৫৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ১৭ জুলাই ২০২০ / ১ শ্রাবণ ১৪২৭
কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় পার্টির সাংগঠনিক কাজ
কোডিয়ারি বালাকৃষ্ণান
কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচির উদ্বোধন করছেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য এস আর পিল্লাই।
কোভিড ১৯ অতিমারী গোটা পৃথিবী জুড়েই স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত করেছে। ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনসমূহের কার্যকলাপের সামনেও একাধিক চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছে এই অতিমারী। সরকার অতিমারী রুখতে এবং সংক্রমণকে রোধ করতে কোভিড ১৯ প্রোটোকল ফর্মুলা তৈরি করেছে, যার বিভিন্ন বিধি-নিষেধ জনগণকে মেনে চলতে হচ্ছে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মুখে মাস্ক ব্যবহার করা এবং বারবার স্যানিটাইজার এবং সাবান ব্যবহার করা এই প্রোটোকলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বাড়তে থাকা রোগীর সংখ্যার দরুন কোভিড ১৯ প্রোটোকল পুনরায় গুরুত্বের সঙ্গে চালু করতে হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো, এই অতিমারীর ভয়াবহ পর্বের সময়কালকে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পুঁজিপতিমুখী আর্থিক নীতিসমূহ কার্যকর করার জন্য "সুবর্ণ সুযোগ" হিসেবে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছে। তাদের কর্মসূচির প্রয়োজনীয় অ্যাজেন্ডাগুলিকে কার্যকর করার জন্য তারা চেষ্টা করছে। এই কেন্দ্রীয় সরকার দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে এবং রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে চলেছে। এর পাশাপাশি পেট্রোলিয়াম পণ্য সহ জীবন-জীবিকার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করেছে এই কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি শ্রমিকশ্রেণির বুনিয়াদি সমস্ত অধিকার, যা দীর্ঘ এবং ব্যাপক লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত, তা নানা নয়া আইন এবং অর্ডিন্যান্সের মধ্য দিয়ে খর্ব করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির জেরে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ব্যাপক ক্ষুব্ধ।
অতিমারীজনিত পরিস্থিতিতে জনগণকে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি এবং গণসংগঠনগুলিকে বহু সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পার্টির কেরালা ইউনিটের পক্ষ থেকে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য কোভিড ১৯ প্রোটোকল-কে ব্যাহত না করে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সময়কালে এই অতিমারীর থেকে মানুষকে রক্ষা করাই পার্টির মুখ্য বিষয়। পার্টির পক্ষ থেকে রাজ্যের সরকারকে ভাইরাস সংক্রমণ না ছড়ানোর জন্য সার্বিক সমর্থন এবং সহযোগিতা করা হয়েছে। রাজ্যের সাধারণ মানুষ এবং সরকারকে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে সাহায্য করার ক্ষেত্রে পার্টি সর্বাগ্রে থেকেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করার পর রাজ্যের অতিথি শ্রমিকদের জন্য থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করার সুবিশাল বিষয়টি রাজ্যের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসে। কিন্তু রাজ্য সরকার সেই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে এবং নিখরচায় ওই অতিথি শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সহ এমনকি তাদের মাখন এবং দুধ জোগান দেবার ব্যবস্থা করতেও সমর্থ হয়। রাজ্যের গ্রাম এবং শহরের বিভিন্ন অসমতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১,০০০ টিরও বেশি কমিউনিটি রান্নাঘর চালু করতে সমর্থ হয় রাজ্য সরকার। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থাগুলির কমিউনিটি কিচেন-এর ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয় যেখানে সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে যথেষ্ট সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করতে এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য যুক্ত হন। পার্টি কর্মীরা সরকারের ওপর বাড়তি কোনো আর্থিক বোঝা না চাপিয়ে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। পার্টির স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে তা বিপন্ন মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছেন। আরেকটি মুখ্য চ্যালেঞ্জ হলো অতিথি শ্রমিকদের থাকার বিষয়টি। স্থানীয় পৌরসভা পঞ্চায়েত ইত্যাদির মাধ্যমে উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় তা সমাধা করা গেছে। রাজ্যের বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করার জন্য পার্টি একটি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় কেরালার পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একটি রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকার কিভাবে সরকার এবং জনগণের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে কাজ করে কেরালা সেই শিক্ষা দেয় আমাদের। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা, স্যানিটাইজার এবং সাবান ব্যবহার করার মতো বিষয়গুলিকে মূল আলোচ্য করে শ্রেণি এবং গণসংগঠনগুলি নিবিড় প্রচার চালায় জনগণের মধ্যে। রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয় ওই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। শহরাঞ্চলে যৌথভাবে এ সমস্ত কাজ করা হয়েছে। অতিমারীর বিরুদ্ধে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণের গুরুত্বের বার্তা পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলি প্রশংসনীয় কাজ করেছে।
পার্টি উপলব্ধি করে যে, কোভিড ১৯ রোগ সংক্রমণ রুখতে গেলে ব্যাপক পরিমাণ আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে পার্টির পক্ষ থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে (সিএমডিআরএফ) আর্থিক সাহায্য প্রদানের আহ্বান জানানো হয়। পার্টি কর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীরা মোট ৫০ কোটি টাকা আর্থিক সাহায্য তুলে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করেন। এছাড়াও পার্টির শ্রেণি এবং গণ সংগঠনসমূহ বিভিন্ন ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে সরকারের তহবিলে জমা করেন। তার একটি উদাহরণ হিসেবে শিক্ষা বিভাগের একটি উদ্যোগের কথা বলা যায়। সাধারণ শিক্ষা দপ্তর ছাত্রদের জন্য বিকাশ টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে অনলাইনে পড়াশুনোর একটি বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাস্তবে দেখা যায়, বেশ কিছু ছাত্র, যাদের টেলিভিশন, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোন নেই, যা অনলাইন পড়াশোনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজন, তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তখন সংগঠনের পক্ষ থেকে গরিব পরিবারগুলির জন্য টিভি জোগাড় করার উদ্যোগ নেওয়া হয় যা টিভি চ্যালেঞ্জ কর্মসূচি হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে। এরপর ভালো সংখ্যক টিভি সেট কিনে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সার্বিক বিদ্যুদয়ন রাজ্যজুড়ে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে সহায়তা দেয়। টিভি চ্যালেঞ্জ প্রচার কর্মসূচি সফল করতে ছাত্র যুব মহিলা এবং ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ব্যাপক পরিমাণে সহায়তা দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে পার্টির পক্ষ থেকে পার্টিকর্মী, শ্রেণি এবং গণসংগঠনগুলিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, জনসংযোগ এবং প্রচারের ক্ষেত্রে অবহেলা করা যাবে না। এই সময় বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতি সমূহের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার প্রশ্ন উঠে আসে। এই সময় শ্রমিক শ্রেণির সংগঠন সমূহের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কর্মপদ্ধতির পাশাপাশি প্রচার ও জনসংযোগের একটি নতুন সাংগঠনিক পদ্ধতি যুক্ত করা হয়। পলিট ব্যুরোর মিটিং এর মতো ১২ জুন অনলাইনে পার্টির রাজ্য কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং কোভিড ১৯ জনিত পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম হয়। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতিসমূহ সম্পর্কে জনগণকে দ্রুত সংগঠিত করবার প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যদিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পার্টিকর্মীদের মাধ্যমে গণ রাজনৈতিক শিক্ষার কথা আলোচিত হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্য এই দুটি বিষয়কে কিছুতেই উপেক্ষা করা যাবেনা।
সভায় পার্টির রাজনৈতিক প্রচারকে উন্নীত করার জন্য রাজ্য কমিটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-কে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমাদের পার্টির ইতিহাসে এই প্রথম পলিট ব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত সমূহ অনলাইনে পেশ করেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এস রামচন্দ্রন পিল্লাই। এই বোঝাপড়া অনুযায়ী, সুবিশাল সংখ্যক কমরেড, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, তাঁরা ডিজিটাল প্লাটফর্ম-এ প্রচুর পোস্টার বানিয়ে প্রচার করেন। গত ১৬ জুন কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রামে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেন। এই বিষয়টি পরিচালিত হয় প্রতিটি শাখা এলাকায় পাঁচটি বা তার বেশি সংখ্যক কেন্দ্রে। প্রতিটি পয়েন্টে পাঁচ থেকে দশ জন কমরেড ফেস্টুন প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেন। গোটা রাজ্যে সর্বমোট দশ লক্ষেরও বেশি কমরেড কোভিড ১৯ প্রোটোকল মেনে যেভাবে এই সংগ্রামে শৃঙ্খলার সঙ্গে অংশ নিয়েছেন তা সবার কাছেই নিদর্শন হিসেবে আকর্ষণীয়। পেট্রোল এবং ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে গত ২৫ জুন বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত হয়। কেন্দ্রের নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের গভীরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সংগঠনের পক্ষ থেকে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে যে প্রচার চালানো হয়েছিল তা এই বিক্ষোভ সমাবেশগুলোতে ব্যাপক ভাবে কাজে লাগে।
অতিমারীর দরুণ পার্টিকর্মী এবং জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার বিষয়টি ব্যাহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পার্টির পক্ষ থেকে অনলাইনে সাধারণের জন্য ধারাবাহিক গণ রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই কর্মসূচির প্রথম ধাপ হিসেবে ‘আমরা ঐক্যবদ্ধ’ শীর্ষক প্রচার শুরু হয়। পার্টি কমরেডদের মধ্যে এই বিষয়টিতে ভালো সাড়া লক্ষ করা গেছে। প্রতি সোম বার ফেসবুক-এ এই কর্মসূচি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। শাখা পর্যায়ে পার্টির সমর্থক-দরদিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজ্যের অধিকাংশ শাখাসমূহে অনলাইন মিটিং সংগঠিত করা হয়েছে। এটি একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ, যা কোভিড-১৯-এর এই কঠিন সময়ে সংগঠিত হয়েছে। মার্কসবাদের বুনিয়াদি বিষয়গুলি সম্পর্কে পার্টি সদস্যদের শিক্ষার জন্য পার্টির শিক্ষা সাবকমিটি আটটি ক্লাসের পরিকল্পনা করে। এই পর্বে “মার্কসবাদের গুরুত্ব” বিষয়ে একটি ক্লাস নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিক্ষাক্রমের উদ্বোধন করেন এস রামচন্দ্রন পিল্লাই। প্রতি শনিবার এই ক্লাস হবে। পার্টি শাখাসমূহের বিভিন্ন কেন্দ্রে এই ক্লাস সম্প্রচারের জন্য স্মার্ট টিভি সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পার্টি সংগঠনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের বিকল্প হিসেবে এই অনলাইন হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। অতএব একটি কমিউনিস্ট পার্টি, এবং তার শ্রেণি এবং গণসংগঠনসমূহের এই উদ্যোগকে আমাদের সংগ্রামের জন্য গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করতে হবে। এখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শ্রমিকশ্রেনির সামনে এই চ্যালেঞ্জগুলি নিজে থেকেই সুযোগ এনে দিয়েছে। শ্রমিকশ্রেণির অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি, এই সমস্ত চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে জয়ী হবে।