৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯
১০ মার্চ ২০২৩
মধ্যবিত্ত শ্রমিক কর্মচারী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট
ধর্মঘটের সমর্থনে বর্ধমানে সরকারি কর্মচারীদের মিছিল।
১০ মার্চ, ২০২৩ পশ্চিমবাংলার গণ-আন্দোলনের দিনলিপিতে আরও একটি মাইলফলক যুক্ত হলো। ওইদিন স্বৈরশাসকের চোখে চোখ রেখে, শিরদাঁড়া সোজা করে সর্বাত্মক ধর্মঘটের নয়া-ইতিহাস রচনা করলেন মধ্যবিত্ত শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা। প্রশাসনিক কালা ফতোয়া (ডাইস-নন আর বেতন কাটার জুজু দেখানো), রাজনৈতিক মাতব্বরদের হুমকি, মেরুদণ্ড বন্ধক রাখা মুষ্টিমেয় অনুগত দ্বারা মাননীয়া-র ভজনা প্রভৃতি কোনো কিছুই এবারে সঙ্কল্পবদ্ধ শিক্ষক ও কর্মচারীদের পিছু হটাতে পারেনি।
পাহাড় থেকে সাগর সারা রাজ্যে ধর্মঘটের যে এমন ব্যাপক প্রভাব পড়বে, তা সরকার বুঝতে পারেনি। রাজ্য সরকার মনে করেছিল, ২০১১ সালের পরবর্তী সময়ে আহূত কয়েকটি সর্বভারতীয় ধর্মঘটের মতোই এবারের ধর্মঘটেও একটা অগণতান্ত্রিক সারকুলার জারি করলে এবং মুখে কিছু হুমকি দিলেই বড়ো অংশের কর্মচারী পিছিয়ে যাবেন, ধর্মঘট করবেন না। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা প্রাপ্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকার সম্পর্কে (যাকে আদালতও স্পষ্ট ভাষায় স্বীকৃতি দিয়েছে) রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত নেতিবাচক মনোভাব শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের মাত্রাকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করেছে। প্রথম দিকে যাঁরা মনে করতেন, রাজ্য সরকার কিছুটা টালবাহানা করলেও আজ না হয় কাল মহার্ঘভাতা দেবেই অথবা এমনও ভাবতেন যে, উচ্চ আদালত যখন রায় দিয়েছে, তখন সরকার আর এড়িয়ে যেতে পারবে না - সময় যত অতিবাহিত হয়েছে, তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন মহার্ঘভাতা না দেওয়ার কারণ হিসেবে যে যুক্তিগুলো বিভিন্নভাবে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে, তার সবগুলোই কুযুক্তি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজ্য সরকার আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে মহার্ঘভাতা দিতে অপারগ, বিষয়টা আদৌ তা নয়। কারণ খেলা, মেলা, উৎসব প্রভৃতি বিভিন্ন অনুৎপাদক খাতে যথেচ্ছ খরচ চলছেই। এমনকী বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র ফুর্তি করার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। মন্ত্রী-সান্ত্রীদের আত্মীয়-পরিজন পরিচালিত এনজিওগুলিতেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ যাচ্ছে। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। অপরিকল্পিত খরচ, তিল কে তাল বানানোর জন্য, আবার কখনও তিল ছাড়াই তাল বানানোর প্রচার ইত্যাদি খাতে লাগামহীন খরচের ফলে রাজ্য সরকারের এখন গলা পর্যন্ত ঋণ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ যা ছিল, গত এক দশকে তা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ঋণের পরিমাণগত বৃদ্ধি ঘটেছে তাই নয়, ঋণের চরিত্রেরও পরিবর্তন ঘটেছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময় যে ঋণ করা হয়েছিল, তার ৮০ ভাগ ছিল স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে জমা অর্থ থেকে গৃহীত বাধ্যতামূলক ঋণ। কিন্তু বর্তমান সরকার বাজার থেকে চড়া সুদে দেদার ঋণ করছে।
আর্থিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার নিজেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তার দায় চাপাতে চাইছে কর্মচারীদের ওপর। শুধু দায় চাপানোই নয়, দরিদ্র জনসাধারণ, যাঁরা মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত অথবা কর্মহীন, তাঁদের সাথে বিভাজন তৈরি করার জন্য কয়েকটি জনবাদী প্রকল্পকে সামনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ডিএ দিতে হলে ওই প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। অথচ জনবাদী প্রকল্পের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে নেই। ওই পাঁচটি রাজ্য বিভিন্ন জনবাদী প্রকল্প চালানোর পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট অংশের কর্মচারী-শিক্ষকদের কেন্দ্রীয় হারে সম্পূর্ণ মহার্ঘভাতা দিচ্ছে। এমনকী মোট ঋণের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের থেকেও অধিক ঋণগ্রস্ত সরকারগুলিও কর্মচারী-শিক্ষকদের মহার্ঘভাতা দিচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটি, এবিটিএ, এবিপিটিএ সহ শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন এই রাজ্য সরকারের সমস্ত অপযুক্তিকে খণ্ডন করেছে। ফলে প্রথমদিকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে যে ধোঁয়াশা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল তা দূর হয়ে যায়। সরকারি বঞ্চনার চিত্রটা যত স্পষ্ট হয়েছে, সমানুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে ক্ষোভ।
ক্ষোভ সৃষ্টিতে মহার্ঘভাতা বঞ্চনা প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করলেও, একমাত্র নয়। একদিকে বিপুল মূল্যবৃদ্ধির কারণে কর্মচারী ও শিক্ষকদের ওপর কাজের বোঝা চাপিয়ে, অন্যদিকে রাজ্যের শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীরা হন্যে হয়ে কাজের সন্ধান করছে। যার মধ্যে কর্মচারী ও শিক্ষক পরিবারের সন্তানরাও রয়েছে। স্থায়ী পদে অনিয়মিত কর্মচারীদের নিয়োগ করে নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করানো হচ্ছে। কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার বালাই নেই। এঁদের মধ্যেও বহু কর্মচারী ও শিক্ষক পরিবারের সন্তান রয়েছে। তাছাড়াও পাশে বসেই কাজ করছেন এমন অনিয়মিত কর্মচারীর যন্ত্রণাও সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এই সমস্ত কিছুর যোগফল হলো ‘অবজেকটিভ’ পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন। যা ২০১২ বা ২০১৪ সালে ঠিক এই জায়গায় ছিল না।
গত কয়েক বছরে, বিশেষত, কোভিডের সময় থেকেই রাজ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। করপোরেট মিডিয়ার তৈরি ‘বাইনারি’-র মোহজাল ভেঙে জীবন-জীবিকার তিক্ত অভিজ্ঞতায় মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করেন। পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের উত্তাপ পৌঁছায় প্রশাসনের অভ্যন্তরে। কর্মচারী ও শিক্ষকরা বেশি বেশি সংখ্যায় প্রশাসনের মধ্যে দমবন্ধ করা পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করেন। প্রশাসনের ভিতরে ও বাইরে ‘গণতন্ত্র’-র প্রসঙ্গটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বৈরশাসক ইতিহাস স্বীকৃত কায়দায় আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে বিরুদ্ধ বর্গকে দমাতে চেয়েছে। কিন্তু ফল হয়েছে বিপরীত।
‘অবজেকটিভ’ পরিস্থিতির এই পরিবর্তনকে সঠিকভাবে উপলব্ধিতে রেখেই সাবজেকটিভ তথা সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে শ্রমিক-কর্মচারী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা। নিজ নিজ সংগঠনের ধারাবাহিক কর্মসূচির পাশাপাশি যৌথ আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। মিছিল, সমাবেশের পরে ধাপে ধাপে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচির অভিমুখে অগ্রসর হয় যৌথ আন্দোলন। প্রথমে দু’ঘণ্টার কর্মবিরতি, পরবর্তীতে দু’দিনব্যাপী কর্মবিরতি (২০-২১, ফেব্রুয়ারি) এবং সর্বোপরি চূড়ান্ত আঘাত ১০ মার্চ সর্বাত্মক ধর্মঘট।
কর্মবিরতির কর্মসূচিতে কর্মচারী ও শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছিল তাঁরা আরও বড়ো লড়াইয়ের জন্য মানসিকভাবে তৈরি। এমনকী তাঁদের মধ্যে থেকেই দাবি উঠে আসছিল। ইতিমধ্যেই শিক্ষক ও কর্মচারীদের একই লক্ষ্যে পরিচালিত একাধিক মঞ্চ কাছাকাছি আসতে থাকে। পরিস্থিতির দাবিই ছিল তাই। ফলে বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিতে ষাটটিরও বেশি সংগঠন যৌথভাবে ধর্মঘটের ডাক দেয়। শুধুমাত্র রাজ্য প্রশাসনের অভ্যন্তরে সর্বশেষ ধর্মঘট হয়েছিল ১৯৭০ সালে। তিনদিনের ওই ধর্মঘট ছিল শুধুমাত্র রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের। দীর্ঘ পাঁচ দশক পরে আবারও ধর্মঘট। তবে শুধুমাত্র রাজ্য প্রশাসনে নয়, এবারে রাজ্য কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত সমস্ত অংশের যৌথ ধর্মঘট। যা পাহাড় থেকে সাগর এক অভূতপূর্ব ঐক্যের নজির সৃষ্টি করল। কলকাতাসহ রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় প্রশাসনিক দপ্তর, বিদ্যালয়, পঞ্চায়েতের অফিসগুলিতে সিংহভাগ কর্মচারী ও শিক্ষক ধর্মঘট করেছেন। বেতনকাটা, ডাইস-নন ও ব্রেক সার্ভিসের ভয় দেখিয়ে এবার আর ধর্মঘট আটকাতে পারেনি রাজ্য সরকার ও শাসকদল। এমনকী ধর্মঘটের পরেও শাসকদলের গুন্ডাবাহিনীর হুমকিরও মোকাবিলা করা হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে। প্রশাসনের শো-কজের জবাবেও ‘আইন মেনেই ন্যায্য দাবির পক্ষে ধর্মঘট করেছি’ - বলে সরাসরি জবাব দিচ্ছেন কর্মচারীরা। প্রসঙ্গত, বামফ্রন্ট সরকারই কর্মচারী ও শিক্ষকদের ধর্মঘটের অধিকার প্রদান করেছিল। ১০ মার্চের ধর্মঘট আরও বড়ো ও দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মঞ্চ প্রস্তুত করে দিল।