৫৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ১৭ জুলাই ২০২০ / ১ শ্রাবণ ১৪২৭
শতবর্ষে ‘নবযুগ’ : নজরুল ও কাকাবাবু
গৌতম রায়
মুজফ্ফর আহ্মদ
কাজী নজরুল ইসলাম
সেনাবাহিনীর জীবন অতিক্রান্ত করে কলকাতায় আসার পর, শৈশবে শিক্ষক নিবারণ ঘটকের কাছে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালাবার প্রাথমিক সরঞ্জাম জড়ো হয়েছিল নজরুলের জীবনে, তা একটা সুসংবদ্ধ আকার ধারণ করে মুজফ্ফর আহ্মদের সংস্পর্শ এবং ‘নবযুগ’ পত্রিকাতে লেখার ভিতর দিয়ে দেশপ্রেমের স্ফূরণে সুনির্দিষ্টভাবে দেশপ্রেমের দিকনির্দেশে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে নজরুল এবং মুজফ্ফর আহ্মদের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পালন করেছিল এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নজরুল এবং মুজফ্ফর আহ্মদের যৌথ সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘নবযুগ’ পত্রিকাটি। মধ্য কলকাতার ৬ নম্বর টার্ন রোড থেকে প্রকাশিত এই ‘নবযুগ’ প্রথম প্রকাশের দিন থেকেই মানুষের মন জয়ের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা নিতে শুরু করে।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির ভারতে তথা বাংলাতে বিকাশের সেটি আদিপর্ব। সর্বভারতীয়স্তরে তখনো আরএসএস’র জন্ম হয়নি। তবে হিন্দু মহাসভা সাম্প্রদায়িক হিন্দু চেতনাকে জোরদার করতে তখন থেকেই সক্রিয়। ‘নবযুগ’ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের তিন বছর পরে, অর্থাৎ ১৯২৩ সালে অখণ্ড বাংলায় হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গভঙ্গের সময়কাল থেকেই (১৯০৫) অর্থনৈতিক প্রশ্নে মুসলমান সমাজের বঞ্চনার বিষয়টি তীব্র হতে শুরু করেছে। তার জের ধরে মুসলমান সমাজের ভিতর শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি সহ প্রতিটি বিষয়ে তাঁদের পিছিয়ে থাকাকে কেন্দ্র করে একটা হীনমন্যতা আর তা থেকে বিচ্ছিন্নতার একটা ক্ষীণ ধারা তীব্র হচ্ছে। সেই ধারার একটা পরিণতি হিসেবেই সচেতন মুসলমানের একটা বড়ো অংশ ধর্মীয় পরিমণ্ডলের দিকেই বেশি ঝুঁকতে শুরু করেছে।
এই প্রবণতা সেনাজীবন শেষ করে কলকাতায় ফেরার অব্যবহিত পরে যে একটা ক্ষীণভাবে নজরুলের ভিতর দেখা যায়নি তা নয়। সেই প্রবণতা যাতে কোনো অবস্থাতেই নজরুলের ভিতরে বাসা বাঁধতে না পারে সেজন্যে প্রথম থেকে সচেষ্ট ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ সুহৃদ তথা বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব মুজফ্ফর আহ্মদ। সেনা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় প্রথম বসবাসের প্রাথমিক পর্বে একটা মুসলিম-স্বরূপের দোলাচলে ভুগছিলেন নজরুল। সেই মুসলিম-স্বরূপের উপর অসাম্প্রদায়িকতার আস্তরণ বিস্তারে নজরুলের জীবনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো মুজফ্ফর আহ্মদের।
এই সময়ে গোলাম মোস্তাফা, হেমেন্দ্রলাল রায়, শশাঙ্কমোহন সেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, কান্তিচরণ ঘোষ (রুবাইৎ ই ওমর খৈয়ামের অনুবাদক), ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায় (হিতকরীর সম্পাদক), যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শক্তিপদ সিংহদের সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদের সূত্রেই নজরুলের সংযোগ ঘটে। এই সংযোগ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের দিকে প্রবাহিত করে। সেই চেতনাই ক্রমে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত অগ্নিতে দীপ্ত গীত হয়ে ওঠে।
নজরুলের সাহিত্যপ্রতিভা, দেশপ্রেমের উন্মেষকালে মুজফ্ফর আহ্মদের মতো একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি হিন্দু বা মুসলমান ছিলেন না, সর্বহারার অধিকারকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে সর্বাংশে আত্মনিবেদিত এক অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বস্তুত সেদিনের বাংলায় মুজফ্ফর আহ্মদের সমতুল্য অসাম্প্রদায়িক একজন ব্যক্তিত্বও কি হিন্দু, কি মুসলমান রাজনৈতিক নেতাদের ভিতরে ছিলেন না। শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থরক্ষার রাজনৈতিক একটি হাতিয়ার হিসেবেই কাকাবাবুর সামনে তখন সংকল্প একটি পত্রিকা প্রকাশের।
এই পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে মুজফ্ফর আহ্মদের সব থেকে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হলেন নজরুল। অভিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে কাকাবাবু পেলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে। ফজলুল হক সেলসওয়ার্সি এবং মঈনুদ্দিন হোসাইন (নূর লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা, মনীষী রেজাউল করীমের অগ্রজ)-কেও পেলেন কাকাবাবু। অর্থ সাহায্যে এগিয়ে এলেন আর এক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব এ কে ফজলুল হক।
‘নবযুগ’ পত্রিকা প্রথম থেকেই জমে গেল নজরুলের দেওয়া অসামান্য শিরোনামগুলির জন্যে। বাস্তবতা আর আবেগের সন্মিলনে নজরুল প্রথম থেকেই ‘নবযুগ’কে সমসাময়িক কাগজগুলোর থেকে আলাদা করে ফেললেন পাঠকদের কাছে। কেবল হিন্দুকে বা শুধুমাত্র মুসলমানকে খুশি করবার কোনো বাজারচলতি রীতিতে ‘নবযুগ’ জন্মলগ্ন থেকেই কোনো লেখা ছাপেনি।
ইরাকের সুলতান, ‘ফয়সল’-কে নিয়ে নজরুল একটি অনন্য সাধারণ সংবাদ শিরোনাম লিখলেন নবযুগে। শিরোনামটি এইরকম, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণ সখা ফয়সল হে আমার।’ এই সময়কালে নজরুল তাঁর গদ্য রচনাতে রবীন্দ্রনাথের গানের উদ্ধৃতি খুব বেশি ব্যবহার করতেন। এইরকমই ‘নবযুগে’র কয়েকটি শিরোনাম ছিল, ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ বা, ‘কালো আদমীকে গুলি মারা’, ‘লাট প্রেমিক আলী ইমাম’, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’, ‘ছুঁৎমার্গ’, ‘ধর্ম্মঘট’, ‘বাঙালির ব্যবসাধারী’ ইত্যাদি। ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্যে দায়ী কে’ - নজরুলের এই প্রবন্ধের জেরে ‘নবযুগ’-র জামানত থেকে এক হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এ প্রসঙ্গে ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধে ’৪২ সালের ২রা জুন, অসুস্থতা মারাত্মক হওয়ার (৯ জুলাই ’৪২, তিনি চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন রেডিও স্টেশনে) অল্প আগে নজরুল লিখছেন: ‘‘কী লেখাই লিখলাম, আজ আর তা মনে নেই; কিন্তু পনের দিনের মধ্যেই কাগজের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।’’ (নজরুল রচনাবলী। বাংলা একাদেমি। ঢাকা। চতুর্থ খণ্ড। দ্বিতীয় সংস্করণ। ১৯৯৬। পৃষ্ঠা -৩২)।
‘নবযুগ’র আগে একটা ধর্মীয় সীমানার ভিতরে খুব নিবিড়ভাবে না হলেও, নজরুলের একটা অবস্থান দেখা যায়। মুজফ্ফর আহ্মদের প্রভাবে ‘নবযুগ’র কাল থেকেই সমস্ত রকমের ধর্মীয় সীমানাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হলেন কবি। সেই সময়ে ‘নবযুগ’র একটি সম্পাদকীয়তে তিনি লিখছেন: ‘‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস ক্রিশ্টিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডী কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাই কে ভাই বলিয়া ডাকি’’ (‘নবযুগ’, মূল প্রবন্ধটি যুগবাণী। নজরুল রচনাবলী। ঐ। প্রথম খণ্ড। পৃঃ ৮১১)।
‘নবযুগ’ যে কেবলমাত্র ব্যক্তি নজরুলের জীবনেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল তা নয়। সমসাময়িক বাংলায় একদিকে দেশব্যাপী আরএসএস তৈরির পটভূমি প্রস্তুত-জনিত হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করছে। আর একান্তভাবে শ্রেণিস্বার্থ নির্ভর মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, যার বিকাশে ঢাকার নবাব সেলিমুল্লাহ এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের বড়ো ভূমিকা। সেই গোটা প্রেক্ষিতটির মোকাবিলা করে, অখণ্ড বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিস্তারে মুজফ্ফর আহ্মদ এবং নজরুলের যৌথ উদ্যোগে ‘নবযুগ’ রচনা করেছিল নয়া ইতিহাস। ফজলুল হকের মতো ব্যক্তিত্ব পত্রিকাটি প্রকাশের অল্প কিছুদিন পরেই মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছিলেন: নবযুগে শ্রমিক - কৃষকের কথা লেখা হয়।
১৯২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতাতে লালা লাজপত রাইয়ের সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। ‘নবযুগ’ তখন সাময়িক বন্ধ থাকলেও, পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবেই নজরুল ওই অধিবেশনে ছিলেন। কংগ্রেসের ভিতরটা সেই প্রথম নজরুলের কাছ থেকে দেখা। ‘নবযুগ’ পুনঃপ্রকাশিত হওয়ার আগেই নতুন দেশাত্মবোধক গান রচনা করে, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে সেই গান গাইতে গাইতে মিছিলে হেঁটে কুমিল্লাতে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেন নজরুল।
মুজফ্ফর আহ্মদের মতে, সাধু ভাষায়, খুব তাড়াতাড়ি লেখার বিষয়টি ‘নবযুগ’কে কেন্দ্র করে নজরুল আয়ত্ত করেছিলেন। তাছাড়াও একটি বড়ো খবরকে সংক্ষিপ্ত করে তার সারাংশ কিভাবে পরিবেশন করতে হয়, সেই কৌশলও ‘নবযুগ’র ভিতর দিয়েই পেয়েছিলেন নজরুল - একথা স্পষ্টভাবে লিখে গিয়েছেন কাকাবাবু (কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা- মুজফ্ফর আহ্মদ। এনবিএ। ৮ ম মুদ্রণ। ১৯৯৫। পৃঃ - ৩৩- ৩৪)।
প্রথম পর্যায়ে ‘নবযুগ’ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রচণ্ড আর্থিক সঙ্কটের ফলে ’২০ সালের শেষের দিকেই নজরুল বাধ্য হন ‘নবযুগ’ ছাড়তে। কাকাবাবুও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততার কারণে ইস্তফা দেন সেখান থেকে। প্রথম পর্যায়ে ‘নবযুগ’ ’২০ সালের শেষের দিকেই বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ের ‘নবযুগ’র স্বল্পায়ু জীবন নজরুলকে একদিকে প্রবল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল, অপরদিকে ‘মুসলমান’ সত্তাটিকে আত্মস্থ করে, সেই সত্তাকে সার্বিক মানবসত্তাতে উপনীত করেছিল। এই দ্বিতীয় পর্যায়টি সম্ভবপর হয়েছিল নজরুল আর কাকাবাবুর নিরন্তর সাহচর্যের ফলে।
তিনের দশকের শুরু থেকেই বাংলা তথা ভারত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ক্রমশ আকীর্ণ হয়ে পড়তে থাকে। হিন্দু আর মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির শ্রেণিস্বার্থের তাগিদে উভয় সমাজেরই নিম্নবর্ণের , নিম্নবিত্তের মানুষদের বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। হিন্দু মহাসভা আর মুসলিম লিগের উদ্যোগে ছুঁতোয়নাতায় বাংলার আনাচে-কানাচে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে পড়ে একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সশস্ত্র বিপ্লববাদের ভিতর দিয়ে যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এইদেশ থেকে তাড়ানোর জন্যে জানকবুল লড়াই শুরু করেন, তাঁদের সর্বাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করতে ব্রিটিশের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে হিন্দু আর মুসলিম, উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিই হাতিয়ার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে।
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে কেবল হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির কথাই বলে না নজরুল- কাকাবাবুর ‘নবযুগ’। বলে, মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা। বলে পেটের ভাতের কথা। পরনের কাপড়ের কথা।বলে, গরীব ভায়ারা, তোমরা যদি তোমাদের পোলাপানদের পড়াশুনা না শেখাও, তোমাদের মতো, তোমাদের পিচ্চিগুলোও জাত আর ধর্মের পেষণে চিরকাল বড়লোকের গোলামি করতেই বাধ্য হবে।’’ এই বোধে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবার কাজে ‘নবযুগ’র ভূমিকা ঐতিহাসিক।
‘নবযুগ’ প্রকাশের ঠিক একবছর আগে প্রকাশিত হতে থাকে মুহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত ‘সাওগাত’। বাঙালি সমাজে, আধুনিক বিজ্ঞানমুখী চেতনার বিস্তারে ‘সাওগাত’র অনবদ্য ভূমিকা আছে। সমসাময়িককালে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ থেকে শুরু করে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ বা মুজিবর রহমানের ‘দি মুসলমান’ সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকা বাংলায় আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী, অসাম্প্রদায়িক (যদিও একদম শেষ পর্যায়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গী হয়ে দেশভাগের তীব্র সমর্থক হয়ে ওঠেন) দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছে। নারীর স্বাধিকারের কথা বলেছে। সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন ধারারও তাঁরা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ‘নবযুগ’ যেভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষ মননের সাথেসাথে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে, তেমনটা কিন্তু কেউই বলেনি। কেবল বাংলাতেই নয়, অখণ্ড ভারতে মেহনতি জনতার কথা, শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করার কথা এবং স্বাধীন দেশে সর্বহারার অধিকার কায়েমের কথা ‘নবযুগ’ বলেছে, তেমনটা সমসাময়িককালে আর কোনো পত্রপত্রিকা বলেনি। ভারতে মেহনতি জনতার কথা পত্রপত্রিকার ভিতর দিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে মুজফ্ফর আহম্দ-নজরুলের যৌথ উদ্যোগে ‘নবযুগ’র ভূমিকা এবং অবদান ঐতিহাসিক।
‘নবযুগ’র কালেই শরৎচন্দ্র থেকে কার্ল মার্কস আত্মস্থ করেন নজরুল। এই সময়কালে মার্কসীয় বীক্ষণে তাঁকে উৎসাহিত করতে সবথেকে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন কাকাবাবু। নজরুল সেই সময়ে পাঠ্য তালিকার একটি চিরকুট তৈরি করেন। সেই চিরকুটে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ থেকে হেগেল, কার্ল মার্কস রয়েছেন। এই বিষয়গুলি তাঁর অজানাই থেকে যেত, যদি না, মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁকে সেসব পড়বার পরামর্শ দিতেন - এইকথা মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করে গেছেন নজরুল।
কোনো কোনো অংশ থেকে প্রচার করা হয় যে, ফজলুল হক তাঁর কৃষক প্রজা পার্টির কাগজ বের করা মনস্থ করেন। সেই পর্বেই ‘নবযুগ’ বের হয় এবং কাকাবাবু, নজরুল তার সঙ্গে সংযুক্ত হন। এটি সর্বৈব অসত্য কথা। ‘নবযুগ’ প্রথম পর্যায়ে প্রকাশের কাজে ফজলুল হক আর্থিক সাহায্য করেছিলেন এটি সত্য। তা’বলে তাঁর কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে ‘নবযুগ’র বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না, যতোদিন কাকাবাবু প্রত্যক্ষভাবে ওই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফজলুল হকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কাকাবাবু’র কখনো বিন্দুমাত্র সংযোগ ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে ফজলুল হকের আর্থিক বদান্যতায় ‘নবযুগ’ যখন আবার প্রকাশিত হয়, তখন সেখানে নজরুল চাকরি করেছেন, লিখেছেন। ফজলুল হকের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই নজরুলের কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোরকম সংযোগ বা সম্পর্ক ছিল না।
কেবলমাত্র ভারতের সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই নয়, রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা এবং আগামীর গতিপথ নির্ধারণে ‘নবযুগ’র শতবর্ষ পূর্তিতে পত্রিকাটির প্রকাশের প্রেক্ষিত এবং প্রকাশিত বিষয়বস্তুগুলি ঘিরে আলোচনা, চর্চা একান্ত জরুরি। গোটা ভারত আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষে নীল। এই বিষ উপড়ে ফেলতে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের যে প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতার কথা নজরুল, কাকাবাবু ‘নবযুগ’র মাধ্যমে বলেছিলেন, শতবর্ষ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তা আজ চরম সত্য। সাম্প্রদায়িক শক্তি মেহনতি মানুষের ঐক্যের যাবতীয় কৌশল কিভাবে ভেস্তে দেয় দাঙ্গার ভিতর দিয়ে, অবিশ্বাসের মাধ্যমে - ‘নবযুগ’ তা দেখিয়েছিল। অতীতের সেই প্রেক্ষিতের সার্বিক পর্যালোচনা করেই আমাদের আগামী সংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করতে হবে।