৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
সারা ভারত কৃষক সভার দাবি
দেশের স্বার্থে কৃষিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাইরে রাখতে হবে
জেনেভাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠকের সময় বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সম্প্রতি ১২ থেকে ১৫ জুন জেনেভাতে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। সারা ভারত কৃষকসভা (এআইকেএস)’র পক্ষ থেকে ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠি লিখে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে ভারতের কৃষক ও জনসাধারণের স্বার্থের কথা বলার জন্য সরকারকে অনুরোধ করে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছে। চিঠিটির অনুলিপি বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী এবং কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রীকেও পাঠানো হয়। এআইকেএস ভারত সরকারকে ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ে এই বৈঠকে স্থায়ী সমাধানের দাবিতে অটল থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এআইকেএস বলেছে ধনী দেশগুলির দ্বারা প্রদত্ত অন্যায্য ভরতুকিকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত। সেই চিঠির বিষয় বস্তু এখানে তুলে ধরা হলো।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন এমন একটি প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন আমাদের দেশের কৃষকরা চরম কৃষি সংকটের সম্মুখীন। কোভিড-১৯ মহামারীর দরুনও কৃষিকে সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছে। আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছি যেখানে সার, জ্বালানি এবং অন্যান্য উপকরণের দামের বেলাগাম বৃদ্ধি একদিকে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় ব্যাপক বৃদ্ধির দিকে নিয়ে গেছে এবং অন্যদিকে তাদের পণ্যের অলাভজনক দাম তাদের ঋণের ফাঁদে ঠেলে দিচ্ছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দাম কৃষকরা না পেলে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়র খাদ্য নিরাপত্তার চাহিদা মেটানো অত্যন্ত কঠিন। বর্তমানের বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট এবং খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে এই সংকট আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর ইঙ্গিতবাহী। ডব্লিউটিও মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এই বিষয়টি আমাদের তুলে ধরতে হবে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এআইকেএস ১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সতর্ক করে আসছে যে, বাণিজ্য উদারীকরণ নীতিসমূহ, খামার এবং খাদ্য ভরতুকি প্রত্যাহার, আমদানি শুল্ক বাতিলের পাশাপাশি পরিমাণগত বিধিনিষেধগুলি তুলে নেওয়া দরিদ্র ভারতীয় কৃষকদের উন্নত দেশগুলির উচ্চ ভরতুকিপ্রাপ্ত বড়ো পুঁজিবাদী কৃষকদের সাথে একটি অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দরুন বাইরে থেকে আনা সস্তা পণ্য এদেশে বিক্রির ফলে ভারতীয় কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য হ্রাসের কারণে কৃষকরা দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে - যা আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় ৪ লাখ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। এই বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, প্রকৃত পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা অনেক বেশি যা আমাদের অজানা নয়। এআইকেএস তার অবস্থানে অটল থাকে যে, নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির সম্পূর্ণ ধারাটি উলটানো দরকার এবং ভারতের উচিত ডব্লিউটিও থেকে কৃষিকে দূরে রাখা এবং সেইসাথে অসম বাণিজ্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা।
মন্ত্রী পর্যায়ে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার ফলে আইনত বাধ্যতামূলক ফলাফল লক্ষ লক্ষ ভারতীয় কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটা অপরিহার্য যে ভারত সরকারকে কৃষকদের কণ্ঠস্বর শুনে ডব্লিউটিও-তে তাদের স্বার্থ স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। এটা মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশের কৃষকরা একটি দীর্ঘ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন যা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে। ডব্লিউটিও’র নির্দেশে আনা তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এবং সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার মাধ্যমে ফসলের লাভজনক ন্যূনতম সহায়কমূল্য (এমএসপি) সি২+৫০ শতাংশে ক্রয় নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের দাবিতে কৃষকদের এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে মহান আত্মত্যাগ এবং ৭০০ জনেরও বেশি কৃষকের শাহাদাতের মধ্যদিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার এবং নিজস্ব মজুত ব্যবস্থার ইস্যুগুলিও এমন সমস্যা ছিল যা কৃষকদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল। সরকারের নিজস্ব মজুত ব্যবস্থা থেকে সরে যাওয়ার, নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার এবং কৃষি ব্যবসাগুলিকে দখলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়গুলি কৃষক সংগ্রামের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। এআইকেএস গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে যে, আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি যেমন সরকারি মজুত ব্যবস্থা সংক্রান্ত সরকারি ব্যবস্থা (পিএসএইচ), খাদ্যের জন্য স্থায়ী সমাধান এবং বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা (এসএসএম) সংক্রান্ত আলোচনাকে আবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং উন্নত দেশগুলির আগ্রহের বিষয়গুলিকে আলোচনায় আনা হচ্ছে।
এআইকেএস এবং ভারতের লক্ষ লক্ষ কৃষকের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য সংগঠনগুলি কৃষিকে ডব্লিউটিও’র বাইরে রাখার দাবি জানিয়ে আসছে, কারণ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতির চাপে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর অন্যায্য এবং অসম আইন আরোপ করা হয়েছে যেখানে ধনী দেশ এবং কৃষি ব্যবসার প্রতি আনুকূল্য দেখানো হয়েছে। এমনকী ধনী দেশগুলি যখন সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাদের কৃষক এবং করপোরেশনগুলিকে ব্যাপক ভরতুকি দেওয়া অব্যাহত রেখেছে গ্রিন বক্সের অধীনে, তখন ডব্লিউটিও-তে ভারতীয় চিনি, দুধ এবং ডেয়ারিজাত পণ্যে, গম, চাল, ডাল ইত্যাদিতে দেওয়া ভরতুকি সম্পর্কে তারা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এআইকেএস মনে করে যে, এটি ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং তার অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের উপর একটি নির্লজ্জ আক্রমণ। এটি কৃষকদের আরও বেশি উৎপাদন করার একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, উপযুক্ত জীবিকা অর্জনের এবং দেশকে খাদ্য জোগানোর জন্য দেশের নীতি প্রণয়নের উপর আঘাত স্বরূপ। খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটাতে সরকারি মজুত ব্যবস্থা সহ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সরকারি সংগ্রহের সাথে কৃষিপণ্যের মূল্যের ক্ষেত্রে সহায়তা কৃষকদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। কৃষকের উৎপাদন ব্যয় পূরণ করা এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগগুলির সমাধানের সঙ্গে এই বিষয়গুলি অবিচ্ছেদ্য। ডব্লিউটিও’র কৃষি সংক্রান্ত চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, এই ধরনের ভরতুকি পণ্য পিছু উৎপাদনের মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না; যদিও এটি ১৯৮৬-৮৮ সালের মূল্যের উপর ভিত্তি করে গণনা করে সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে যা অযৌক্তিক এবং আজকের দিনের প্রকৃত দাম যা বহুগুণ বেশি তার বাস্তবতা থেকে অনেক দূরের। বালিতে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে শান্তি ধারাটিতে ভরতুকি অব্যাহত রাখার বিষয়টিতে কোনও মামলা করা হবে না তা নিশ্চিত করা হয়েছিল, কিন্তু ভারত যখন দু’বার চালের উপর ভরতুকি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করার জন্য এটি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল তখন তা কার্যকর করার পথ মসৃণ ছিল না। সরকারি মজুত ব্যবস্থা প্রোগ্রামগুলিকে রক্ষা করার জন্য সমর্থন মূল্য ব্যবহারের পক্ষে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানের অনুপস্থিতির জন্য আমাদের কৃষকদের জীবিকা এবং ভারতের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে আপসের সম্মুখীন হবে।
ভারত এর আগে সম্মিলিতভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে নিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ করার ভূমিকা পালন করেছিল। খবর অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলির জি-৩৩ গ্রুপ, আফ্রিকান গ্রুপ এবং আফ্রিকান দেশসমূহ, ক্যারিবিয়ান এবং প্যাসিফিক গ্রুপের দেশগুলি একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি যৌথ প্রস্তাব পেশ করেছিল যাতে বলা হয় যে, ১৯৮৬-৮৮ সালের প্রেক্ষিতে মূল্য নির্ধারণ সংশোধন করা উচিত এবং বর্তমান বাজার মূল্যের সাথে তা সংযুক্ত করা উচিত অথবা মুদ্রাস্ফীতির নিরিখে তা ঠিক করতে হবে। যৌথ প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, এই জাতীয় ভরতুকিগুলির গণনা প্রকৃত সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে করা উচিত, সমস্ত যোগ্য উৎপাদনের ভিত্তিতে নয়। এটি উন্নত দেশগুলির দাবি যে, আমাদের ভরতুকির হার বেশি তা উন্মোচিত করবে এবং প্রমাণ করবে যে ভারতীয় কৃষকরা যে পরিমাণ ভরতুকি পান তা প্রকৃতপক্ষে ধনী দেশগুলিতে প্রতিটি কৃষকের তুলনায় অনেক কম। এটি ধনী দেশ এবং কৃষি-রপ্তানিকারক দেশগুলির একটি গ্রুপের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় যারা এমনকী এই নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতেও অনিচ্ছুক। সরকারি মজুত ব্যবস্থা ইস্যুতে স্থায়ী সমাধানও তারা আটকে দিয়েছে, যদিও এবিষয়ে ২০১৭ সালের মধ্যে সবার সম্মত হওয়ার কথা ছিল। বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এটিতে একমত হওয়ার সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও। হঠাৎ করে আমদানি বৃদ্ধি পেলে এসএসএম সরকারকে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর অনুমতি প্রদান উন্নত পশ্চিমী দেশগুলি থেকে আসা ভরতুকিযুক্ত পণ্যের জেরে দেশের বাজারে পণ্যের দাম পড়ে যাওয়ার জন্য ভারতীয় কৃষকদের জন্য অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং অন্যায্য প্রতিযোগিতার থেকে কৃষকদের রক্ষা করতো। একটি স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করার জন্য ভারতকে দ্বিগুণ শক্তি দিয়ে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিবৃতিতে পরিশেষে বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলি দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশগুলির কৃষকদের সমস্যাগুলির স্থায়ী সমাধানে বাধা দিচ্ছে, তারা কেবল তাদের বাজার শক্তি বাড়ানোর জন্য ষড়যন্ত্র করছে। শোনা যাচ্ছে, তারা এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো স্থগিত রেখে একটি বাণিজ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা ঘোষণার পরিকল্পনা করছে। এওএ-এর এই অন্যায্য নিয়মের ইস্যুটি যা ধনী দেশগুলিকে ব্যাপক ভরতুকি প্রদানের অনুমতি দেয় এবং উন্নয়নশীল দেশে কৃষকদের দেওয়া নগণ্য সহায়তার বিষয়টিকে যা আক্রমণ করে, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ তার মোকাবিলা না করলে আপনি কেবল আমাদের কৃষকদের গলায় ফাঁস শক্ত করতে ইচ্ছুক পক্ষ হতে পারবেন।