৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
বিড়ি শ্রমিকদের রাজ্য সম্মেলন থেকে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সমস্ত রকম শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে আরও জোরালো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শপথ নিয়ে শেষ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিড়ি শ্রমিক ফেডারেশনের রাজ্য দশম সম্মেলন। গত ১১ ও ১২ জুন মালদহ জেলার কালিয়াচক-৩ ব্লকের বৈষ্ণবনগরে দু’দিনের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে বিড়ি শ্রমিকদের এক হাজার বিড়ি প্রতি ১৭৮ টাকা মজুরি, পিএফ এবং লগবুক চালুর দাবিতে বিড়ি শ্রমিকদের যৌথ সংগ্রাম কমিটির ডাকে আগামী ৫ জুলাই কলকাতা অভিযান সফল করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছাড়াও এই সম্মেলন থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার সপক্ষে, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র হত্যার প্রতিবাদে, প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আগামীদিনে বিড়ি শ্রমিকরা রাজ্যজুড়ে বৃহৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে চলেছেন। তাতে যোগ দেবেন অন্যান্য ক্ষেত্রের শ্রমিকরাও। তাঁরা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ন্যায্য অধিকারের দাবি থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হলে অচল করা হবে রাজ্য। কেন্দ্র ও রাজ্যের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ হবে লাগাতার।
দু’দিনের এই সম্মেলনে একদিকে বিজেপি-আরএসএস’র ধর্মীয় বিভাজন এবং অন্যদিকে তৃণমূলের লুঠেরা চরিত্রের তীব্র সমালোচনা করেন নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলেছেন, মানুষকে শুধুমাত্র কিছু ভাতা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুলিয়ে রাখা যাবে না। কলকারখানা, ছোটো-বড়ো শিল্প গড়ে তুলতে হবে, যাতে রাজ্যের মানুষ কাজ পায়। অথচ তৃণমূল সরকার এনিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যই করে না। লুটপাট, কাটমানি, তোলাবাজিতেই দিন কাটে শাসকদলের। সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে গেলেই পুলিশ দিয়ে অবরোধ-ধর্মঘট তুলে দেওয়ার চেষ্টা হয়। আরেকদিকে উৎসব পালা-পার্বণের নামে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করে। রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ এর শেষ দেখে ছাড়বেন।
১১ জুন কালিয়াচক-৩ ব্লকের কমরেড আবুল হাসনাত খান নগরে (বৈষ্ণবনগর), কমরেড কালীশঙ্কর পাল ও কমরেড তামিজউদ্দিন আহ্মেদ মঞ্চে (প্রমোদ ভবন) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে দুই শতাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের শুরুতে পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি কিঙ্কর পোষাক। শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন তিনি ছাড়াও সিআইটিইউ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু সহ গার্গী চ্যাটার্জি, দেবাশিস রায়, প্রণব দাস, দেবজ্যোতি সিনহা প্রমুখ।
সম্মেলন উদ্বোধন করে অনাদি সাহু বলেন, একদিকে কেন্দ্র অন্যদিকে রাজ্য সরকার একের পর এক শ্রমিক বিরোধী নীতি নিয়ে চলেছে। বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ অর্থ কমাচ্ছে। কেন্দ্রের নীতিতে সাধারণ মানুষের দিশাহারা অবস্থা। করপোরেট সংস্থা ও ধনীদের নানাভাবে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। গরিব মানুষের ওপর আর্থিক বোঝা বাড়াচ্ছে। রেগায় অর্থ বরাদ্দ কমছে।
তিনি বলেন, শ্রমকোড চালু করে মালিকদের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দিয়ে শ্রমিকদের দুর্বল করতে চাইছে কেন্দ্র। অন্যদিকে ধর্মীয় বিভাজনের পথে গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে তারা সচেষ্ট। পিছিয়ে নেই রাজ্যের তৃণমূল সরকারও। খেলায়-উৎসবের নামে অর্থ নয়ছয় করে, কিছু কিছু দানখয়রাতি করে শ্রমজীবীদের মূল কর্মসংস্থান থেকেই বঞ্চিত করে চলেছে। কাজ নেই মানুষের হাতে, ছাঁটাইয়ের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। এর বিরুদ্ধে সমস্ত শ্রমিককে আরও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল করতে হবে।
সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক দেবাশিস রায়। আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন প্রদীপ ব্যানার্জি।
সম্মেলন পরিচালনা করেন পরেশ মাহাতো, প্রণব দাস, চিত্তরঞ্জন সরকার, শ্রাবণী রায়, অমল চৌধুরী, মহম্মদ আজাদ, কিঙ্কর পোষাক, জ্যোতিরূপ ব্যানার্জিকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।
সম্মেলনে নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে ও আলোচনায় উঠে এসেছে, কেন্দ্রের সরকারের জনবিরোধী ও শ্রমিকবিরোধী নীতি সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছে কৃষক ও শ্রমিকদের। শ্রমকোড, পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধি, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া - এসবই চলছে অবাধ গতিতে। করপোরেটদের সুবিধা দিতে গিয়ে সর্বনাশ করছে গরিব মানুষের। জনমতের কোনো তোয়াক্কা করে না কোনো সরকারই। এমনকী আইন আদালতকেও অগ্রাহ্য করে। অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগেই উৎসাহী দুই সরকার। ক্রমশ বাড়ছে ছাঁটাই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রমিকদের নিয়ে জেলায় জেলায় অনেক কথাই বলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। এর বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম অত্যন্ত জরুরি।
রাজ্য বিড়ি শ্রমিক ফেডারেশনের রাজ্য দশম সম্মেলন থেকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন জ্যোতিরূপ ব্যানার্জি, কার্যকরী সভাপতি হয়েছেন রেজাউল করিম, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন বিমান সান্যাল, কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন প্রদীপ ব্যানার্জি। এই সম্মেলনের মঞ্চ থেকে ১১১ জনকে নিয়ে রাজ্য ওয়ার্কিং কমিটি এবং ২০ জনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে।
সম্মেলনের শুরুর দিন ১১ জুন বিকেলে বৈষ্ণবনগর ফুটবল মাঠে প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলার বিড়ি শ্রমিক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন। বক্তব্য রাখেন অনাদি সাহু, দেবাশিস রায়, গার্গী চ্যাটার্জি, প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বনাথ ঘোষ, প্রণব দাস এবং দেবজ্যোতি সিনহা।
বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি চুক্তি নিয়ে রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ন্যায্য মজুরি মিলছে না বিড়ি শ্রমিকদের। প্রতি হাজার বিড়িতে রাজ্য সরকারের নির্ধারিত মজুরি ২৭৬ টাকা হলেও তা পাওয়া তো দূরের কথা, চুক্তিমতো হাজার প্রতি ১৭৮ টাকা দিচ্ছে না মালিকরা। শুধু তাই নয়, বিড়ি শিল্পের মালিকরা প্রায় সকলেই রাজ্যের শাসকদলের নেতা ও অনেকেই জনপ্রতিনিধি। ফলে মুখ্যমন্ত্রী বারবার জেলায় এলেও বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে, এই শিল্পের সাথে যুক্ত মহিলাদের সমস্যা নিয়ে কখনও একটি কথাও বলেননি। ফলে বিড়ি শ্রমিকরা চরম সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, শ্রমিকদের সমস্যা নিরসনে দাবি আদায়ে লাগাতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেন নেতৃবৃন্দ।