E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

সম্প্রীতির ঐতিহ্য-বনিয়াদকে নিয়ে নিরন্তর প্রচার এবং শ্রেণি আন্দোলনের আঘাতেই চূর্ণ হবে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি

সুপ্রতীপ রায়


দেশ জ্বলছে, রাজ্য জ্বলছে। ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির পালে হাওয়া দিতে বিজেপি এবং তৃণমূল দুটি দলই সক্রিয়। অতি সম্প্রতি বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার পয়গম্বর-মন্তব্য যেমন বিজেপি-আরএসএস-র রাজনীতির অঙ্গ। আবার এর পরিপ্রেক্ষিতে হাওড়ার অঙ্কুরহাটির ঘটনাও কার্যত রাজ্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা আর একবার বুঝিয়ে দিল তৃণমূল রাজনৈতিক স্বার্থেই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে চায়।

সম্প্রতি বেসরকারি এক টেলিভিশনে ‘টক শো’ অনুষ্ঠানে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা হজরত মহম্মদ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। আর বিজেপি’র দিল্লি মিডিয়া প্রধান নবীন কুমার জিন্দাল ট্যুইটে হজরত মহম্মদ সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন। উভয় নেতার বিরুদ্ধে বিজেপি’র দলীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা লোক দেখানো। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী উভয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিজেপি-আরএসএস নেতারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ঘৃণা ভাষণ দিয়ে চলেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ইতিহাসের বিকৃতি, কর্পোরেট প্রেম আরএসএস-র কর্মসূচির অঙ্গ। সংখ্যাগুরুর মৌলবাদীরা সক্রিয় হলে সংখ্যালঘুর মৌলবাদীরাও বসে থাকবে না। এটাই ঘটছে।

অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘ সহিষ্ণুতার প্রশ্ন তুলে ভারতের সমালোচনা করেছে। বিজেপি শাসিত ভারতে সহিষ্ণুতার কখনই আশা করা যায় না। ওই দল হিন্দুত্বের রাজনীতি করে। আরএসএস-র হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে বিজেপি সরকার পরিচালনা করছে। রাজ্যে তৃণমূল সংখ্যালঘু তাস খেলে চলেছে। নবজাগরণের পিঠস্থান বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের স্থান করে দিয়েছে তৃণমূল।

বিজেপি এবং তৃণমূল হাতগুটিয়ে বসে আছে এটা ভাববার কারণ নেই। মৌলবাদকে পরাস্ত করতে গেলে মৌলবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা জরুরি তেমনি শ্রেণি আন্দোলনকে প্রসারিত করা প্রয়োজন। এ কাজটিই বিশ্বস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে সিপিআই(এম) পরিচালনা করছে। আমাদের দেশ ও রাজ্যে সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যগুলি নিয়ে নিবিড় চর্চার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের দেশের ঐতিহ্য। সমন্বয়বাদীর ইতিহাস মোছা যাবে না। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পাশে নজরুল, স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্ষুদিরামের পাশে আসফাকুল্লা - এই আমার দেশ আমার পশ্চিমবাংলা। হিন্দুর বাড়িতে পুজো হয় সত্যনারায়ণের। মুসলিমদের উপাস্য সত্যপীরকে হিন্দু যখন তার ঘরে নারায়ণ জ্ঞানে পুজো করে তখন সত্যপীর হয়ে যান সত্যনারায়ণ। সমন্বয়ের অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে ভারতে।

সমন্বয়বাদী দৃষ্টি নিয়েই গীতিকার গোপাল গোঁসাই লিখেছেন (১৮৬৯): ‘আল্লা হরি কি জাত ছিল/ ...কেউ বলে মোর আল্লা বড়/ কেউ বলে মোর হরি বড় -/ দেখ গঙ্গার জল আর পুষ্করিনীর জল/ ইহার মধ্যে দ্বৈত বাধিল’। আর এক গীতিকার দুদ্দুশাহ্ (১৮৪১) লিখেছেনঃ ‘আগে মানুষ পরে ধর্ম জাতির নির্ণয়/ ধর্ম জাতি আগে হলে/ শিশু বালক কেনা জানতে পায়?.../ মানুষের জাত ধর্ম সৃজন/ ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতির নয় কখন।’

মহাভারতেও ভেদাভেদকে স্থান দেওয়া হয়নি, মানুষের কথা বলা হয়েছে। শান্তি পর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছিলেন - “ধর্মের নিগূঢ় মর্ম যদি তোমাদের বলি তবে বলিব মানুষ হইতে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই”। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলেছিল, “যদি কেহ তোমাকে মারিতে আইসে তবে তুমি তাহাকে ফিরিয়া মারিতে উদ্যত হইয়ো না” (শান্তিপর্ব)। ভবিষ্যপুরাণ বলেছিলেন, “দ্বিজ-শূদ্রের মধ্যে বাহ্য বা আধ্যাত্মিক কোনো ভেদই নাই”। মহাভারতের বনপর্বে বলা আছে, “কোনো ধর্ম যদি অপর ধর্মের বিরোধিতা করে তবে তাহা ধর্মই নহে, তাহা মানুষের উপযুক্ত পথই নয়”।

মহাভারতের বনপর্বে আরও বলা হয়েছে, “হয়তো আমরা শাশ্বত ধর্মের সুগভীর রহস্য বুঝি না তবে ইহা বুঝি যে সত্যেই ধর্মের প্রতিষ্ঠা”। শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, “ধর্মের সার কথাই হইল, কাহাকেও হিংসা করিয়ো না”। ওই পর্বে বলা হয়েছে, “সর্ব জীবের কল্যাণ-মৈত্রই ধর্ম”। অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে, “তোমার ধর্ম তোমারই অন্তরের জিনিস। ধ্বজার মতো ধর্মকে দেখাইয়া বেড়াইয়ো না। ধর্মের ধ্বজা দেখাইয়া সুবিধা সংগ্রহ করিয়ো না।” দ্রৌপদীকে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, “ধর্মের ধ্বজা তুলিয়া সুবিধা আদায় করিয়া বেড়াইবার মতো জঘন্য হীনতা আর কিছুই নাই।”

হিন্দুধর্মে উদারতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। ভাগবতে বলা আছে, সর্ব-জীবই তাঁহার আপন মন্দির (৩,২৯,২৭), সর্ব ভূত তাঁহারই জীবন্ত প্রতিমা (৩,২৯,১৬)। মৈত্রেয় উপনিষদে বলা আছে, মানবদেহই যথার্থ দেবালয়। সেই মানব-দেবালয়কে যে নিগ্রহ করে বা তাহার নিষ্ঠুরতা করে তাহার ধর্ম-কর্ম সবই বৃথা (ভাগবত ৩,২৯,২৩)। এমন মূঢ়ের ধর্মসাধনা হইল ভস্মে ঘি ঢালা (ভাগবত ৩,২৯,২২)। উপনিষদ বলেছে - যাহা ধর্ম তাহাই সত্য, যাহা সত্য তাহাই ধর্ম, তাই সত্য বলিলে ধর্ম বলা হয় এবং ধর্ম বলিলে সত্য বলা হয়। এর সাথে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই।

ধর্মীয় উদারতার কারণেই ভারতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বিভিন্ন সম্প্রদায় একত্রে মিলিত হতে পেরেছিলেন। এই অপূর্ব মিলনের ফলেই ভারতের শিল্প-সংষ্কৃতি-সাহিত্য উন্নত হয়েছে। সাধনার জন্যই পাকপত্তনের ফরীদুদ্দিন শকরগঞ্জ, আজমেঢ়ের মৈনুদ্দিন চিস্তি, পাঞ্জাবের সাধক হুজবেরী এদেশে এসেছিলেন। শকর গঞ্জের শিষ্য নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ভারতেই জন্ম। সহিষ্ণুতার পরিবেশ থাকার কারণেই চিস্তি, সুরবর্দী সাধক সম্প্রদায়, কাদিরী ও নক্শবন্দী প্রমুখ সুধীসাধকরা ভারতকে তাঁদের সাধনার স্থান করে নিয়েছিলেন। আর কে না জানে – সুফিরা ছিলেন প্রেম প্রধান ও উদার।

ইসলাম ধর্মেও সহিষ্ণুতা, শান্তি, মৈত্রীর কথা বলা হয়েছে। “আরবদেশে বহুকাল ধরিয়া যে মারামারি হানাহানি ও নীতিহীনতা চলিতে ছিল, হজরত মহম্মদ তাঁহার উদার ধর্মোপদেশের দ্বারা তাহা যথাসাধ্য দূর করতে চেষ্টা করিলেন। সেই যুগ ও সেই দেশের কথা ভাবিলে তাঁহার উপদেশের মহত্ত্বে ও উদারতায় বিস্মিত হইতে হয়। চারিদিকে মারামারি, হানাহানি, তিনি তাহার মধ্যে প্রচার করিলেন যে, মৈত্রী ও শান্তি সাধনাই-ইসলামই-যথার্থ ধর্ম। হজরত মহম্মদের মহাবাণী এবং তাঁহার সাধনার কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেনঃ মানুষের ধর্মবুদ্ধি খণ্ড খণ্ড হইয়া বাহিরে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাকে মহম্মদ অন্তরের দিকে অখণ্ডের দিকে অনন্তের দিকে লইয়া গিয়াছেন। সহজে পারেন নাই, এর জন্য সমস্ত জীবন তাঁকে মৃত্যুসংকুল দুর্গম পথ মাড়াইয়া চলিতে হইয়াছে। চারিদিকে শত্রুতা ঝড়ের সমুদ্রের মতো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে তাঁকে নিরন্তর আক্রমণ করিয়াছে। মানুষের পক্ষে যা যথার্থ স্বাভাবিক, যা সরলসত্য, তাকে স্পষ্ট অনুভব করিতে ও উদ্ধার করিতে। মানুষের মধ্যে যাঁরা সর্বোচ্চ শক্তি সম্পন্ন তাঁদেরই প্রয়োজন হয়, ইসলাম কথার মূল হইল সলম্। তাহার অর্থ শান্তি মৈত্রী আত্মসমর্পণ পাপমুক্তি নমস্কার ইত্যাদি। (ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা-ক্ষিতিমোহন সেন – পৃঃ ১৫)।

কোরানে বলা আছে - যে ইসলামের নাম করে অন্যায় ও অত্যাচার করে সে ইসলামের কেউ নয়। সে ইসলামের শত্রু। তার ব্যবহারের দ্বারা সে হজরতকে অসম্মানিত করে। লোকে মনে করতে পারে এই রকমই বুঝি হজরতের উপদেশ। কোরানে একথাও বলা আছে - কেউ যদি তোমার প্রতি অকল্যাণ ও অসাধু আচরণ করে, তবে তাকে কল্যাণ ও সাধু আচরণই ফিরিয়ে দেবে; এতে যে আজ শত্রু সে কাল বন্ধু হয়ে যাবে (৪১, ৩৪)। আত্মীয়স্বজন, অনাথ, দীন দরিদ্র প্রতিবেশীর কল্যাণ করতে হবে (৪, ৩৬)।

সম্প্রীতির বাংলাতে, নবজাগরণের পীঠস্থান বাংলাতে সাম্প্রদায়িক শক্তি মনজগৎকে দূষিত করার চেষ্টা করছে। যা উদ্বেগের। কিন্তু যুগ যুগ ধরে বাঙালির সংস্কৃতি সমন্বয়ের কথা বলেছে। এমন কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভেদনীতির বিরুদ্ধে বাঙালি সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। এই বাংলার মানুষই ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকে প্রত্যাহার করাতে বাধ্য করেছে। বাঙালি ‘সম্মিলিত পদক্ষেপের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে’। সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ক্রীড়া, নৃত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সহযোগিতা আদান-প্রদানের ধারায় অগ্রসর হয়েছে।

বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সাধনা হয়েছে। অনেক মুসলমান বৈষ্ণব কবি যেমন আছেন তেমনি রামায়ন, মহাভারতের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে মুসলমান শাসকদের অবদান আছে। আউল-বাউল-দরবেশদিগের অপূর্ব সাহিত্য-সঙ্গীত বাংলার সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। ধর্মকে যারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন তাদের উদ্দেশে বাউল মদন গান গেয়ে বলেছেন - ‘তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজেদে/ তোমার ডাক শুনি সাঁই,/ চলতে না পাই,/ রুইখ্যা দাঁড়ায় গুরুতে মোরশেদে।/ ডুইব্যা যাতে অঙ্গ জুড়ায়,/ তাতেই যদি জগৎ পুড়ায়/ বল তো গুরু কোথায় দাঁড়ায়, অভেদ সাধন মরলো ভেদে/ তোর দুয়ারেই নানা তালা,/ পুরাণ-কোরান তসবী-মালা,/ ভেখ-পথই তো প্রধান জ্বালা, কাঁইদে মদন মরে খেদে।’

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সমন্বয়ের উপাদান লক্ষণীয়। নানা ধরনের সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা সংগঠিত আকার নিতে থাকে। ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে পাঁচটি বিভিন্ন ভাষা ব্যবহারকারী প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে - আর্য, দ্রাবিড়, নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, তিব্বত-চীন অথবা টিবেটিয়ন-সাইনো। এরা বিভিন্ন দিক থেকে এসেছিল। বাংলা সাহিত্যের সূচনা চর্যাপদ থেকে, দশম শতাব্দী থেকে ধরা হয়। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য - বাংলা সাহিত্যের জন্মতে হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের মানুষদের কোনো ভূমিকা ছিল না। পরবর্তীতে গাজী, পীর, দরবেশ, সুফিরা ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলায় এসেছিল। এটা স্মরণীয় মুসলমান ধর্ম প্রচারক বিশেষতঃ সুফি মতের ইসলাম সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মের উদার অংশের মধ্যে কোনো বিরোধ হয়নি।

এক ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি আমরা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে এবং আমাদের রাজ্যকে রক্ষা করতে পারে বামপন্থী মতাদর্শ এবং বামপন্থী শক্তি।

মার্কসবাদী হিসে‍বে আমাদের মনে রাখতে হবে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের ধারণা যে, এই ঈশ্বর-বিশ্বাস জীবনের সব সংকট ও আপাত ব্যর্থতার হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পারে। এই বিশ্বাসই তাদের মনে শান্তি সদিচ্ছা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা‌‌য়, সমাজসেবা প্রভৃতি মানবী‌‌য় গুণগুলির ওপর আস্থা বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে এই গুণগুলির জন্য যতই গলা ফাটিয়ে ওকালতি করা হোক না কেন, বাস্তবে দেখা যায় প্রতিদিনই এগুলিকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে গুঁড়ো করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে শাসকশ্রেণির শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই ধর্ম আসলে সব সময় ব্যবহৃত হয়েছে, এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

এই কারণেই সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে বিকৃত, মিথ্যা প্রচার ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যুগ যুগ ধরে বলা হয়, মার্কসবাদীরা ধর্মের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে মার্কসের একটি উক্তিকে ব্যবহার করা হয়, ‘ধর্ম জনসাধারণের আফিঙ’। যদিও এটি পুরো বাক্য নয়, খণ্ডিত অংশ। মার্কস একই সঙ্গে বলেছেন, ‘ধর্মীয় দুর্ভোগ হলো একইভাবে এবং একইসঙ্গে প্রকৃত দুর্ভোগের প্রকাশ এবং সেই দুর্ভোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। ধর্ম হলো নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয় এবং প্রাণহীন অবস্থার প্রাণ। ধর্ম হলো জনগণের আফিঙ’। পুরো কথাটি না বলে ধর্মের কারবারিরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছে।

লেনিনের কথায়-তারা (মার্কসবাদীরা) ধর্মকে কখনোই আঘাত করে না, আঘাত করে সেই সামাজিক পরিস্থিতিকে, যার থেকে ধর্মের উদ্ভব। যে আঘাত হানতে হয় শ্রেণিসংগ্রামের ভিত্তিতে, নৈরাজ্যবাদ ও সুবিধাবাদের মধ্যে সীমা টানতে টানতে। লেনিন এও বলেছেন-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মঠ মন্দিরে আঘাত করা চলবে না। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে ধর্মের মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে মার্কসবাদীরা ‘ধর্মের রাজনীতিকীকরণ’ ও ‘রাজনীতির ধর্মীয়করণ’ উভয়ের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম পরিচালনার কথা বলে; কমিউনিস্টরা কখনই এই উভয় রূপের সঙ্গে আপস করেনা।

শান্তি, শুভেচ্ছা, প্রতিবেশির প্রতি ভালোবাসা ও সমাজের সেবা - এইসব আদর্শ শুধু সক্রিয়‌ আন্দোলনের জোরেই পূর্ণ করা যায়। শ্রমিক‍‌শ্রেণির নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনের জোরেই পূর্ণ করা যায়, শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনের জোরে সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই শুধু সেই আদর্শে পৌঁছানো যায়।

আমাদের দেশের, রাজ্যের সম্প্রীতির ঐতিহ্য-বনিয়াদকে নিয়ে নিরন্তর প্রচার এবং ধারাবাহিক শ্রেণিআন্দোলনের আঘাতেই চূর্ণ হবে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলি। যে কাজ ধারাবাহিকভাবে করে চলেছে সিপিআই(এম)।