার সামনে জড়ো হন ছাত্র নেতৃবৃন্দ। কিন্তু স্বাস্থ্যভবন অভিমুখে যাওয়া এই মিছিলকে আটকে দিয়ে হামলা চালায় পু‍‌লিশ। ছাত্রনেতা ময়ূখ বিশ্বাস, সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীক উর রহমান, রানা রায় প্রমুখকে গ্রেপ্তার করে ইলেকট্রনিক্স থানায় নিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা এরপর এই থানার সামনে গিয়ে ধৃত ছাত্রনেতাদের নিঃশর্তে মুক্তির দাবিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপরেও বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে অনেকেই আহত হন। পুলিশের বুটের লাথির আঘাতে এসএফআই কর্মী প্রসেনজিৎ দে গুরুতর আহত হন। তাকে যাদবপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পুলিশের এই আক্রমণ ও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই চলে ছাত্র বিক্ষোভ। সন্ধ্যায় ধৃত ছাত্রনেতাদের ছেড়ে দেওয়ায় শেষ হয় বিক্ষোভ। এদিন মুক্তি পাবার পর ছাত্র নেতারা বলেছেন, সরকার এভাবে প্রতিবাদ বন্ধ করতে পারবে না। অসহায় মানুষের কান্নার জবাব সরকারকে দিতেই হবে।

এদিন ছাত্রদের এই প্রতিবাদী ভূমিকাকে অভিনন্দন জানিয়ে বামপরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, একের পর এক মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, সরকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারবে না। আর এসবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালে পুলিশ দিয়ে লাঠি পেটা করবে - এসব চলতে পারে না।

এদিন এসএফআই কর্মীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে হুগলি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার সহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই কর্মীরা।

এদিকে করোনা সংক্রমণ ঠেকানো তো দূরের কথা, রাজ্যে যেভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে, তাতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখেছেন বামপরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী এবং বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান। ১৩জুলাই ওই চি‍‌ঠিতে তাঁরা লিখেছেন, রাজ্য সরকারের ব্যর্থতায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থা চলছে। রোগাক্রান্ত মানুষ কোথায় যাবেন, কী করবেন, কীভাবে পরিষেবা পাবেন তা নির্দিষ্ট করে গাইড লাইন প্রকাশ করুক সরকার।

এদিকে, আমফান ঝড়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, পরিযায়ী শ্রমিক সহ সকলের কাজের দাবিতে ১৪ জুলাই হুগলি জেলার হরিপাল বিডিও অফিস, উত্তরপাড়া কোতরং পৌরসভা ও পাণ্ডুয়ায় জামগ্রাম-মণ্ডলাই পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

প্রকৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য সামগ্রী বণ্টন ও আমফান ঝড়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে ১৩ জুলাই কয়েকশো মানুষ পু‍লিশের বাধা অতিক্রম করে তৃণমূল পরিচালিত ভগবানপুর ১নম্বর ব্লকের মাকোটবাড় গ্রাম পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেয় সারা ভারত কৃষক সভা ও খেতমজুর ইউনিয়ন। তৃণমূলের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ বন্ধ করা, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, মিথ্যা প্রাপকদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা, ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতি বন্ধ করা ইত্যাদি দাবিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বাদলপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে স্মারকলিপি দেয় খেতমজুর ইউনিয়ন।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের পীড়াকাটা এবং দাসপুরের চাঁইপাট পঞ্চায়েত দপ্তরে আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে দুর্নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখান শ্রমজীবী মানুষ। চাঁইপাটে বিক্ষোভ চলাকালীন তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য অঞ্চল সভাপতি উপস্থিত মানুষদের সামনে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চান। শালবনীর পীড়াকাটাতে আমফানে ঘরবাড়ি নষ্ট হওয়ার কোনো চিহ্ন না থাকলেও তৃণমূল-বিজেপি ভাগাভাগি করে চার হাজারের বেশি নিজেদের পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নামে ক্ষতিপূরণ নেয়। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের বিরাট মিছিল সংগঠিত হয়েছে।

আমফান ঝড়ে বিপন্ন মানুষের জন্য বরাদ্দ ত্রাণ লুঠ ও দুর্নীতির অভিযোগে বিক্ষোভ সর্বত্র দানা বাঁধছে। সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে জয়নগর ১ ব্লকের বিডিও নৃপেন বিশ্বাস। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সর্বত্র অভিযোগ উঠেছে ওরা ক্ষতিপূরণের অর্থ আত্মসাৎ করেছে, ত্রিপল লুঠ করেছে। এর বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) জয়নগর এরিয়া কমিটির আহ্বানে কয়েক হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ব্লক দপ্তরে বিক্ষোভ দেখান।

হাওড়া জেলার শ্যামপুরের বারগ্রাম পঞ্চায়েতে আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য, আমফান ঝড়কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা ও ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে হাওড়া জেলা কৃষকসভা ও খেতমজুর ইউনিয়নের উদ্যোগে গত ৯জুলাই ডেপুটেশন দেওয়া হয়। আমফানে ক্ষতিপূরণে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের প্রতিবাদে, পঞ্চায়েত ভিত্তিক ক্ষতিপূরণ প্রাপকদের তালিকা প্রকাশ করা, পেট্রোপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে, প্রতিটি গরিব পরিবারকে প্রতি মাসে ৭,৫০০ টাকা দেওয়া ইত্যাদি ৯দফা দাবিতে ৯ জুলাই বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বসিরহাট ১ নং ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। তৃণমূলের সন্ত্রাস কবলিত অঞ্চলেও দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ১৫ জুলাই দীর্ঘ ১০ বছর পর শাসকদলের দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্যের দাবিতে বিশাল ‍‌মিছিল, সমাবেশ হয় নন্দীগ্রামে। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) নেতা নির্মল জানা, ইব্রাহিম আলি, তাপসী মণ্ডল, কানাই সাহু, অমৃত মাইতি প্রমুখ। সভাশেষে বিডিও-র কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

এভাবেই রাজ্যের সর্বত্র পঞ্চায়েত ও ব্লকে অফিসে বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন অগণিত সাধারণ মানুষ।