৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচন
যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে
মাটিগাড়া জিপি’র ১৯ নং আসনে সিপিআই(এম) প্রার্থী রিম্পা মোহান্তকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচার।
ছবিঃ রাজু ভট্টাচার্য
আগামী ২৬ জুন শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচন জনগণের অর্জিত অধিকার রক্ষার পাশাপাশি শিলিগুড়ি গ্রামীণ জনতার উন্নয়ন ও গণতন্ত্র রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম। কেননা এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন সময়ে, যখন আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকার গণতন্ত্র হত্যা, দুর্নীতি ও বিশেষত পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে আমলাতন্ত্র ও শাসকদলের নিয়ন্ত্রণাধীন অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে। আবার সারাদেশে বিপজ্জনকভাবে বিভাজন ও বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, বিজেপি এবং আরএসএস। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নীতির ফলে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। কর্মসংকোচন ও বেকারত্ব ক্রমাগত ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিজেপি সরকারের ‘করপোরেট হিন্দুত্ব’ নীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপজ্জনক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বিজেপি এবং আমাদের রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। এই প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্বাচনী সংগ্রাম সহ সকলস্তরের গণসংগ্রামেরত সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট ও সহযোগীরা। যেকোনো নির্বাচনই নীতির লড়াই - এই প্রেক্ষাপটেই বামফ্রন্ট শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচনে অবতীর্ণ। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসীন হবার পর পঞ্চায়েতগুলির অধিকার হরণ করা ও জবরদখলের যে নগ্ন কার্যক্রম সরকার ও শাসকদল শুরু করে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদও সেই আক্রমণের বাইরে থাকে না - যদিও গণআন্দোলনকে যুক্ত করে বামফ্রন্ট এই আক্রমণকে মোকাবিলা করতে থাকে। জবরদখল পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও মহকুমা পরিষদ, খরিবাড়ি পঞ্চায়েত সমিতিসহ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের বিগত নির্বাচনে বামফ্রন্ট মহকুমা পরিষদ, সবক’টি পঞ্চায়েত সমিতি ও অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে জয়ী হয়। কয়েকটি পঞ্চায়েতে সহযোগী দলের সমর্থন নিয়ে বোর্ড গঠন করতে সক্ষম হয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নির্বাচনের প্রাক্কালে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘শিলিগুড়ি আমার চাই!’’ কিন্তু শিলিগুড়ির মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর এই আদেশনামা ও তৃণমূল কংগ্রেসের হামলা এবং চক্রান্তের কাছে মাথা নত না করে বিজয়ী করেছে বামফ্রন্টকে ও পরাজিত করেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। একইসাথে প্রত্যাখ্যান করেছে বিজেপি-আরএসএস’র বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক জিগিরকেও।
এই পরাজয়ে ক্ষিপ্ত তৃণমূল কংগ্রেস দল ও রাজ্য সরকার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য কার্যত শিলিগুড়ির জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরু করে ভয়ভীতি প্রদর্শন, পুলিশ প্রশাসনকে নগ্নভাবে কাজে লাগানো, এলাকায় এলাকায় ঠিকাদার, তোলাবাজ ও জমি মাফিয়াদের ব্যবহার করে পঞ্চায়েত জবরদখল, দল ভাঙানো, নির্বাচিত বামপন্থী ও তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী পঞ্চায়েত সদস্যদের ও তাঁদের পরিবারের ওপর নানা কায়দায় চাপ দিয়ে পঞ্চায়েত দখলের যে ঘৃণ্য কার্যক্রম তৃণমূল কংগ্রেস শুরু করেছিল তার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানায় সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট। এই প্রতিরোধ আন্দোলনে শিলিগুড়ির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।
পাথরঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের ধুকুরিয়া বস্তিতে সিপিআই(এম)’র মহকুমা পরিষদ প্রার্থী স্বস্তিকা রাম মাহালী, মাটিগাড়া
পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী আশা ওঁরাও এবং পাথরঘাটা জিপি’র প্রার্থী মিনতি রায়কে নিয়ে প্রচার।
ছবিঃ রাজু ভট্টাচার্য
বামফ্রন্ট পরিচালিত শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ যাতে কাজ করতে না পারে তার জন্য শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকার সমস্ত রীতিনীতি, আইন-কানুন জলাঞ্জলি দিয়ে অসহযোগিতা ও বাধা দেবার কাজ চালাতে থাকে। যেহেতু পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান হন সভাধিপতি, তাই জেলায় পরিকল্পনা কমিটি (ডিপিসি) গঠনই করা হলো না। উন্নয়ন সংক্রান্ত সরকারি সভাগুলিতে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের সভাধিপতিকে ডাকাই হতো না। কার্যত সরকারি আধিকারিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের বামপন্থী সভাধিপতিকে গুরুত্ব না দিতে। গণতন্ত্র ও সংবিধানকে লঙ্ঘন করার এ এক নগ্ন দৃষ্টান্ত।
কিন্তু এত প্রতিবন্ধকতা ও অসহযোগিতা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট পরিচালিত শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নজির সৃষ্টিকারী কাজ করেছে জনগণকে সাথে নিয়ে। রাজ্যের অন্যান্য তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েতগুলি যখন দুর্নীতি, ঠিকাদারি, সিন্ডিকেট ও স্বজনপোষণের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, তখন বামফ্রন্ট পরিচালিত শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ কাজ করেছে স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সাথে। বিরোধীরাও কোনো অস্বচ্ছতার অভিযোগ আনতে পারেনি। এই স্বচ্ছতা ও দক্ষতার জন্যই বিশ্বব্যাঙ্ক প্রশংসা করেছে মহকুমা পরিষদকে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রকল্প রূপায়ণেও মহকুমা পরিষদ সারা রাজ্যে প্রথম ও দেশে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন শিলিগুড়ির গ্রামীণ জনগণের কাছে অর্জিত অধিকার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মর্যাদা ও গণতন্ত্র রক্ষার একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবেই উপস্থিত হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্যই বামফ্রন্ট এই নির্বাচনে আহ্বান জানিয়েছে স্বৈরাচারী ও ভ্রষ্টাচারী জনবিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক ও বিভাজন সৃষ্টিকারী জনবিরোধী বিজেপি’র বিরুদ্ধে সমস্ত বামপন্থীদল ও অন্যান্য শক্তি যারা ওই দুই জনবিরোধী শক্তিকে পরাজিত করতে চায়, তাদের সাথে নিয়ে নির্বাচনী সংগ্রামে জয় অর্জন করে জনমুখী, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ, দক্ষ পঞ্চায়েত গঠনের।
আমাদের লক্ষ্য উন্নত গ্রাম গঠন ও নানা ভাষা, সংস্কৃতির বিকাশে অগ্রাধিকার দান। চা বাগান শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবিকে সফল করা, তাদের বাস্তুজমির দাবির পাশে থাকা, কৃষি ও কৃষকের ন্যায্য দাবিগুলির পক্ষে পঞ্চায়েত প্রশাসনকে যুক্ত করা। পরিবেশ সচেতনতার প্রসারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বাতাবরণ অক্ষুণ্ণ রাখা। অনৈক্য ও বিদ্বেষের পরিবেশে কোনো উন্নয়ন হয় না। তার বড়ো প্রমাণ আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য ও আমাদের জেলার বর্তমান অবস্থা। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে তাদের দুর্গতির সময়ে। যেমন আমাদের দাঁড়াতে হয়েছে ‘কোভিড’ পরিস্থিতিতে ‘রেড ভলান্টিয়ার’দের সাথে নিয়ে। যে কাজে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদল দু’টি চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখিয়েছে। এবারের নির্বাচনে এই অভিজ্ঞতাও জনগণের বিচারের মধ্যে থাকবে নিশ্চয়ই।
গণতন্ত্র বিরোধী আরেকটি কথা রাজ্যের শাসকদল বলে চলেছে - তা হলো ‘ডবল ইঞ্জিন’ ব্যবস্থা। অর্থাৎ রাজ্যে যে দলের সরকার পঞ্চায়েত সেই দলেরই হওয়া দরকার। এই বক্তব্যটি তৃণমূল কংগ্রেস ধার নিয়েছে বিজেপি’র থেকে। দুটি দলই আরএসএস অনুপ্রাণিত তো!
কিন্তু এই ডবল ইঞ্জিনের কী হাল তা এখন পদে পদে বুঝতে পারছে শিলিগুড়ি শহরের মানুষ। সাম্প্রতিক নির্বাচনে শিলিগুড়ি পৌর করপোরেশনে নির্বাচনে জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ‘ডবল ইঞ্জিন’ বোর্ড শুধু কোনো কাজই করতে পারছে না তাই নয়, পৌর পরিষেবা শিলিগুড়িতে বিপর্যস্ত!
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ত্রিস্তরের এই নির্বাচন যেমন অর্জিত অধিকার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সংগ্রাম, তেমনই গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি সহ সমস্ত জনবিরোধী দল ও শক্তিকে পরাজিত করে বামফ্রন্ট ও সহযোগীদলগুলিকে বিজয়ী করে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনগণের পঞ্চায়েত গঠনের আহ্বান জানাচ্ছে সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট।