৫৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ১৭ জুলাই ২০২০ / ১ শ্রাবণ ১৪২৭
মুখোশের আড়ালে চূড়ান্ত নীতিহীনতা
টোডার মল
‘রাজনীতি’ শব্দে অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে ‘নীতি’। যার অনেকগুলি আভিধানিক অর্থের মধ্যে দু’টি হলো : ‘কর্তব্য নির্ধারণের উপায় বা রীতি’ এবং ‘ন্যায়সঙ্গত বা সমাজের পক্ষে হিতকর বিধান’। শব্দে অর্ধেকটা থাকলেও রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নীতিসর্বস্ব হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিকে দেখলে একথা সত্যিই বিস্মৃত হতে হয়। তাদের কাজকর্মে অর্ধেকও যদি নীতিপূর্ণ হতো তাহলেই দেশের মানুষ বর্তে যেতেন। বাস্তবে তারা এই ‘নীতি’ নামক বস্তুটিকে এতটাই ত্যাগ করেছে যে, শক্তিশালী আণুবীক্ষণিক যন্ত্রেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না। সারা দেশের আখ্যানে যাওয়ার পরিসর এখানে নেই। হাতের কাছে এরাজ্যের শাসকদলের ন্যায় যে উত্তম নমুনাটি রয়েছে, সেটাকে একটু কাটাছেঁড়া করলেই আমরা উপসংহারে পৌঁছতে পারব।
যেমন ধরা যাক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রশ্নটি। এই লড়াইয়ে তৃণমূলই যে একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি তা প্রমাণ করতে দলটি উঠেপড়ে লেগেছে। আর তাকে তোল্লা দিচ্ছে বামপন্থাবিরোধী যাবতীয় প্রচারমাধ্যম। আসলে লক্ষ্য, নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের পক্ষে আনা। গত কয়েকটি নির্বাচনে এরাজ্যে তারা যে একাজে ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না। বিজেপি’র উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইতে না গিয়ে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটেছে তৃণমূল। চেয়েছে নিজেদের মুসলিম ‘মসিহা’ হিসেবে তুলে ধরতে। কেউ যদি সত্যই সৎভাবে নিজেকে মুসলিম মসিহা হিসেবে তুলে ধরতে কাজকর্ম করে তাহলে অন্তত আমাদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা নেই। আমরা দু’হাত তুলে সে কাজকে সমর্থন করব, পাশে থাকব। কেন না আমাদের দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সবদিক দিয়ে বড়ো বেশি অবহেলিত নিপীড়িত। প্রকৃতঅর্থে এঁদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কোনো গঠনমূলক কাজ না করে অবহেলা নিপীড়ন প্রভৃতিকে রাজনীতির ইস্যু করেছিল এদেশের বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি। তৃণমূল দলও আরএসএস-বিজেপি’র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই না করে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির সেই ফেলে আসা চটিতেই পা গলিয়েছে। তাই তৃণমূল দলের বিজেপি বিরোধিতার মধ্যে কতটা নীতি আর কতটা নাটকসর্বস্ব-কৌশল তা একটু বুঝে নেওয়া জরুরি। তবে এরজন্য সত্যিই বেশি গবেষণা কিংবা পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। দলটার জন্মের পর থেকে গত দু’দশকের ইতিহাসে একটু চোখ বোলালেই সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
রাজ্য কংগ্রেসে দলীয় ক্ষমতার লড়াইয়ে পেরে না উঠেই মমতা ব্যানার্জি দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি গড়েছিলেন। এখানে কংগ্রেসের সাথে কোনো নীতিগত বিরোধিতা ছিল না। কংগ্রেস ছেড়ে এসে রাজ্যের বিরোধী রাজনীতির পরিসরে কল্কে পেতে একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন মমতা। হিংস্রাশ্রয়ী বামবিদ্বেষ এবং একটা পরীক্ষিত লুম্পেনবাহিনী ছাড়া তাঁর কাছে বলার মতো আর কোনো অস্ত্র ছিল না। তবে সদ্য গড়ে-ওঠা একটা রাজনৈতিক দলের শুধু এই অস্ত্র নিয়ে ভোট বৈতরণী পেরনো সত্যই শক্ত ছিল। দরকার ছিল অর্থ ক্ষমতা-সবদিক দিয়েই শক্তসামর্থ্য একটা আশ্রয়স্থল। বিজেপি’ও এরাজ্যে পা-ফেলার একটা উপায় খুঁজছিল। কেননা, রথযাত্রা, ইটপুজো, বাবরি মসজিদ ধ্বংস প্রভৃতি দাঙ্গা-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে সারা দেশে বিজেপি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করলেও এরাজ্যে তাদের এই রাজনীতি জমি পায়নি। তার একমাত্র কারণ ছিল সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)সহ বামপন্থীদের মতাদর্শগত অবস্থান এবং ধারাবাহিক রাজনৈতিক লড়াই। এমতাবস্থায় অবস্থানগত কারণে তৃণমূল-বিজেপি’র জোট ছিল একেবারেই মণিকাঞ্চন যোগ। হয়েছিলও তাই। গত শতাব্দীর ’৯৮ ও ’৯৯ সালের দু’টি লোকসভা নির্বাচনেই তৃণমূল এবং বিজেপি জোট করে লড়েছিল। যে বিজেপি জন্মের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে একটাও আসন পায়নি তারাই তৃণমূলের হাত ধরে কৃষ্ণনগর ও দমদম লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু একটা কথা বারবার বলতেন, তাহলো: ‘‘তৃণমূলের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ তারা বিজেপি’কে এরাজ্যে নিয়ে এসেছে’’। এই দুই লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দিল্লিতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন যে দু’টি এনডিএ সরকার তৈরি হয়েছিল তাতে তৃণমূল শরিক হয়েছিল। রেল, কয়লার মতো মন্ত্রকের মন্ত্রিত্বের মৌতাতও উপভোগ করেছিল।
সেসময়ে যে কতো রঙ্গ মঞ্চস্থ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আরএসএস’র বই উদ্বোধন হয়েছে মমতা ‘বহিন’কে দিয়ে; ওই অনুষ্ঠানেই মমতাকে দুর্গারূপে বর্ণনা আরএসএস’র। মমতাও কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে আরএসএস’কে অভিহিত করলেন ‘দেশপ্রেমিক’ শক্তি হিসেবে। আর প্রার্থনা করলেন, পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-কে হারাতে চাই আরএসএস’র মদত। শুধু এইখানে থেমে থাকল না মাখামাখি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মমতার কালীঘাটের বাড়িতে এলেন। তাঁর মায়ের হাতে তৈরি মালপো খেলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও এই নয়া ‘মালপো-কূটনীতি’ স্থান করে নিল। সবদিক দিয়ে বলা যায়, সে সময়টা ছিল মমতা-অটলদের মধুচন্দ্রিমাকাল।
কিন্তু ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেতার জন্য এরাজ্যে তখনও বিজেপি যুৎসই শক্তি ছিল না। মমতাও টপাং করে পদ্ম থেকে হাতে গিয়ে পড়লেন। ওই প্রেম আর অবশ্যই ‘নীতি’ কালীঘাটের আদিগঙ্গার মজা চড়ে হারিয়ে গেল। ২০০১-র রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে মমতা ফের অটল-আদবানিদের নিরাপদ আশ্রয় নিলেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৪-র লোকসভা নির্বাচন এবং ২০০৬-র বিধানসভা নির্বাচনে লড়লেন বিজেপি’কে সঙ্গে করে। তবে, এর পরবর্তী সময়ে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে খাতায়কলমে অন্তত বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো জোট হয়নি। তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার দিল্লিতে। বামপন্থীরা ২০০৮ সালে সেই সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পর ২০০৯ সালে নির্ধারিত লোকসভা নির্বাচনে আবার ভিড়লেন কংগ্রেসের নৌকায়। সেই এক ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার কৌশল। যেখানে নীতির লেশমাত্র নেই। তবে তলায় তলায় যে পুরনো দোস্তের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তা প্রকাশ করে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেন উমা ভারতী। ২০১৬-র রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের পর তিনি প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন যে, প্রায় ১০০টি আসনে তৃণমূলকে জিততে বিজেপি সাহায্য করেছে। আজ পর্যন্ত মৃদুভাবেও একথার প্রতিবাদ করেননি মমতা ব্যানার্জি। তাছাড়া ২০১৪-উত্তর সময়ে দিল্লিতে বিজেপি সরকারের আমলে সারদা-নারদ দুর্নীতি মামলায়, সংসদে একাধিক জনবিরোধী বিল পাশে এমনকি কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা রদে ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশে তৃণমূল-বিজেপি’র সখ্য দেশবাসীর কাছে আড়াল থাকেনি। তাই এখন যতই তৃণমূল নিজেদের বিজেপি-বিরোধী বলে তুলে ধরুক না কেন তার আখেরে কোনো ভিত্তি নেই। এটা একটা তৃণমূল এবং বিজেপি’র মধ্যে কুস্তি কুস্তি খেলার মকসো চলছে। যাতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে দু’দলই নির্বাচনী ফায়দা তুলতে পারে।
ইতিহাসের আরেকটি শিক্ষাও রয়েছে। তা’হলো নীতিহীনতার কলঙ্ককে ঢাকতে ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নেয় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি। তৃণমূলের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী কিছু ঘটেনি। সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) তথা বামপন্থীদের দীর্ঘ লড়াইকে মানুষের মন থেকে মুছে দিতে তৃণমূলও মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে, ইতিহাস বিকৃত করছে। নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে তারা সিপিআই(এম)’র বিরুদ্ধে একশোভাগ অসত্য মিথ্যা উচ্চারণ করছে দৃশ্য-শ্রাব্য প্রচারমাধ্যমে। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে কলকাতার শহিদ মিনারে অনুষ্ঠিত একটা সভার কথা তারা এখন প্রায়শই বলছে। যে সভায় একই মঞ্চে জ্যোতি বসু এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীকে দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে দিয়ে তাদের সিপিআই(এম)-বিজেপি’র অতীত সখ্য তুলে ধরার প্রচেষ্টা। হ্যাঁ, ঘটনাটা সত্য, একই মঞ্চে জ্যোতি বসু এবং বাজপেয়ী ছিলেন। কিন্তু ওই সভাটি সিপিআই(এম) কিংবা বামপন্থীদের আহুত কোনো সমাবেশ ছিল না। বিজেপি’র ডাকা সমাবেশও ছিল না। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং মন্ত্রিত্ব এবং কংগ্রেস ছেড়ে আসার পর এলাহাবাদ উপনির্বাচনে জয়লাভ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জনমোর্চার পশ্চিমবঙ্গ শাখা বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং-কে সংবর্ধনা জানাতেই শহিদ মিনারে এই সভা সংগঠিত করেছিল। জনমোর্চা নেতা অশোক সেন এই সমাবেশ সংঘটনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই সমাবেশে জ্যোতি বসু, বাজপেয়ী ছাড়াও জর্জ ফার্নান্ডেজ, মধু দণ্ডবতেসহ বহু অ-কংগ্রেসী দলের নেতা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন অন্য বামপন্থী দলের নেতারাও। ওটা কোনো নির্বাচনী সভাও ছিল না।
১৯৮৯ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, যাতে রাজীব গান্ধী সরকারের পতন ঘটে, তাতে সারা দেশে কোথাও বামপন্থীদের সঙ্গে বিজেপি’র কোনো নির্বাচনী সমঝোতা হয়নি। কংগ্রেসের দুর্নীতি-অপশাসনের মতো বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচার করেই দেশবাসীর কাছে ভোট চেয়েছিল বামেরা। এখানে তৃণমূলের ন্যায় কোনো ছলনা, লুকোচুরি কিছু ছিল না। এমনকি সেসময়ে কংগ্রেস বিরোধী দলগুলির (বিজেপি ছাড়া) অভ্যন্তরীণ সব বৈঠকে সিপিআই(এম)সহ বামপন্থীরা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছিল। এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় বিরোধিতার কথা সোচ্চারে বলেছিল। সেই অবস্থানেই তারা আজ পর্যন্ত দৃঢ় আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের এটা সেই রাজনীতি যেটা একশো শতাংশ নীতিসর্বস্ব।
ইতিহাস অবশ্যই একটা সজীব বিষয়। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির বিবর্তন বুঝতে এর থেকে ভালো হাতিয়ার আর কিছু নেই। কিন্তু হাত-পা নেই ইতিহাসের। সে নিজে থেকে মানুষের কাছে যেতে পারে না। সঠিক ইতিহাস মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হয়। না’হলেই সুযোগ নেয় তৃণমূল-বিজেপি’র মতো নীতিহীন রাজনৈতিক দলগুলি। সমাজ পরিবর্তনের সৈনিক হিসেবে বামপন্থীদেরই সঠিক ইতিহাস মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তৃণমূলের এই যে ভণ্ডামি সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই যে আড়ালে রয়েছে তা কিন্তু নয়। এই রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূল যে একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়, এবং শুধু ‘হাওয়া’ দেখেই অবস্থান নির্ধারিত হবে তাদের-তাও রাজ্যের মানুষ বোঝে। তবে কিছু মানুষ এখনও বিভ্রান্ত আছেন। তাঁদের কাছে সঠিক তথ্য ইতিহাসটা তুলে ধরতে হবে। এটাও কমিউনিস্ট-বামপন্থীদের নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির একটি কর্মসূচি।