৫৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ১৭ জুলাই ২০২০ / ১ শ্রাবণ ১৪২৭
বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা এবং কোভিড মোকাবিলা
ঈশিতা মুখার্জি
বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা - কথাটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে। এই বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার অন্তর্গত ছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত এবং পুরপ্রশাসন। দেশে বামফ্রন্ট সরকার যেখানেই প্রশাসনে আছে কিংবা ছিল, সেখানেই এই ব্যবস্থা উন্নত ছিল। ১৯৮০-র দশকে এই ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা ও বিতর্ক-প্রতর্ক শুরু হয়। আঞ্চলিক প্রশাসন এবং বিকেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক নীতির ফল সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনর পদ্ধতি হলো এই স্থানীয় প্রশাসন। সাধারণ মানুষের কাছে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে যাওয়া এবং এই পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করানোর মাধ্যমেই রূপায়িত হয় মানুষের অর্থনীতি। স্থানীয় প্রশাসনের অর্থ বিকেন্দ্রীভূত গণতন্ত্রের আধারে অর্থনৈতিক নীতির রূপায়ণ। এই নীতির মধ্যে পড়ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দের বণ্টন। এই সব আলোচনার বর্তমান কোভিড পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। কোভিড মোকাবিলায় প্রয়োজন বাজেটের বরাদ্দ আঞ্চলিকস্তরে পৌঁছনর জন্য শক্তিশালী এবং কার্যকরী আঞ্চলিক প্রশাসন। আমাদের দেশে এক্ষেত্রে একমাত্র পরীক্ষিত ব্যবস্থা হলো বামফ্রন্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরাতে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা ব্যবস্থা।
কুডুম্বশ্রীর স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা বাড়ি তৈরি করছেন।
কেরালায় কোভিড মোকাবিলায় সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী শৈলজা জানিয়েছেন যে, রাজ্যের বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা চালু থাকার ফলে তাঁদের পক্ষে অতিমারীকে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সংবিধানের দ্বাদশতম তপশিল অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য, সামাজিক ও আর্থিক পরিকল্পনা রূপায়ণ, বস্তি উন্নয়ন সহ আরও অনেক কর্মসূচি নগরের আঞ্চলিক প্রশাসনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা। কেরালা নগর ও গ্রামোন্নয়নে এই কাজটি সফলভাবে করার ফলেই কোভিড মোকাবিলাতেও সাফল্য আনতে পেরেছে। কোভিড জনস্বাস্থ্যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতার কথা সকলের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে। এর সাথেসাথেই বিকেন্দ্রীভূত নগর ও গ্রামোন্নয়নের প্রশ্নটিও সামনে নিয়ে এসেছে। ১৯৯৪ সালে কেরালা ৭৪তম সংবিধান সংশোধন অনুযায়ী নগরের প্রশাসনকে এই বিকেন্দ্রীকরণ অনুযায়ী ঢেলে সাজাল। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। নগরগুলিতে এলো স্বায়ত্তশাসন। তৈরি হলো আঞ্চলিক উন্নয়ন সমিতি, কমিউনিটি উন্নয়ন সমিতি ইত্যাদি যেখানে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের অর্থ এবং পরিকল্পনা মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। কুডুম্ব শ্রী প্রকল্পে যুক্ত হলো বহু মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী, যা সারা বিশ্বের কাছে নজির হয়ে গেল। গ্রামোন্নয়নে সহায়তা করল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। নগরে ওয়ার্ডসভা থেকে জেলাস্তরে ছয়টি ধাপে মানুষের কথা চলে যায় উপরের প্রশাসনিক স্তরে। এইরকম এক ব্যবস্থায় কোভিড মোকাবিলা করার সময়ে বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়নই কেরালার সহায় হলো। একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বাম সরকারই এইভাবে মানুষের ক্ষমতায় আস্থা রাখতে পারে। কেরালায় জেলাপরিকল্পনা পর্ষদে ওয়ার্ডের ২জন কাউন্সিলরের প্রতিনিধিত্ব থাকে। এইভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রূপায়িত হয়। বিভিন্ন রাজ্যের ২১টি শহর নিয়ে এক জাতীয় সমীক্ষা এই তথ্য জানাচ্ছে। মাত্র কয়েকটি শহর আছে যেখানে এই নিচু তলা পর্যন্ত ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া রয়েছে। অবশ্যই বর্তমানে কেরালায় রয়েছে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে এই ব্যবস্থা চালু নেই।
কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা।
এই ব্যবস্থার জন্যই কোভিড মোকাবিলা সুশৃঙ্খলভাবে করা কেরালায় সম্ভব হয়েছে। কোভিড অতিমারীর সময়ে কুডুম্ব শ্রীর স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিটি কিচেনের দায়িত্ব নিল। কোভিড আমাদের চোখের সামনে জনস্বাস্থ্যের দুটি দিক নিয়ে এসেছে। এক, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করার দাবি। দুই, জনস্বাস্থ্য প্রকল্প কার্যকরী করার দাবি। এটা আজ প্রমাণিত যে, নয়া- উদারীকরণ যে পথে দেশকে নিয়ে গেছে তাতে এই দুটি প্রশ্নেই দেশের সরকার ব্যর্থ। দেশের সরকার যদি এই দুটি প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিত, তাহলে আমাদের দেশে কোভিড মোকাবিলা সুশৃঙ্খলভাবে হতো। এই পরিণতি হতো না এত বড় দেশের। বেহাল সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র সর্বত্র। সেখানে এই মুহূর্তে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একমাত্র সরকার রয়েছে কেরালায়, সেখানে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের খেয়াল, তত্ত্বাবধান করছে রাজ্য সরকার। অন্য রাজ্যে এমন ঘটার সম্ভাবনা নেই, তাই কেরালা মডেল। রাজ্য অর্থনীতি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চালনা করে। এই বিভিন্নতার দেশে রাজ্যগুলির সম্পদ বিভিন্ন, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিও বিভিন্ন। সংবিধানের ৭৪তম সংশোধন আপনা আপনি আসেনি। এর একটি ইতিহাস আছে। কিন্তু এই সংশোধন কার্যকর করতে উদ্যোগী হলো একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চালিত পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরা সরকার। গ্রাম ও নগরে উন্নয়নের কর্মসূচি মানুষের অংশগ্রহণে এই সব রাজ্যেই চালু হলো।
উল্লেখযোগ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতা। গ্রামে ভূমিসংস্কার দিয়ে এই কর্মকাণ্ড শুরু। সাথে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এলো কৃষিতে সাফল্য। পুর প্রশাসন এবং নগরোন্নয়নে এলো বিকেন্দ্রীকরণ। শহরে বস্তি উন্নয়ন অন্যমাত্রায় দেখা হলো। রাজ্য পরিকল্পনা পর্ষদ, জেলা পরিকল্পনা পর্ষদ এবং আঞ্চলিক প্রশাসনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ চলল। বামফ্রন্ট সরকারের পরবর্তী পর্যায়ে কৃষির ভিত্তিতে শিল্প স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। স্বনির্ভর গোষ্ঠী একের পর এক চালু হতে শুরু করল। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে দেশের মধ্যে রাজ্য চলে এলো এক নম্বরে। দারিদ্র্য কমল রাজ্যে এবং সাধারণ গরিব মানুষের হাতে টাকা এলো। কিন্তু এই অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিকল্পনা বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনাতেও এগিয়ে ছিল বামফ্রন্ট। তখন সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা করাতেন ৮০ শতাংশ রুগী। সেই সরকার এই পরিষেবাকেও যথেষ্ট নয় বলে বারবার জানিয়েছিল। কিন্তু জেলায় জেলায়, অঞ্চলে অঞ্চলে, গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকেই তখন ব্যবহার করা হতো। পুরুলিয়াতে জেলা হাসপাতালে নবজাতকদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য নতুন মডেল তৈরি হয়েছিল, যার ফলে শিশুমৃত্যুর হার এ রাজ্যে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। সারাদেশে কেন, বিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছিল এই মডেল। এই ছিল বামফ্রন্টের জনস্বাস্থ্য নীতি। সরকারর জনস্বাস্থ্য নীতিতে রাজ্যের মানুষের প্রত্যাশা ছিল। ফলে অনেকক্ষেত্রে সেই প্রত্যাশা না মেটার কথাও শোনা যেত সমালোচনার সুরে। বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারের স্বাস্থ্যবাবদ বাজেট বরাদ্দ চলে আসত মানুষের কাছে। কিন্তু কি হলো ২০১১ সালের পর?
২০১১ সালের পর থেকে মানুষের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া শুরু হলো। ক্ষমতাকাড়া হলো পঞ্চায়েতের, পুরসভার; উঠে গেল গ্রামসভা, ওয়ার্ড কমিটি। মানুষের থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কেন্দ্রীভূত প্রশাসন চালু হলো। বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা খাতায়কলমে থাকলেও আসলে এখানে চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ থেকে একমাত্রিক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম হলো। মানুষের অভাব অভিযোগের খোঁজ যেখানে রাখা হলো না, সেখানে আঞ্চলিকভাবে কোভিড মোকাবিলা কি করে হবে? কেন আমফানের ত্রাণের টাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়? কেন দুর্নীতির জন্ম হলো এখানে? বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা উলটে দিয়ে যেদিন স্বৈরাচার চালু হলো, সেদিন থেকেই দুর্নীতি বাধাহীন ও ব্যাপক হয়ে গেল। কাউন্সিলর আর প্রধানদের সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বাড়ল আর যদি সেই দুরত্ব কমেও যায়, কাউন্সিলর ও প্রধানদের কথা পৌঁছল না জেলা পরিকল্পনা পর্ষদের কাছে এবং শেষমেশ স্বৈরাচারীর কাছে। মানুষ ব্রাত্য রইল। এই ব্যবস্থায় এ রাজ্যে কোভিড মোকাবিলা কোনমতেই সম্ভব নয়, হয়ও নি। যদি আজ ২০১১ সালের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি থাকত, তাহলে তাদের মাধ্যমেই কমিউনিটি কিচেন সরকারই চালাতে পারত। কেরালার মতো মানুষ সাহায্যের হাত বাড়াত, তারা স্বর্নির্ভর গোষ্ঠীকেই তা দিত। সরকারেরই চালানোর কথা কমিউনিটি কিচেন। কমিউনিস্ট পার্টি পৃথিবীর সর্বত্র এই কিচেন চালাচ্ছে এবং রিলিফের কাজ করছে। এটি তাদের রাজনীতি। ক্ষমতায় থাকলে এই রাজনীতিই অর্থনীতি চালনা করে। চালু হয় বিকেন্দ্রীভূত অর্থনীতি এবং মানুষের হাতে ক্ষমতা চলে আসা।
এটাই কি তাই স্বাভাবিক নয় যে, কোভিড মোকাবিলায় কেরালা আর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকবে? কোভিড মোকাবিলা প্রমাণ করছে অর্থনীতির প্রশ্নে লড়াইটা স্বৈরাচার বনাম বিকেন্দ্রীকরণ।