৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির হীন চক্রান্ত ব্যর্থ করে অন্যায়ের যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সিপিআই(এম)’র আহ্বান
বামফ্রন্টের ডাকে বহরমপুরে সম্প্রীতি মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ হজরত মহম্মদ সম্পর্কে বিজেপি নেত্রী তথা মুখপাত্র নূপুর শর্মা এবং অপর মুখপাত্র নবীন জিন্দালের অবমাননাকর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও সম্প্রতি অবরোধ, বিক্ষোভসহ বিদ্বেষের আগুনে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। বিশেষকরে হাওড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তীব্র হাঙ্গামা ও বিক্ষোভে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে নানা দিকে। এছাড়া মুর্শিদাবাদ, নদীয়াতেও অশান্তি ছড়িয়েছে।
হজরত মহম্মদ সম্পর্কে বিজেপি’র দুই মুখপাত্রের অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু হয়। কোথাও কোথাও এই বিক্ষোভ হিংসার আকার নেয়। এই পরিস্থিতিতে শান্তির আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বিজেপি’র দুই নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী বিভিন্ন দল ও সংগঠন।
১১ জুন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে দেশজুড়ে হিংসাশ্রয়ী ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, হজরত মহম্মদকে নিয়ে বিজেপি’র দুই নেতা-নেত্রীর কুরুচিকর মন্তব্যের জেরে রাঁচি, হাওড়া সহ দেশের নানাপ্রান্তে বিক্ষোভ প্রদর্শন কোথাও কোথাও হিংসাত্মক আকার নেয়। অবশ্য এই উসকানিমূলক এবং অপমানকর মন্তব্যে ক্ষোভ হওয়া যুক্তিসঙ্গত। তাও এই ধরনের হিংসাত্মক প্রতিবাদকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক শক্তি পরিস্থিতিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তোলে। এই কারণেই জনগণকে সংযত এবং শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানায় সিপিআই(এম)।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুঃখের বিষয় হলো, দিল্লি পুলিশের দাখিল করা দুটি এফআইআর-এ শুধুমাত্র বিজেপি’র ওই দুই নেতা-নেত্রী নন, রয়েছে আরও ৩০ জনের নাম। যার মধ্যে একজন সাংবাদিক রয়েছেন, যিনি কোনোভাবেই ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন। এই দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া পদক্ষেপের অর্থই হলো, বিজেপি’র ওই দুই প্রাক্তন মুখপাত্রের অপরাধের গভীরতাকে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা। এ কারণেই ওই দুই প্রাক্তন মুখপাত্রের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পৃথকভাবে আইনি পথে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।
সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি শান্তি বজায় রাখা এবং সংযত থাকার আবেদন জানিয়ে ট্যুইটে বলেছেন, যারা ওই ধরনের উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন তাদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি ঘৃণার ভাষণ ও হিংসার অবসান হওয়া উচিত। নেতাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং বিবৃতি নিন্দনীয়। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, আরও জঘন্য বিষয় হলো এই ধরনের বিভেদকামী ও অপরাধমূলক আচরণ যে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং আইনি পথে তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে - বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে এমন কোনো আশ্বাস মিললো না।
ঘটনাক্রমে প্রকাশিত হয়েছে, হজরত মহম্মদ ও মুসলিমদের সম্পর্কে কটু মন্তব্যের জেরে দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্য সহ ১৫টির বেশি দেশ কেবল অসন্তোষ প্রকাশ করাই নয়, কেউ কেউ অর্থনৈতিক অবরোধেরও ডাক দেয়। বিজেপি’র দুই মুখপাত্রের মন্তব্যের জেরে উদ্বেগ প্রকাশ করে কুয়েত, কাতার, ওমান, ইরান সহ ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, বাহরিন, আরব আমিরশাহি, মালদ্বীপ, জর্ডন, আফগানিস্তান, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং ইরাকের মতো দেশ বলেছে, এভাবে কোনও ধর্মগুরুকে অবমাননা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকেও স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতাই কাম্য।
এই অবস্থা সামাল দিতে বিজেপি দলের জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে সাসপেন্ড করে এবং বহিষ্কার করে দলের দিল্লির মিডিয়া প্রধান নবীন কুমার জিন্দালকে। কিন্তু তবুও অবস্থা সামাল দেওয়া যায়নি। উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, জম্মু, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, প্রভৃতি রাজ্যে ক্ষোভ, বিক্ষোভ সহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। আরও জঘন্য ঘটনা হলো উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরে, এলাহাবাদে যাঁরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছে যোগী সরকার। এরফলে ক্ষোভ আরও চরমে ওঠে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যখন অশান্তি, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ঘটতে থাকে তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে একটি কথাও বলতে শোনা যায়নি, অথবা তিনি বিজেপি মুখপাত্রদের কু-মন্তব্যের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি। ৯ জুন হাওড়ায় জাতীয় সড়ক ১১ ঘণ্টা অবরোধ থাকার পর নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জ বিজেপি নেত্রীকে গ্রেপ্তারের দাবি করে ট্যুইট করেন, এরপর সাংবাদিক বৈঠক করে বলে দেন, আমরা রাজ্যে অবরোধ করতে দিইনা। আন্দোলন করতে হলে দিল্লিতে গিয়ে করো। আগে অবরোধ দু’এক জায়গায় থাকলেও সাংবাদিক বৈঠকের পরদিন থেকে অবরোধ ছড়িয়ে পড়ে বহু জায়গায়। অবরোধ জাতীয় সড়ক থেকে ছড়িয়ে পড়ে রেলপথেও। হাওড়ায় জাতীয় সড়কের ওপর ধুলাগোড়ি, সলপে অবরোধ, পুলিশের গাড়ি ভাঙা হয়, পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় ইট, বোমা। ডোমজুড়ে থানা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এমনকী উলুবেড়িয়া মহকুমা শাসকের দপ্তরেও হামলা চালায় ক্ষুব্ধ মানুষ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য হাওড়ার গ্রাম ও শহর এলাকায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে জাতীয় সড়ক অবরোধের ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় বেলডাঙা, রেজিনগর ও শক্তিপুর থানা এলাকায়ও ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে প্রশাসন।
এদিকে হাওড়া জেলার গ্রামীণ ও শহর এলাকায় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যর্থতা দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয় হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ সুপার ও হাওড়ার পুলিশ কমিশনারকে। পুলিশের দুই শীর্ষ কর্তার বদলি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ট্রান্সফার কোনো শাস্তি নয়। এক জায়গার আপদ অন্য জায়গায় গিয়ে বিপদ হিসাবে দেখা দেবে।
হাওড়ার বিভিন্ন এলাকার এই অশান্তির কারণে পুলিশ অনেক মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে।
হাওড়া জেলার পাশাপাশি নদীয়া জেলার বেথুয়াডহরীতেও উত্তেজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। ১২ জুন বিকালে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল করে এসে বেথুয়াডহরী বাজারে বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভের ফলে আশেপাশে এবং রেলস্টেশনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেসে ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। এই ঘটনার জেরে প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়।
এদিকে ১২ জুন মুর্শিদাবাদ, নদীয়া জেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে মিছিল করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে সিপিআই(এম) জেলা দপ্তরের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়ে রানিবাগান, কাদাই, গির্জার মোড় হয়ে মিছিল শেষ হয় পার্টির জেলা দপ্তরের সামনে। এই মিছিল থেকে নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। মিছিলে অংশ নেন সিপিআই(এম)’র জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা, সিপিআই নেতা হারাধন দাস, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা ভবেশ মণ্ডল সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এদিন শান্তি-সম্প্রীতির আবেদন জানিয়ে ডোমকলেও মিছিল হয়েছে।
শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে হাওড়ায় সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে মিছিল করার পরিকল্পনা থাকলেও ১৪৪ ধারা জারি থাকার জন্য মিছিল করা যায়নি। নদীয়া জেলার কয়েকটি জায়গায় শান্তি সম্প্রীতির আবেদন জানিয়ে মিছিল হয়েছে।
এই সামগ্রিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ১১ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ-প্রশাসন হিংসা ও অশান্তি রুখতে ব্যর্থ হয়েছে। উলটে নবান্নে বসে সংখ্যালঘু মানুষের প্রতিবাদের অধিকারকে অস্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই উসকানি দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, সারা দেশে দমবন্ধকর অবস্থায় রয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। অথচ মুখ্যমন্ত্রী সব জেনেও পক্ষকাল ধরে চুপ করে বসেছিলেন নবান্নে। হিংসা ও অশান্তি সৃষ্টি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার মানুষের রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি বজায় রেখে সবাইকে একসঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। শান্তিপুর্ণ প্রতিবাদের অধিকারকে মুখ্যমন্ত্রী কেড়ে নিতে পারবেন না।
মহম্মদ সেলিম প্রশ্ন তোলেন, পক্ষকাল ধরে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগ ছড়ালেও মুখ্যমন্ত্রী চুপ করে বসে ছিলেন কেন? কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন যদি প্রতিবাদ করতে পারেন, তাহলে মমতা ব্যানার্জি চুপ করে বসেছিলেন কার স্বার্থে? কোন অধিকারে মুখ্যমন্ত্রী ‘ইমামদের ভাতা দিই’ তাই মুখ বন্ধ রাখতে হবে বলে অপমান করেন? কেন রাজ্যের প্রতিবাদীদের দিল্লি গিয়ে প্রতিবাদ দেখাতে বলেছেন?
তিনি রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের ধারাবাহিক উদ্বেগ ও আতঙ্কের কথা উল্লেখ করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এবং প্রতিবাদ যাতে কোনোরকম হিংসার আশ্রয় নিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি’র স্বার্থে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরিতে সাহায্য না করে সেদিকে নজর রাখার কথাও উল্লেখ করেন।
উত্তরপ্রদেশে, কানপুরে, এলাহাবাদে সংখ্যালঘু মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নামতেই পুলিশের ধরপাকড় এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, আইন, পুলিশি প্রোটোকল কিছু না মেনে বিজেপি’র বুলডোজার রাজনীতির উগ্র চেহারায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, একদিকে সংখ্যালঘুরা বিজেপি’র বুলডোজার রাজনীতিতে আতঙ্কিত, অন্যদিকে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে এখন ‘ইসলামো ফোবিয়া’ রটানো হচ্ছে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, হিন্দুত্ববাদীদের প্রজেক্ট। আমরা বামপন্থীরা বলছি হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে একসঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রেখে সম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, জনজীবনের ওপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের যে ইতিহাস, তাকে ম্লান হতে দেবেন না।