৫৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ১৭ জুলাই ২০২০ / ১ শ্রাবণ ১৪২৭
রঙের খেলার সেই সভাতে
বনবাণী ভট্টাচার্য
উনিশ শতকের অন্যতম বিশিষ্ট বাঙালি আনন্দকৃষ্ণ বসু, পরবর্তীকালে সর্বজন প্রণম্য এক বিরাট মানুষের সম্পর্কে বলেছেন : ‘‘আমাদের বাড়িতে এলে ৭-৮ ঘণ্টার কমে বাড়ি ফিরতে পারতেন না। তাঁকে ঘিরে বসে আমরা, তাঁর মুখে রহস্যমধুর গল্প শুনতাম। কখনো হাসতাম, কখনো কাঁদতাম, কখনো আহ্লাদে তাঁকে আলিঙ্গন করতাম। উপমার তিনি অক্ষয় ভাণ্ডার। নিত্য নূতন গল্প, নিত্য নূতন উপমা। গল্পে আমোদ করতে এমন আর কেউ পারতেন না।’’
এই বর্ণনায় একজন মজলিসী মানুষের ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত যে মানুষটির সম্পর্কে এই বর্ণনা, সেই মানুষটির এই ছবি, গড়পড়তা বাঙালির পক্ষে মেলানো খুব সহজ কাজ নয়।
বিদ্যাসাগরের সে ছবির সাথে সর্বস্তরের বাঙালির পরিচয়, সেই ছবি দেখে কোনোভাবেই তাঁকে সুপুরুষ বলে ভাবা যায় না। যথেষ্ট বেঁটে খাটো এবং মাথাটা দেহের তুলনায় বেশ বড়ো। চণ্ডীচরণ রেয়াত করে বলেছেন তাঁর রঙ ফর্সা ছিল না, কবি নবীন সেন কোনো রাখঢাক না করে বলেছেন কৃষ্ণবর্ণ। বিদ্যাসাগর সুরূপ না কুরূপ, প্রশ্ন একেবারেই তা নয়। বিষয়টি হলো, মস্ত বড় কপাল, ভাঙা গাল, কোটরগত তীব্র চোখে নীরস-রুক্ষ-কঠোর বৃদ্ধের মুখে রহস্য-মধুর গল্প রসিকতা যার প্রতিক্রিয়ায় ছোটো বয়সের শ্রোতারা সব, কথকমশাইকে জড়িয়ে ধরতে পারে সেটাই বড় বিস্ময়ের। বিশেষত, যাঁর কথা বলাও সহজ-সাবলীল ছিল না, তোতলামির জন্য কথা হোঁচট খেত, কণ্ঠস্বর তেমন আকর্ষণীয় নয়-রূপেও তো রামমোহন-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথদের ধারে কাছেও নয়। তবু এই বজ্র কঠিন মানুষটির সান্নিধ্যে যে বা যাঁরা এসেছেন বিনা উদ্দেশে, তাঁরা এক চুম্বক-আকর্ষণ বোধ করেছেন। উত্তরকালের বাঙালি স্বপ্নেও একথা ভাবার সাহস করতে পারে না, যে গাম্ভীর্যের মহামূর্তি বিদ্যাসাগর ‘নগিয়া নগিয়া’ পড়ছেন হাসির কথায়, যেমন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন : ‘‘বিদ্যাসাগরের হাসি একটু বিচিত্র ছিল। তিনি হাসিতে-হাসিতে ‘নগিয়া নগিয়া’ পড়িতেন। এক এক সময় মনে হইত, তিনি বুঝি-বা চেয়ার হইতে পড়িয়া যান।’’ বিদ্যাসাগরের জীবনের এই রোদ ঝলমল দিকের কথা জীবনীকাররা তেমন করে উল্লেখ করেননি বা সামনে না এনে বরং আড়ালে রেখেছিলেন। কেন যে, তার ব্যাখ্যা আজ আর মেলা সম্ভব নয়, হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে এই হাসি তাঁর সম্ভ্রমের পক্ষে হানিকর।
কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘‘বিদ্যাসাগর গর্জন করতেন, ক্রন্দন করতেন, হাসতেন না?’’ কবি হেমচন্দ্র বিদ্যাসাগর-চরিত কাব্যে তাঁর সামগ্রিক চরিত্র ফুটিয়েছেনঃ
আস্চে দেখো সবার আগে বুদ্ধি সুগভীর,
বিদ্যের সাগর খ্যাতি, জ্ঞানের মিহির।
উৎসাহে গ্যাসের শিখা, দাঢ্যে শালকড়ি,
কাঙাল বিধবা-বন্ধু অনাথের নড়ি।
প্রতিভায় পরশুরাম, দাতাকর্ণ দানে,
স্বাতন্ত্র্যে শেঁকুলকাঁটা পারিজাত ঘ্রাণে।
পণ্ডিত - জ্ঞানী - দানশীল - দীন - দুঃখীর সহায় - দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিদ্যাসাগরকে ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই বিদ্যাসাগরের মধ্যে কি কোথাও হাসির এতটুকু ঝিলিক দেখা যায়? ‘রোদন ব্যাপার অতীব গর্হিত’ - যেটা বিদ্যাসাগরের ছিল অতিমাত্রায়, যার জন্যে রামচন্দ্রের পরেই বিদ্যাসাগরের নাম জিভের ডগায় এসে যায়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন: ‘‘ সেই দুর্দম প্রকৃতি, যাহা ভাঙিতে পারিত, কখনও নোয়াইতে পারে নাই; সেই উগ্র পুরুষকার, যাহা সহস্র বিঘ্ন ঠেলিয়া ফেলিয়া আপনাকে অব্যাহত করিয়াছে...।’’ এই উৎকট বেগবতী ইচ্ছা সব কিছু ভেঙে-ভাসিয়ে নিজেকে প্রবাহিত রাখতে, যে বিদ্যাসাগরকে ইংরেজের পদানত-কুসংস্কারাচ্ছন্ন অর্ধচেতন মানুষ এবং ভারতীয়দের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-করা ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জন করেই এগোতে হয়েছে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে - ‘‘সংস্কৃত কলেজে আধুনিক যুক্তিবাদী শিক্ষা প্রচলনে তাঁর প্রয়াস এবং বেনারস সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইন তাঁর বিপরীত প্রচেষ্টায় বিদ্যাসাগরের গর্জন টের পেয়েছেন। আর কোনো দীনদুঃখী আসিয়া দুঃখের কথা আরম্ভ করিতেই বিদ্যাসাগর কাঁদিয়া আকুল’’। তিনি কি সত্যিই রামগড়ুরের ছানার মতো গোমরামুখো? অথবা শুধু চোখের জল ফেলেছেন?
বিদ্যাসাগরের ছাত্র-বন্ধু-ভাই বা অন্যান্য ঘনিষ্ঠজনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিদ্যাসাগর চরিতে একবার, মাত্র একবারই বিদ্যাসাগরের পরিহাস-প্রিয়তা উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গক্রমে। ইংরেজি অভিধান-প্রণেতা ডঃ স্যামুয়েল জনসনের সাথে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন। এই সাদৃশ্য উপলক্ষে তিনি তাঁর একটি বিশেষ আক্ষেপ ব্যক্ত করেছেন : ‘‘আমাদের কেবল আক্ষেপ এই যে, বিদ্যাসাগরের বস্ওয়েল কেহ ছিল না; তাঁহার মনের তীক্ষ্ণতা সবলতা গভীরতা ও সহৃদয়তা তাঁহার বাক্যালাপের মধ্যে প্রতিদিন অজস্র বিকীর্ণ হইয়া গেছে, অদ্য সে আর উদ্ধার করিবার উপায় নাই।... সৌভাগ্যক্রমে, বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্ব তাঁহার কাজের মধ্যে আপনার ছাপ রাখিয়া যাইবে, কিন্তু তাঁহার অসামান্য মনস্বিতা, যাহা তিনি অধিকাংশ সময়ে মুখের কথায় ছড়াইয়া দিয়াছেন, তাহা কেবল অপরিস্ফুট জনশ্রুতির মধ্যে অসম্পূর্ণ আকারে বিরাজ করিবে।’’
নিশ্চয়ই মনস্বিতা হাসিতেই পরিব্যক্ত নয়। কিন্তু ঠাট্টা-বিদ্রুপেও হাসির একটা বিশেষ স্থান আছে। ওই যে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কারসাহেবকে দেখামাত্র বিদ্যাসাগর তাঁর তালতলা চটিসহ পা দু’খানা তুলে দেবার পর, তার যে কৈফিয়ৎ সে তো অবশ্যই শেঁকুলকাঁটা , কিন্তু হুল ফোটাবার আগে একটা হালকা হাসির হাওয়া কি বয়ে যায় না? - বিদ্যাসাগর ময়েড সাহেবকে বললেন: ‘‘সাহেব শিক্ষা আপনাদের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমরা তো অতি অসভ্য, আর আপনারা সুসভ্য ইংরাজ। তাই ভেবেছিলাম, সুসভ্য কার সাহেব টেবিলের উপর বুটসুদ্ধ পা তুলে আমাকে ইংরেজী-মতে অভ্যর্থনা করেছেন, সেখানে আমি যদি একইভাবে তাঁর অভ্যর্থনা না করি তিনি ক্ষুণ্ণ হবেন, আমার শিক্ষাও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমি প্রাপ্ত শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করেছি। এতে আমার কি অপরাধ বলুন?’’ এই নিরীহ প্রশ্নটি এবং ‘প্রাপ্তশিক্ষা অনুযায়ী কাজ’ - নির্ভেজাল হাসির নির্মল হাওয়ার পরে ‘সুসভ্য’ জাতি ইংরেজের উপর শেঁকুলকাঁটার মর্মান্তিক খোঁচাটা কতটা উপভোগ্য হয়েছিল সেদিনের শাসকসমাজ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে।
বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হতে পারে - বিদ্যাসাগর ছিলেন, চাঁছা-ছোলা ভাষায় বললে আড্ডাধারী বা আড্ডাবাজ। আর একটু শোভন হয় মজলিশি পণ্ডিত বললে। বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতি, সংগ্রাম-আন্দোলনে যে বিদ্যাসাগরের নাম, সেই নামই বাঙালির আড্ডার ইতিহাসে ঢুকে পড়েছে। আড্ডা মানে হাসি-তামাসা মজা। এর কোনো গাইডলাইনও নেই, বিধিনিষেধও নেই বিষয় বা ভাষায়। কখনও হা-হা-হোহো, কখনও পরচর্চা, কখনও চিৎকার চেঁচামেচি হাতা গুটিয়ে এগিয়ে আসার মতো। কথার পিঠে কথা এবং এক যেন হট্টমালা। যে বিদ্যাসাগরী ভাষার কাঠিন্য কোনো বাঙালির কাছে খুবই উপাদেয় বোধহয় না, সেই বিদ্যাসাগর লাগামহীন বিষয়ে লাগামহীন ভাষায় কথা বলছেন, হেসে গড়িয়ে পড়ছেন - এ যেন অকল্পনীয়। তিনি রকে বসে মুড়ি খাচ্ছেন, কথা বলছেন, কল্পনা করতেও যে সাহস লাগে, তার অভাব তো গড়পড়তা বাঙালির আছেই। এই ছবির সাথে মানানসই ভোজন-বিলাস। বিদ্যাসাগর তাতেও পিছপা ছিলেন না। নিজের হাতে রান্না করে পরিবেশন করতেন খুব আনন্দের সাথে। তাঁর সেই আনন্দের বহির্প্রকাশ এবং ছাত্রাবস্থায় শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের বাড়িতে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিদ্যাসাগরের লিখিত শ্লোক নিচে দেওয়া হলো -
(১)
হুঁ হুঁ দেয়ং হাঁ হাঁ দেয়ং দেয়ঞ্চ করকম্পনে।
শিরসি চালনে দেয়ং ন দেয়ং ব্যঘ্রঝম্পনে।।
(২)
লুচি-কচুরি মতিচুর শোভিতং জিলেপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম্
যস্যাঃ প্রসাদেন ফলারমাপ্লুমঃ
সরস্বতী সা জয়তানিরন্তরম্।।
বিদ্যাসাগর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল নিজে আবৃত্তি করতেন। তিনি কবিতা-রসিক ছিলেন যথেষ্টই। ঈশ্বরগুপ্তকে তিনি সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন। স্বভাব কবি রাসবিহারী, গায়ক ধীরাজ, এঁদের গুণগ্রাহী ছিলেন বিদ্যাসাগর। এতটাই গুণগ্রাহী যে, কবি রসিকচন্দ্র রায় বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে বলে উঠেছিলেন: ‘‘যখন বিদ্যাসাগর নাই, তখন আমিও আর নাই।’’ এই মানুষটিই বীরসিংহ গ্রামের ‘শচীবামনীর’ দিঘির মাঠে কপাটি খেলায় বলশালী গদাধর পালকে হারিয়ে দিতে পারতেন। খর্বকায় বিদ্যাসাগরের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধি হয়েছে তাঁর ব্যায়াম-অভ্যাসে। কপাটির পর কুস্তিও তাঁর প্রিয় খেলা। সংস্কৃত কলেজে তাঁর বাসস্থানের সামনে তিনি কুস্তির আখরাও করেছিলেন। বিদ্যাসাগরকে হারিয়ে তাঁর স্মৃতিতে আত্মহারা এ বৃদ্ধকে বলতে শোনা গেছে : ‘‘তাঁহারই ঘরের সম্মুখে যে মাটি তিনি কোদাল দিয়া কাটিয়া তথায় কুস্তির আখরা করিয়াছিলেন, যে মাটি তিনি নিজে গায়ে মাখিয়া কুস্তি করিতেন, সেই ভূমির সেই পবিত্র মাটি মস্তকে করিয়া একটু লইয়া আসিবে কি?’’ বাগান করা-কবিগান সংগ্রহ করার আগ্রহ ও স্বভাব এই আপাত রসকসহীন মানুষটিরই যে, ভাবতে গেলেও ঢোঁক গিলতে হয় যেন।
কিন্তু বিচিত্র বর্ণের মানুষটির ধর্মমত অজ্ঞেয়। ধর্ম নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা একেবারেই ছিল না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বড়োজোড় বলতেন : ‘‘গঙ্গাস্নানে যদি আপনার দেহ পবিত্র মনে করেন, শিবপূজায় যদি হৃদয়ের পবিত্রতা লাভ করেন, তাহলে তাই আপনার ধর্ম।’’ শাস্ত্রপড়ার ক্লাসে পণ্ডিতমশাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেন : ‘‘আপনি যেমন বোঝেন, আমিও তেমন বুঝি - পড়িয়ে যাচ্ছেন, পড়িয়ে যান।’’ তবে ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর সুউচ্চ ধারণা এরকমই ছিল যে ‘‘ঈশ্বর থাকলেও, তিনি তো আর কামড়াবেন না।’’
ধর্মের মতো চরমতম গম্ভীর বিষয় নিয়ে, শাস্ত্রশাসিতসমাজে যিনি পরিহাস করতে পারেন, তিনি কেবলই গর্জন করেছেন, অশ্রু বিসর্জন করেছেন, ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়েছেন, হেসে গড়াগড়ি যাননি - তা তো হয় না। যত কঠোর, যত বিরাটই হোন তিনি তো রক্ত-মাংসেরই মানুষ ছিলেন। এবং মহা-মানুষ ছিলেন। তাই, অন্তঃস্থলে যে হাসি-আনন্দের ঝর্না নিত্য প্রবাহিত ছিল, অনেকে যা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, বিদ্যাসাগরের অনন্যতন্ত্র তাকে তাঁরই অধীনস্ত করে রাখতে পারতেন অবলীলায়।
বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত প্রচলিত নানান গল্পেও তাঁর রসিক মনের হদিস আছে। ওই যে প্রচলিত গল্পটি, সাহায্যপ্রার্থী মানুষটি বিদ্যাসাগরকে বড় দুরাবস্থায় আছি বললে, বিদ্যাসাগর যে বলেছিলেন, তা আপনার আকারেই বোঝা যাচ্ছে - অথবা কেউ তাঁকে নিন্দা-মন্দ করছে শুনলে যে বলতেন, আমি তো তার কোনো উপকার করিনি, অথবা বিধবা বিবাহ আইন হবার পর, যখন এক ধনী জমিদার তাঁকে প্রাণে মারার জন্য লাঠিয়াল নিয়োগ করেছে, বিদ্যাসাগর সটান তাঁর বৈঠকখানায় গিয়ে যখন বললেন যে, ওই নিযুক্ত লোকগুলোর কষ্ট লাঘব করতেই তিনি ওখানে উপস্থিত হয়েছেন, এবার তাঁকে মারা হোক - এই সব কাহিনিতে মনে হয় না, ‘‘হাসির বানে হেনেছ কত শ্লেষ কথা?’’
অনিঃশেষ এক রসবোধের মানুষ, রবীন্দ্রনাথের ওই মহারথীগণের অগ্রগণ্য বিদ্যাসাগর। দেশের চিত্তকে যিনি ভবিষ্যতের সফলতার অভিমুখে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, যিনি নবীনের বিদ্রোহ নিয়ে প্রায় অর্ধচেতন, অবশ, অলস জাতিকে নাড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন, যিনি বীরবিক্রমে ব্রাহ্মণ- পণ্ডিত পরিবারের সন্তান হয়েও আচারের দূর্গে আঘাত হেনেছেন,সেই আধুনিকতম মানুষটির অন্তর যদি বিচিত্র রসের ভাণ্ডার না হয়, তাহলে কি তাঁর মনুষ্যত্ব কখনও অক্ষয় হতে পারত? সেই অন্তরে জন্ম নিত কি দয়ার বীর্য, বুদ্ধির বলিষ্ঠতা, করুণার প্রস্রবণ, অপার সংবেদনশীলতা? তাই রেনেসাঁ ম্যান বিদ্যাসাগরের সম্বৃত রসস্রোত, নির্মল সরল হাসির প্রকাশে তাঁকে মনে হয় : ‘‘যেন তরুণ অরুণ কিরণোদ্ভাসিত প্রভাতের কাঞ্চনজঙ্ঘা।’’
হ্যাঁ ‘‘তাঁর হাতে ছিল হাসির ফুলের হার-কত রঙে রঙ করা।’’ দুঃখের তাপে পুড়ে পুড়ে, সেই হাসি কখন যেন চার্লস ডিকেন্সের মতনই কান্নার স্রোতে মিশে যেত। হাসি-কান্না আর পৌষফাগুনের ভিতরের তফাতটাও একাকার হয়েছে তাঁর জীবনে। পাগলের হাসি দেখে যখন সকলে হেসেছে, তখন বিদ্যাসাগরের চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরেছে।
আর এই নিরন্তর রসস্রোতের জন্যই, মানুষের স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা-কৃতঘ্নতা সত্ত্বেও তিনি কখনও মানববিদ্বেষী হননি। তিনি শিক্ষিত-মধ্যবিত্তের নীতিহীনতায় বাক্রুদ্ধ-অসহিষ্ণু হয়েছেন - কিন্তু যারা, মাটির সাথে মিশে অকৃত্রিম-সরল-সাবলীল মানুষ, তাদের প্রতি তাঁর ভালবাসা অবারিত থেকেছে তাঁর স্বেচ্ছা-নির্বাসনেও। মনুষ্যত্বের প্রাচুর্য যাঁর অফুরন্ত, মানবতন্ময়তা যাঁর এত সুগভীর মানবমুখিনতা যাঁর এত দুনির্বার, তিনি কি কখনও চারদিকের রসস্রোতের মধ্যে প্রবাহিত জীবনের রঙের খেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন? তাই অশ্রুর রসে ভরা দুখের ফলভার বহন করেও, অক্ষয় মনুষ্যত্ব ও অপরাজেয় পৌরুষের বিদ্যাসাগর হাসির গতি রুদ্ধ করতে পারেননি। অপরপক্ষে সেই অনাবিল হাসিতে অনাবিল আনন্দ দান করেছেন। তিনি তাই - গাম্ভীর্যের মহামূর্তি, রহস্যের মহাস্ফূর্তি।