E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি

জাতি-উপজাতি সংগ্রামী ঐক্য অটুট রাখার সংকল্প নিয়ে রাজভবন অভিযান

হারাধন দেবনাথ


গণমুক্তি পরিষদ এবং টিওয়াইএফ’র যৌথ আহ্বানে রাজধানী আগরতলায় বাঁধ ভাঙা জনস্রোত।

অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রাজপথে ঝরে পড়ল ঘৃণার আগুন। তিপ্রাল্যান্ড, গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবিদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ উঠল - জাতি-উপজাতি ঐক্যে ফাটল সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই হবে তীব্র। ১১ জুন গণমুক্তি পরিষদ এবং টিওয়াইএফ’র যৌথ আহ্বানে রাজধানী আগরতলা দেখল বাঁধ ভাঙা জনস্রোত। পাহাড়ি ঝরনার মতো নেমে আসা উত্তাল স্রোত শাসকের বাধা প্রতিহত করে শোনাল আগামী দিনের বৃহত্তর লড়াইয়ের চেতাবনি।

১১ দফা দাবিতে ডাক দেওয়া হয়েছিল রাজভবন অভিযানের। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার এবং এডিসি’র শাসক তিপ্রা মথার ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষের অভিযানে। সাম্প্রদায়িক বি‍‌জেপি’র সঙ্গী আইপিএফটি তিপ্রাল্যান্ডের দাবিদার। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি তুলেছে এডিসি’র শাসক তিপ্রা মথা।

বিশাল মিছিল শেষে সার্কিট হাউসের সামনে হার না মানা সমাবেশকে অভিনন্দিত করে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার বলেছেন, সামনের দিন আপনাদের। আপনাদের জয়কে সুসংহত করার জন্য শপথ নিন। আমরা ছিলাম আপনাদের সঙ্গে। এখনও আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। জনগণের সঙ্গে থেকে জনগণকে নিয়ে সামনের দিনে বৃহত্তর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপি-কে কোণঠাসা করতে হবে। বিজেপি-কে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা কৌশলে মদত দেবার চেষ্টা করছে তাদেরও কোণঠাসা করতে হবে। এদিক থেকে তিপ্রা মথাকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কোনো প্রহেলিকায়, ছলনায় বিভ্রান্ত হলে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারবেন। প্রকৃতপক্ষে জাতি-উপজাতি জনগণের মধ্যে বিরোধ বাধানোর ‍চেষ্টাকেও মতাদর্শগতভাবে সামনাসামনি মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে।

মানিক সরকার ছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জিএমপি-র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জীতেন্দ্র চৌধুরী, বরিষ্ঠ নেতৃত্ব অঘোর দেববর্মা, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাধাচরণ দেববর্মা, সহসভাপতি নরেশ জমাতিয়া, টিওয়াইএফ-র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুমুদ দেববর্মা এবং প্রতিনিধি দলের পক্ষে রমণী দেববর্মা।

গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের স্লোগান তোলা তিপ্রা মথাকে কটাক্ষ করে মানিক সরকার বলেন, এডিসি চালানো, রেগার কাজের জন্য, গ্রামের রাস্তা ঠিক করা, পানীয় জলের কল ও সেচের মেশিন চালু করার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে কোনো দাবি করেনি তিপ্রা মথা। সমালোচনাও করেনি। যা কিছু কাজকর্ম হচ্ছে লুঠপাট করে, ভাগ করে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে তিপ্রা মথা, কোথাও বিজেপি আবার কোথাও আইপিএফটি। এনিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট হচ্ছে।

কোথায় গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড? কোথায় আলাদা উপজাতি রাজ্য? এই প্রশ্ন তুলে মানিক সরকার বলেন, এগুলির ধারেকাছে তারা কেউ নেই। এই সমস্ত প্রলোভন দিয়ে এডিসি দখল করেছে তিপ্রা মথা। যেভাবে বিজেপি ভিশন ডকুমেন্টে ২৯৯টি প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারে এসেছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি ও জ্বলন্ত দাবিগুলি নিয়ে তিপ্রা মথার কোনো মাথাব্যাথা নেই। ১২৫তম সংবিধান সংশোধনী বিল পার্লামেন্টে পাশ করা, ককবরক ভাষাকে অষ্টম তফশিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি নিয়ে কিছু বলছে না বিজেপি। আইপিএফটি কিছু বলছে না। কিছু বলছে না তিপ্রা মথাও।

মানিক সরকার বলেন, তিপ্রা মথার মূল লাইন হলো উপজাতি থেকে অ-উপজাতি জনগণকে আলাদা করা। কারণ জাতি-উপজাতি জনগণ এক থাকলে গণতান্ত্রিক ‍ঐক্য ও বামপন্থী শক্তি সুদৃঢ়, সংহত হবে। তাহলে লুটেরা, পুঁজিপতিদের অসুবিধা হবে। জাতি-উপজাতি ঐক্য যাতে গড়ে উঠতে না পারে তার জন্য ১৯৬৭ সালে তৈরি হয়েছে টিইউজেএস। তারই নামান্তর তিপ্রা মথা। ঘুরে ফিরে সে একই জিনিস। উপজাতি জনজীবনের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি নিয়ে কোনোদিন আন্দোলন করেনি টিইউজেএস। আইএনপিটি করেনি। আইপিএফটি করেনি। আজও করছে না। ঠিক তেমনি তিপ্রা মথাও করে না।

মানিক সরকারের ভাষণ চলাকালীন জনঢলের মাঝে নজর কাড়লো একঝাঁক চাকমা সম্প্রদায়ের যুবক। তারা এসেছেন ছামনু থেকে। একজনের নাম বিকাশ চাকমা। এলাকার উন্নয়নের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকার পরিবর্তনের পর আজ অবধি কোনো উন্নয়নের কাজই হয়নি। এলাকার রাস্তা চলার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাজ্যে বি‍‌জেপি-জোট সরকার এবং তিপ্রা মথা এডিসি প্রশাসনে আসায় জনকল্যাণমূলক কাজই করেনি। শুধু রাস্তাঘাটই নয়, বিশুদ্ধ পানীয় জল ও বিদ্যুতের অবস্থা খুবই খারাপ। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে রাস্তা তৈরি হয়েছিল সেটাও জঙ্গল গ্রাস করে নিয়েছে। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না প্রশাসন। রাস্তা সংস্কার, পানীয় জলের দাবিতে স্থানীয় পঞ্চায়েতে বেশ কয়েকবার ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। তাতেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এলাকায় চরম অরাজকতা।

এক সাংবাদিক বন্ধুর ভাষায় রাজভবন অভিযানে শামিল উপজাতি অংশের হাজার হাজার মানুষের পথচলায় আঁকা হয়েছে সংগ্রামের ক্যারাভেন। জনপ্লাবনে অবরুদ্ধ শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়ানো পথচলতি বহু সাধারণ মানুষকে বিস্ময়ভরা চোখে সংগ্রামী সে লহরের দিকে তাকিয়েই বলতে শোনা গেল - লালেই সুন্দর পাহাড়।

প্যারাডাইস চৌমুহনিতে মানুষের জমায়েত দেখেই কর্মতৎপরতা বাড়িয়ে নিতে দেখা গেল পুলিশের উচ্চ আধিকারিকদের। ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই অবস্থা রাজপথের। কে বলে পাহাড়ে লাল অস্তমিত? ছোটো এই মন্তব্য ভাসিয়ে সিটি সেন্টারের ভেতরে চলে যেতে দেখা গেল এক যুবককে। চিরাচরিত পোশাকে সজ্জিত উপজাতি অংশের মা-বোনেদের অগ্রভাগে রেখে যাত্রা শুরু হয় রাজভবন অভিযানের। পোস্ট অফিস চৌমুহনি, সূর্য চৌমুহনি, কামান চৌমুহনি হয়ে এক একটি ঢেউ এগিয়ে চলে। ১১ জুন, শনিবারের মাঝ দুপুরে মাথায় আগুন ঢালছিল গনগনে সূর্য। রাজপথের কালো পিচের উত্তাপ জ্বালা ধরাচ্ছে চোখে। কোনো কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই সংগ্রামী মানুষের। অভিষ্ট লক্ষ্যে স্থির। গগনভেদী স্লোগানের সাথেই উঁচু থেকে উঁচুতে উড়ছে হাতে হাতে ধরা লাল ও সবুজ পতাকা।

এক মিনিটে কতো সংখ্যক মানুষ পথের নির্দিষ্ট একটি অংশ পেরোল - তা নিয়েই কামান চৌমুহনিতে বিশ্লেষণ চলছিল দুই যুবকের। গোটা শহরটাই যে থমকে গেছে হঠাৎ। দলে দলে এগোচ্ছে মিছিলকারীরা। খালি চোখে যতটুকু দেখা যায় শুধু কালো মাথার থিকথিক ভিড়। সূর্যের তীব্র আলো উড়ন্ত লাল, সবুজ পতাকায় পড়ে রূপের বর্ণচ্ছটা চারপাশে। মানুষ চলছে তো চলছেই। গণ্ডাছড়া, কাঞ্চনপুর, লংতরাইভ্যালি, সাব্রুম, বিলোনীয়া, খোয়াই, জিরানীয়া, মোহনপুর - সমস্ত মহকুমার উপজাতি নারী-পুরুষ একাকার। স্লোগান-স্লোগানে ধরা পড়ছিল বিজেপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে নানা বয়সের সাধারণ উপজাতি জনগণের তীব্র ঘৃণা। আত্মপ্রত্যয় ঝরে পড়ছিল বিজেপি-সহ শান্তি-সম্প্রীতি বিরোধী সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে চোয়াল শক্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই একটি নতুন ভোর ছিনিয়ে আনার। ততক্ষণে ভিড় বাড়তে থাকে রাজপথের দু’ধারেও। এই ভিড় দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতা, পথচলতি সাধারণ মানুষের। বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ছাদে ছাদে মোবাইল হাতে উৎসাহী যুবদের ভিড়। এক একটি মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দির আপ্রাণ প্রচেষ্টা। বিগত ৫১ মাসে লাল, সাদা, সবুজ পতাকার বহু মিছিল, সংগ্রামী ঢেউ বুকে ধরেছে রাজধানী শহর। কিন্তু সবকিছুকেই যেন ছাপিয়ে যায় ১১ জুনের রাজভবন অভিযান। তারুণ্যের তেজের সাথেই মিলেমিশে একাকার বয়সে কিছুটা বড়োদের সংগ্রামী উদ্দীপনা। মা-বোনেদের সংগ্রামী উচ্ছ্বাস যেন সমুদ্র তরঙ্গ।

ভেসে আসছিল ককবরক ভাষায় স্লোগান ‘চবা, চবা, চবা চলি খা’ - জ্যাকসন গেট হয়ে ওরিয়েন্ট চৌমুহনির দিকে অগ্রগামী মিছিল থেকে। স্লোগান শুনে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এলেন এক বই ব্যবসায়ী। যুবদের কণ্ঠে এই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ছিল বেশ উচ্চকিত হয়ে। ককবরক শব্দগুলির বাংলা অর্থ জেনে নিয়ে ওই ব্যবসায়ীকেও বলতে ‍‌শোনা গেল - লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই। রবীন্দ্রভবন, বিদুরকর্তা চৌমুহনি হয়ে কর্নেল চৌমুহনির দিকে রাজভবন অভিযাত্রীরা এগিয়ে চলার পথে পথে লড়াইয়ের বার্তাই ছড়িয়ে পড়ছিল টর্নেডোর আওয়াজ হয়ে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা এক একটি স্রোতধারা প্রশস্ত রাস্তায় আরও বেশি স্ফীত, আরও বেশি স্রোতস্বিনী। উত্তর গেটে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশের কর্মীদের কাছে সে খবর পৌঁছে গিয়েছিল আগেই। ওয়্যারলেস বার্তা আদান-প্রদানে। বিবেকানন্দ স্টেডিয়ামের কর্ণার থেকে আকাশবাণী কেন্দ্রের দিকে ওয়ান-ওয়ে করে দেওয়া হয় যানবাহন চলাচল।

সবটাই অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পথে নামা মানুষের নয়া ইতিহাস। উত্তর-গেট থেকে আস্তাবল সেতু। উড্ডীন লাল ও সবুজ পতাকার নিচে কালো মাথাগুলি মনে হচ্ছিল বিন্দু রেখা। টানা ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে আধা সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ি থেকে নেমে এলেন চালক। তখনও হারাধন সংঘের রাস্তা ধরে এগোচ্ছে জনপ্লাবন। ভূপিন্দর সিং নামে ওই চালক মাতৃভাষায় যা বলছিলেন তার অর্থ ছিল, আগরতলায় এতো মানুষের মিছিল গত বছর চারেক ধরে চোখে পড়েনি।

গণতান্ত্রিক পথে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই বিজেপি সরকারকে বাধ্য করতে হবে এডিসি’র হাতে অধিক ক্ষমতা ও অর্থ দেবার জন্য ১২৫তম সংবিধান সংশোধনী বিল পার্লামেন্টে পাশ করতে। আরও তীব্র করতে হবে ভিশন ডকুমেন্টের প্রতিশ্রুতি পালনে বিজেপি-জোট সরকারকে বাধ্য করানোর লড়াই। এদিন ঐতিহাসিক রাজভবন অভিযানের বিশাল সমাবেশে এই আহ্বান ছিল জিএমপি-র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জীতেন্দ্র চৌধুরীর। বিদেশি বিতাড়ন, স্বাধীন ত্রিপুরা, স্বাধীন উত্তর-পূর্বাঞ্চল স্লোগানেরই নতুন সংস্করণ তিপ্রাল্যান্ড, গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড। মানুষ অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন দুটি স্লোগানই অবান্তর ও অবাস্তব। ত্রিপুরাকে পৃথক করার দাবি কখনও বাস্তবায়িত হতে পারে না। রাজ্যের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এটা অসম্ভব।

রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অঘোর দেববর্মা বলেন, পাহাড়ে দমবন্ধকর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন উপজাতি জনগণ। ধমক আর ভয় চলছে। এটা আমাদের সংস্কৃতি না। একে অপরকে আলিঙ্গন করে আমরা চলেছি। তিনি বলেন, দমবন্ধকর অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। সামনের দিনে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সামনের দিনে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রত্যয়ই শুনেছি রাজভবন অভিযানে। শুনেছেন ত্রিপুরার আম জনতা।