৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতির রাজ্য দশম সম্মেলন
শংকর মুখার্জি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতির রাজ্য সম্মেলন উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন এ আর সিন্ধু।
মা এবং শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সুনিশ্চিতিকরণ এবং আইসিডিএস কর্মী-সহায়িকাদের ন্যূনতম মজুরি, পেনশন ও গ্র্যাচুইটির দাবিতে আন্দোলনকে আরও দুর্বার করার প্রত্যয় নিয়েই সমাপ্ত হলো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতির রাজ্য দশম সম্মেলন। গত ১১-১২ জুন কলকাতার শ্রমিক ভবনে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী নগর এবং কমরেড সুস্মিতা বিশ্বাস ও টগর দে মঞ্চে এই সম্মেলন হয়েছে। সম্মেলনে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি জানানো হয়েছে।
সম্মেলনের উদ্বোধন করেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের সারা ভারত ফেডারেশনের সম্পাদিকা এ আর সিন্ধু। রাজ্যের ২২টি জেলা থেকে ২৭৮ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের জীবনজীবিকা সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবি এবং অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প (আইসিডিএস)-কে বেসরকারিকরণের চেষ্টার বিরুদ্ধে সারা ভারত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের ফেডারেশনের ডাকে আগামী ২৬,২৭ এবং ২৮ জুলাই দিল্লিতে বিক্ষোভ সমাবেশ (মহাপদভ) হবে। ওই কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে সফল করতে সংগঠনের সর্বস্তরে সর্বাঙ্গীণ উদ্যোগ গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়েছে সম্মেলনে। প্রসঙ্গত, রাজ্য সিআইটিইউ’র অন্যতম বৃহৎ ইউনিয়ন হলো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতি। এর সদস্য সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। আবার রাজ্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের মধ্যে সর্ববৃহৎ সংগঠন এটি।
সম্মেলনে উত্থাপিত দাবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের চাকরিতে স্থায়ীকরণ; ন্যূনতম ভাতা ২১ হাজার টাকা, পেনশন ৫ হাজার টাকা; শূন্যপদে নিয়োগ ও পূর্বের ন্যায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র পরিচালনা; প্রতি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পানীয় জল, রান্নার ঘর, শৌচালয় ও স্টোর রুমের ব্যবস্থা; সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সকল কর্মী এবং সহায়িকাদের গ্র্যাচুইটি প্রদান; বাজারদর অনুযায়ী জ্বালানি, ডিম ও সবজির দাম প্রদান প্রভৃতি। এই দাবিগুলি শুধু এই রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, সারাদেশেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা এই দাবিগুলি আদায়ে ধারাবাহিকভাবে লড়াই-আন্দোলন চালাচ্ছেন। সম্মেলনে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেন রত্না দত্ত। সম্মেলনে গৃহীত হয়েছে নটি প্রস্তাব।
● ● ●
স্বাধীনতার ২৮ বছর পর গর্ভবতী ও প্রসূতি মা এবং শিশুদের পুষ্টি ও শিশুদের প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে দেশে এই প্রকল্প চালু হয়। রাজ্যে এই প্রকল্প প্রাণ পায় বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর। এই প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা বলে। এই প্রকল্প এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই দেশ পোলিও মুক্ত হয়েছে। কমেছে শিশুমৃত্যু, প্রসূতি মায়ের মৃত্যু। এমনকী শিশুদের স্কুলমুখী করতেও কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে আইসিডিএস প্রকল্প। এইরকম এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকেই তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার।
উদ্বোধনী ভাষণে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে এ আর সিন্ধু বলেন, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের আন্দোলন-সংগ্রাম দেশের গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ন্যূনতম বেতন, পেনশন, শ্রমিক-কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের যে লড়াই তা শ্রম কোড চালু হলে তার কোনো যৌক্তিকতাই থাকবে না। তাই শ্রম কোডের বিরুদ্ধেও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের লড়াই জারি রাখতে হবে। মোদি ক্ষমতায় এসেই আইসিডিএস’র বরাদ্দ ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৮ হাজার কোটি টাকা করে দিয়েছিল। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা লড়াই করে সেই বরাদ্দ ফিরিয়ে এনেছে। শুধু নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্যই নয়, যাতে এই প্রকল্পে বরাদ্দ বজায় থাকে সেই লক্ষ্যেও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা লড়াই-আন্দোলন চালায়।
এ আর সিন্ধু বলেন, আরএসএস-বিজেপি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্যদিয়ে দেশে ধর্মীয় মেরুকরণকে তীব্র করতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি’র সরকার। কিন্তু সেখানে হিন্দু, মুসলিম - কোনো আইসিডিএস কর্মীরই মজুরি বাড়েনি। ওদের এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুধু ধর্মীয় বিভাজন বৃদ্ধির জন্যই, হিন্দুদের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়। ওরা চায় নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে হিন্দু ও মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে লড়ুক এবং মরুক। আইসিডিএস প্রকল্পে মা-শিশুদের খাবারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ দিচ্ছেনা, অন্যদিকে আম্বানি-আদানিদের সিন্দুক ভরিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ছবছর বয়সের আগেই ভারতে ৭৫ লক্ষ শিশু মারা যায়। দেশের এই পরিস্থিতিতে জরুরি ছিল আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিকে শক্তিশালী করা। সেদিকে তাদের নজর নেই। তারা এখন বলছে, এই কেন্দ্রগুলি দত্তক নিতে পারে এইরকম সক্ষম ব্যক্তি কিংবা সংস্থাকে খুঁজতে হবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরই। আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আইসিডিএস প্রকল্পকে সংকুচিত করা নচেৎ বেসরকারিকরণ করা। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের লড়াই এর বিরুদ্ধেও।
● ● ●
রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ বর্তমানে রাজ্যে ৪১৬টি প্রকল্প চলছে। এখানে কর্মী ও সহায়িকা মিলিয়ে মোট প্রায় ২ লক্ষ ২২ হাজার জন কাজ করেন। নয়া শিক্ষানীতিতে প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষা এবং শিশুদের খাবার প্রদানের বিষয়টা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জুড়ে দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই দুটি বিষয় আইসিডিএস প্রকল্প থেকে বিযুক্ত হলে এই প্রকল্পের আর কোনো গুরুত্বই থাকবে না। তখন এই প্রকল্প তুলে দেওয়া অনেক সহজ হবে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে।
লকডাউনের সময় আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিও বন্ধ হয়ে যায়। তখন গর্ভবতী মা ও প্রসূতি মায়েদের জন্য প্রতি মাসে দু কিলো চাল ও দু কিলো আলু এবং ৩০০ গ্রাম ডাল দেওয়া শুরু হয়। তাও আলু এক এক জেলায় একেক পরিমাণ দেওয়া হতো। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আবার খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে যায় বিধানসভা নির্বাচনের জন্য। নির্বাচনের পর মে মাসে মুখ্যমন্ত্রীকে খাবার চালুর দাবিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়, তারপর আবার খাবার পেতে থাকেন মা ও শিশুরা। যদিও এখন আবার খাবার ৪ মাস বকেয়া পড়ে আছে।
কোভিডের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষার কাজ করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে এরাজ্যে ১৩ জন কর্মী ও সহায়িকা মারা গেছেন। অসংখ্য জন অসুস্থ হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এদের আর্থিক সাহায্য করার কথা ছিল। কিছুই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে সংশোধিত প্রকল্পের নামে ৮টি রাজ্যে মিনি আইসিডিএস প্রকল্প চালু করেছে। যেখানে খাদ্য সরবরাহ ও বিতরণের দায়িত্ব পঞ্চায়েত, এনজিও এমনকী কোনো কোনো রাজ্যে করপোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিলুপ্ত ঘটানো হয়েছে আইসিডিএস কেন্দ্রে সহায়িকা পদটির। পশ্চিমবঙ্গেও এর চেষ্টা হয়েছিল। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এরাজ্যে তা আটকানো গেছে।
● ● ●
সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে যেকোনোভাবে এই প্রকল্পকে সংকুচিত করা এবং বিলুপ্ত ঘটানো। সেই অভিমুখেই তাদের যাবতীয় পদক্ষেপ। এই প্রকল্প বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন গর্ভবতী ও প্রসূতি মা-রা এবং শিশুরা। তাই তাঁদের স্বার্থে এই প্রকল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আন্দোলনের পাশে শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, কৃষক সভার নেতা সঞ্জয় পূততুণ্ড, বস্তি উন্নয়ন সমিতির নেতা সুখরঞ্জন দে, মহিলা নেত্রী কনীনিকা ঘোষ, দীপু দাস, ডিওয়াইএফআই নেতা ধ্রুবজ্যোতি সাহা, এসএফআই নেতা মহম্মদ আতিফ নিসার আলি, সিআইটিইউ নেত্রী মধুমিতা ব্যানার্জি, আশা কর্মী সংগঠনের নেতা অভিজিৎ কোঙার।
● ● ●
রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় জেলার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের আলোচনায় জেলায় জেলায় আইসিডিএস কেন্দ্রগুলির দুরাবস্থার কথা উঠে এসেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, বহু কেন্দ্রেই খাবার ঠিক সময় আসে না। ডিম, আলু এবং জ্বালানির পর্যাপ্ত পয়সাও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় না। আইসিডিএস কেন্দ্র চালু রাখতে এবং মা ও শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে একাজগুলি সম্পাদন করেন। কেন্দ্রগুলিকে সচল রাখেন। একটা উাদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ডিমের দাম ৬-৬.৫০ টাকা হলেও সরকার থেকে ডিম-প্রতি ৫ টাকা করেই দেওয়া হচ্ছে। কেরোসিন তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কিন্তু আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিতে জ্বালানি তেলের জন্য লিটারপ্রতি মাত্র ১৯, ২১ কিংবা ২৩ টাকা করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রগুলিকে চালু রাখতে বাকি টাকা নিজেদের মজুরি থেকে দেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা।
কেন্দ্রীয় সরকার এখন এক নতুন নিয়ম চালু করেছে। ‘পোষণ ট্যাকারে’র মাধ্যমে অনলাইনে আইসিডিএস কেন্দ্রগুলির নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সরকার একাজ করার জন্য কর্মীদের স্মার্ট ফোনেরও ব্যবস্থা করেনি, ইন্টারনেট রিচার্জের পয়সাও দিচ্ছেনা। বহু প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেটের সংযোগও ভালোভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একাজকে বাধ্যতামূলক করার দিকেই এগোচ্ছে সরকার। তাই সম্মেলন থেকে দাবি তোলা হয়েছেঃ “সরকার থেকে কর্মীদের স্মার্ট ফোন ও প্রতিমাসে রিচার্জের জন্য ৫০০ টাকা করে দিতে হবে। একাজের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।”
সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিতে ৬১ জনের কার্যকরী কমিটি এবং ২৩ জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। রত্না দত্ত সভাপতি, শীলা মণ্ডল সম্পাদক এবং দিপালী মাইতি কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মনীষা চক্রবর্তী, মলিনা ঘোষ, কল্যাণী সাধুখাঁ, পার্বতী মাহাতো এবং শুক্লা ঘোষকে নিয়ে গঠিত সভানেত্রীমণ্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করেন।