৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
হযবরল - বানানের গোড়ায় চ’
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মেথি (Mathe) সাহেব ম্যাট (Mat)-এর ওপর বসে আইসিএস (ICS) পরীক্ষা দিচ্ছেন। কিংবা বাবার হলো আবার জ্বর সারলো ঔষধে। ছোটোবেলায় কোনও কঠিন বানান অথবা মুঘল সাম্রাজ্যের সব সম্রাটের নাম মনে রাখার এরকম একাধিক টোটকা ছিল। সেভাবেই মনে রাখার চেষ্টা করতাম। তবুও আমার স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই যে, সব বাংলা বা ইংরেজি বানান আমি জানিনা। সব বাংলা বা ইংরেজি শব্দের অর্থ জানিনা। সবকিছুর অর্থ না জানাতে কোনো অনর্থ ঘটলেও আমার কিছু করার নেই। এমনকী স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ পুরোটা একদমে, না আটকে বলে ফেলতে পারব কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিশেষ্য, বিশেষণ, সন্ধি, সমাস তো আরও চাপের। সমাজের গুলিয়ে যাওয়া ব্যাকরণে কখন কোথায় চুপি চুপি সন্ধি হয়ে যাচ্ছে আর কী কী নতুন বিশেষণ যুক্ত হচ্ছে তা নিয়ে রীতিমতো গোরু খোঁজা শুরু করা দরকার।
বানানে আটকে গেলে আগে মহৌষধি হিসেবে অবতীর্ণ হতেন বাবা, ইদানীং আমার জনা দুয়েক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাক্যের গঠন শিখিয়েছেন আমার খুব কাছের এক মানুষ। এখনও যদিও শেখার অনেক বাকি, তবু সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় বলতে গেলে ইদানীং নিজেকে বেশ ‘ফিলিং বিজ্ঞ’ লাগে। অবশ্য সবটুকুই তাঁদের দৌলতে। তাঁদের সাহায্য নিয়ে এই সোশ্যাল মিডিয়া সভ্যতার যুগে স্বঘোষিত বিজ্ঞ সাজতে খুব একটা মন্দ লাগেনা। যেখানে খুব সহজেই নিজের পছন্দের একটা বৃত্ত তৈরি করে ফেলা যায়। ট্র্যাশ লিখে লিখে দেওয়াল ভরিয়ে ফেলেও নিজেকে লেখক দাবি করা যায়। কমেন্ট সেকশন অফ করে রেখে যা খুশি লিখে নিজস্ব বৃত্তের পিঠ চাপড়ানি পাওয়া যায়, সমালোচনা এড়ানো যায়। আর অতি অবশ্যই পৃথিবীর যে কোনও সমস্যায় গম্ভীরভাবে ভুল বাক্য, ভুল বানানে বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়া যায়। তা সে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক অথবা সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষ কিংবা কাতার বিশ্বকাপ অথবা দেশে বেকারত্ব দূর করার থেকেও রামমন্দির তৈরি করা কেন গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়েও। এছাড়াও যে কোনও কাউকে ট্রোল করা বা যে কোনও ইস্যুতে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে দেবার সোশ্যাল মিডিয়াগত অধিকার লাভ করা যায়। এর চেয়ে চরম সুখ, পরম প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? পরিসংখ্যান বলছে, সাধারণত মানুষ এখন দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। সপ্তাহে ২১ থেকে ২৮ ঘণ্টা। অর্থাৎ বছরের ৫২ দিন তিনি ব্যয় করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। যদি তাঁর জীবন ৮০ বছরের হয় সেক্ষেত্রে তিনি জীবনের ১৩ বছর শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটিয়ে দিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক ছাতা বিতর্কে আপাতত প্রথম মনে পড়লো সম্ভবত ক্লাস এইটে পড়া কালিদাস রায়-এর লেখা একটা কবিতা। ‘বর্ষাসাথী আমার ছাতি আজকে তুমি নাই, যাচ্ছে ফাটি বুকের ছাতি তোমার শোকে ভাই।’ আর তার পরেই মনে পড়ছে সুকুমার রায়ের ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে, মাঝিরে কন, বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?...’ শেষে বাবু বলেছিলেন “...জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।” বিগত দশ এগারো বছরে র-ফলা ঋ-কার ভুলে মেরে দেওয়া বাঙালির কাছে ‘আমব্রেলা’ অথবা ‘হায়ার সেকেন্ডারি’ বানান না জানাটা কতটা গর্হিত অপরাধ সেটা গত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। আইনস্টাইন সংক্রান্ত একটা ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। সত্যি মিথ্যে জানিনা। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছ থেকে নাকি একবার এক সাংবাদিক ফোন নাম্বার চেয়েছিলেন। আইনস্টাইন টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে নিজের নাম্বার বের করে ওই সাংবাদিককে লিখে দিয়েছিলেন। এরপর হতভম্ব সেই সাংবাদিক আইনস্টাইনকে বলেন, আপনি নিজের নাম্বার মনে রাখতে পারেন না? যার উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, যে জিনিস সহজেই আমি বই থেকে পেয়ে যাব তা অকারণ স্মৃতিতে রাখার প্রয়োজন কী?
যদিও এখন ‘পোবোল’ ‘পতিবাদ’ ‘পতিরোধে’ দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের পদধ্বনি। পারলে ‘আমব্রেলা’ বানান না জানা ওই মেয়েটিকেও ন্যাড়ার মতো ‘তিনদিনের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি’র শাস্তি শুনিয়ে দেয়। শুধু ওই বাজার গরম করা সাংবাদিকের কোনো এক বিশেষ মানুষকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি (কোনোদিন হবেও না) গভর্নমেন্টের সঠিক উচ্চারণটা কী হওয়া উচিত অথবা আপনি কেন ১৯৮৪ সালে নিজেকে ভুয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট বলে দাবি করেছিলেন? কিংবা একটা কঠিন কোনও বানান! হবে নাকি একবার? এইসব প্রশ্নে লাগাতার দুর্নীতির জ্বালায় ওষ্ঠাগত পরাণে ‘গরমেন্ট’-এর বিশেষ কিছু হেলদোল না হলেও সাংবাদিকের চাকরি নট হওয়া ‘পায়’ নিশ্চিত। খুব মনে পড়ছে আমফানের সময় হাঁটুজলে শুয়ে পড়ে মানুষ ভেসে যাবার ফুটেজ দেখানো সেই সাংবাদিকের কথা। এমনও তো অনেক সাংবাদিক আছেন যারা ফুটেজ খাবার লোভে আর বাজার গরম করার স্বার্থে ক্রিয়া না দেখিয়ে শুধু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে শোরগোল ফেলে দিতে পছন্দ করেন। সবটুকুই কি চাকরি বাঁচানোর দায়, পেশার দায় বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় নাকি? হবেও বা...
নিওলিবারেলিজম বানানটা আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বোধহয় পারব না। আর এর বাংলাটাও এত খটমট যে কীরকম একটা লাগে। নয়া উদারবাদ। উদার-সে তো এক মহৎ শব্দ। বিশাল তার ব্যাপ্তি। আমার তো উদার বললেই মনে পড়ে সুনির্মল বসুকে। ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে;’। সেই হিসেবে উদারবাদও একটা ভীষণ বড়োসড়ো, সুন্দর বিষয় হওয়া উচিত। যদিও বিষয়টা কীরকম যেন গোলমেলে। হুগো স্যাভেজ ‘নয়া উদারবাদ’কে বলেছিলেন ‘জাহান্নামের রাস্তা’। ডেভিড হার্ভে বলেছেন ‘নয়া উদারবাদকে আমি সবসময়েই এক রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে দেখি’। একই শব্দের এত রূপ - বেশ চাপের ব্যাপার।
এখন নাকি আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে সবকিছুই নয়া উদারবাদের ফসল। সেইজন্যই ব্যাঙের ছাতার মতো নিউজ চ্যানেল। গণ্ডায় গণ্ডায় বিনোদন চ্যানেল। সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা। প্রতিটি মানুষকে একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে বেঁধে ফেলা। ঘেটোতে আটকে দেওয়া। বায়ো বাবলের মতো প্রতিটি মানুষের চারপাশে একটা একটা ছোটো ছোটো কল্পিত পৃথিবী। যেখানে তিনিই লেখক, তিনিই গায়ক, তিনিই শ্রোতা, তিনিই পাঠক, তিনিই রাজনীতিবিদ, তিনিই অর্থনীতিবিদ, তিনিই বিশ্লেষক, তিনিই খেলোয়াড়, তিনিই রেফারি? আমি, আমার টিভি, আমার মোবাইল এবং শুধু আমি। একা, আরও একা, আরও আরও একা করে দেওয়া। বোকা বাক্সের মধ্যে, হাতের মোবাইলের মধ্যে বেঁধে ফেলা। মানুষের চিন্তাশক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া। সমষ্টিগতভাবে ভাবতে না দেওয়া, ভাবার সুযোগ না দেওয়া। ঋত্বিক ঘটকের কথা অনুসারে এরপরে কি সত্যি সত্যিই ভাবতে শেখাটাও প্র্যাকটিস করতে হবে? অদূর ভবিষ্যতে এরও কি কোনো ডিজিটাল কোচিং ক্লাস চালু হবে? ‘হাউ টু থিঙ্ক? জয়েন আওয়ার এক্সক্লুসিভ কোর্স।’ অথবা ‘এখানে সুলভে সহজে ভাবা প্র্যাকটিস করা শেখানো হয়’!
আমি জানি। আপনারা এতক্ষণ ওঁৎ পেতে বসেছিলেন। কখন আমি ফাউল করব আর আমায় খপ করে ধরবেন। হলুদ কার্ড, লাল কার্ড দেখাবেন। যেই উদারবাদ নিয়ে প্যারাটা লিখেছি তখনই মনে মনে ভাবতে শুরু করেছেন, এইতো শালা-গাড়ি মেইন লাইন ছেড়ে কর্ড লাইনে ঢুকেছে। এবার বেশ খপ করে ধরা যাবে। আবার ব্যাটাচ্ছেলে রাজনীতি করছে। বিশ্বাস করুন আমি রাজনীতি-টাজনীতি কিচ্ছু করছি না। আমি ওসব বুঝিই না। আমি তো আর ঋত্বিক ঘটক নই যে, বুক চিতিয়ে বলতে পারব, “পৃথিবীতে অ্যাপলিটিক্যাল কিংবা অরাজনৈতিক বলতে কিছুই নেই”। উদারবাদ বিষয়টা আপনার কাছেও যতটা গোলমেলে, মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়, আমারও ঠিক তাই।
একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি। পুঁজি শব্দটা শুনলেই আমার প্রথম পুঁজ-এর কথা মনে পড়ে। ক্ষতস্থান থেকে নির্গত ক্লেদ, দূষিত রক্ত। কেমন একটা গা গোলানো অনুভূতি। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি কেন ডেভিড হার্ভে বলেছেন, ‘ফিনান্স পুঁজিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক এবং সব থেকে গতিশীল’। ‘শ্রমিকবাহিনী যেখানে সস্তা সেখানে কর্পোরেট তাদের পুঁজি নিয়ে যায়’। কেন তিনি এক আলোচনায় বলেছেন, ‘উদারবাদের স্বার্থেই বেসরকারিকরণ করা হয়। কৃত্রিম বেকারত্ব তৈরি করা হয়। যাতে মানুষ নিজের দেশের বাইরে চাকরি খুঁজতে বাধ্য হয়। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, অটোমেশনের মাধ্যমে শ্রমিকদের চিঁড়েচ্যাপটা করার কৌশল নেওয়া হয়। কেন উদারীকরণের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য প্রথম প্রভাব বিস্তার করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। এখনও বুঝতে পারিনি কেন তিনি বলেছেন, পুঁজিবাদকে চরম সংকট থেকে বাঁচাতেই অনেক ভেবেচিন্তে নয়া উদারবাদের জন্ম দেওয়া হয়েছে।
যাচ্ছিলাম বর্ধমান। বালি থেকে গাড়ি কখন নিজে নিজেই পথ পরিবর্তন করে মেন লাইন ছেড়ে কর্ড লাইন ধরে নিয়েছে বুঝিনি। একটু আগে দেখলাম জনাই। মনে পড়লো জনাইয়ের মনোহরা নামক মিষ্টি নাকি বিখ্যাত। যে কোনও জিনিসের নাম মনোহরা হলেই যে তা মনোহারিণী হবে তার কোনো মানে নেই। শব্দের শুরুতে উদার থাকলেও শেষে যে তা সযত্নে বাদ দিয়ে উদারবাদ-এর সৃষ্টি তাও আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। ফেরে পড়ে যাই। ঘূর্ণিপাকে। আমব্রেলা বানান না জানা নিয়ে খিল্লি করার চক্করে হারিয়ে যায় এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি, বাঁকা পথে চাকরি পাওয়া ২৬৯ জনের চাকরি বাতিলের খবর। নূপুর শর্মা নিয়ে চর্চা করতে করতে জানতে পারিনা আদানিগোষ্ঠীকে বরাত পাইয়ে দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীকে সুপারিশের কথা। চাপা পড়ে যায় যোগীরাজ্যে ক্ষমতার দম্ভে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বুলডোজারে সংখ্যালঘুর বাড়ি ভেঙে দেবার খবর। বেমালুম চাপা পড়ে যায় রেলের ৮০ হাজার শূন্যপদ বিলুপ্ত করার চেষ্টার চক্রান্তের কথা। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে কেউ আলোচনা করেনা এলআইসি-র শেয়ারের লাগাতার পতন নিয়ে অথবা নতুন শ্রমকোড নিয়ে। কেন প্রতিটি জিনিসের দাম আগুন তা নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। আলোচনা নেই কেন সেনাবাহিনীতেও এবার চুক্তি নিয়োগের পথে হাঁটতে চলেছে সরকার? না। আমব্রেলা বানান জিজ্ঞেস করে ফুটেজ খাওয়া সাংবাদিকের সেই কলজের জোর বোধহয় নেই যে রাজার সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে বলবেন - আপনি কোনও কাপড় না পরেই সাংবাদিক সম্মেলনে বসেছেন কেন? অথবা মহারাজ, বিগত আট বছরে একাধিকবার স্টুডিয়োতে একা একা বসে আপনার মন কী বাত শোনালেও একবারও আপনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি বসেননি কেন? কোন ভয়ে আপনি সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান?
আমার এখন আর মনে নেই ঠিক কী নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম বা কী নিয়ে লিখব ভেবেছিলাম। হয়তো খেই হারিয়ে ফেলেছি বহু আগেই। জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাইতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আর পাঁচজনের মতই গড্ডালিকা স্রোতই এখন আরামদায়ক। মাঝির জীবনের বারো আনাই বৃথা নাকি বাবুর জীবনের ষোলো আনাই বৃথা তা নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই ভাবা প্র্যাকটিস করা চলতে থাকুক। আমি বরং এই সুযোগে টুক করে একবার গুরুদেব স্মরণ করে নিই - “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। এই যে বিপুল ঢেউ লেগেছে তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,/ সকল পরান দিক-না নাড়া।”