৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯
দুর্নীতি ঢাকার চেষ্টায় মুখ্যমন্ত্রীর আবোল তাবোল
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করলেন আইনজীবী সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। বিচারপতি টি. এস. শিবজ্ঞম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ বিকাশ ভট্টাচার্যকে জানিয়েছে মামলা গ্রহণ হতেই পারে। সম্প্রতি আলিপুরে স্বাধীনতা সংগ্রামী অরবিন্দ ঘোষের মুর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘কারও চাকরি কেড়ে নেবেন না।’’ প্রসঙ্গত, হাইকোর্টে নিয়োগ সংক্রান্ত কারচুপি প্রমাণিত হওয়ায় শিক্ষা দপ্তরের বেশ কিছু চাকরি বাতিল হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কার্যত দুর্নীতিগ্রস্তদের পাশেই দাঁড়ালেন মমতা ব্যানার্জি বলে মনে করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘কারও চাকরি কেড়ে নেবেন না। চাকরি দেওয়ার মুরোদ নেই কেড়ে নেবার গোঁসাই।’’ তাঁর ওই বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই আদালত অবমাননার অভিযোগে ১৫ মার্চ মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) সাংসদ এবং আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘চাকরি খাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি নিজে। তিনি এই দুর্নীতির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’’ ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, টাকা দিয়ে চাকরি যারা কিনেছেন তারা কাটমানি খাওয়া তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের চেপে ধরলে পরিস্থিতি কোথায় যেতে পারে সেই আতঙ্কে ভুগতে থাকা মুখ্যমন্ত্রী চাপ সামলাতে না পেরে একথা বলে দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচাতে চাইছেন।
এর আগেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ক্ষেত্রে আঙুল উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের দিকেও। সব মিলিয়ে এই নিয়োগ জালিয়াতির পেছনে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। কার্যত রাজ্যের স্কুলস্তরের শিক্ষক নিয়োগের সব ক্ষেত্রে দুষ্কৃতী-দুর্নীতি যোগ স্পষ্ট। মমতা ব্যানার্জির ভাইঝি বৃষ্টি মুখার্জির চাকরি গেছে বেআইনিভাবে চাকরি পাওয়ার অভিযোগে। এই পরিস্থিতিতে ১৪ মার্চ আলিপুরে স্বাধীনতা সংগ্রামী অরবিন্দ ঘোষের মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘কারও চাকরি কেড়ে নেবেন না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর নজিরবিহীন বক্তব্যের পরই বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র সমালোচনা উঠে আসছে। প্রশ্ন উঠেছে, যাঁরা যোগ্য হয়েও চাকরি পেলেন না জালিয়াতির শিকার হয়ে, রাস্তায় বসে ৭৩৪ দিন ধরে আন্দোলন করেছেন, তা’হলে তাঁদের কী হবে? প্রসঙ্গত, পার্থ চ্যাটার্জির চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তি রয়েছে এই দুর্নীতির পিরামিডের মাথায়, একথা ইডি ইতিমধ্যেই জানিয়েছে আদালতে।
ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘সিপিএমের লোকেরাও সরকারি চাকরি পেয়েছে। কিন্তু আমি তো তাঁদের চাকরি খাইনি। তাহলে তোমরা চাকরি খেতে চাইছ কেন?’’ তিনি আরও বলেন, চাকরি চলে যাওয়ার ফলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন বেশ কয়েক জন। উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে এরপরই আদালতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘এদের আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত।’’ তবে একই সঙ্গে মমতা এবং তাঁর মন্ত্রীরা এদিন দাবি করেছেন, দুর্নীতিকে সমর্থন করে না তৃণমূল! যদিও জালিয়াতি এবং দুর্নীতির অভিযোগ করে নিয়োগ বঞ্চিতরা চাকরির দাবি তুললেও আমল দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। বরং আদালতে এই অসহায় নিয়োগ বঞ্চিতরা বিচার চাইতে গেলে তদন্ত আটকাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। অন্যদিকে ইডি-সিবিআই’র তদন্ত সূত্রে শাসক ঘনিষ্ঠ নানামাপের, নানা সম্পর্কের নাম উঠে আসছে প্রতিদিন। চলছে গ্রেপ্তারি।
বিকাশ ভট্টাচার্য আরও বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ভাবতে পারেননি যে সবটা প্রকাশ্যে চলে আসবে। এই দুর্নীতি উদ্ঘাটনে বামপন্থী আইনজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। তাই মমতা ব্যানার্জির রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে ‘সিপিএম’কে।’’
সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, নিয়োগ দুর্নীতির সরাসরি সুবিধাভোগী হলো তৃণমূলের নেতারা। দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর কাছে সেই প্রসাদের ভাগ পৌঁছেছে, সমানে জোরালো হচ্ছে এই অভিযোগ। কিন্তু প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার দুর্নীতি যে তৃণমূলের মেশিনারির জোরেই, তা স্পষ্ট। লকডাউনকে হাতিয়ার করে করুণাময়ীর দপ্তর থেকে হাতে হাতে চাকরির নিয়োগপত্র বিলি করা হয়েছে। জেলে রয়েছেন মমতা ব্যানার্জির শিক্ষাদপ্তরের কুড়িজনেরও বেশি আধিকারিক।
বিকাশ ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘‘মমতা ব্যানার্জি যদি এতই শোকে আকুল হয়ে পড়েন, তাহলে তিনি শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন না কেন? নতুন চাকরি তৈরি এবং নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলছেন না কেন তিনি? আদালত তো চাকরি দিতে পারবে না, চাকরি দিতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজ্ঞপ্তি তো সিপিআই(এম) জারি করতে পারবে না। তিনি সেটা করছেন না কেন?’’
এদিকে ১৪ মার্চ সাংবাদিক সম্মেলন করে কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু ব্যানার্জিকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করল তৃণমূল। নিয়োগ দুর্নীতিতে কুন্তল এবং শান্তনুকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে ইডি। কুন্তল তৃণমূলের যুব নেতা। শান্তনু হুগলি জেলার স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ। তৃণমূল কংগ্রেস অভিযুক্তদের সমর্থন করে না - পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সাসপেন্ড করার উদাহরণ তুলে ধরে এই দুজনকে বহিষ্কার করার কথা ঘোষণা করা হয়। এই দুজনকে সাসপেন্ড করলেও অনুব্রত মণ্ডল, মানিক ভট্টাচার্যদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিল না তৃণমূল। রাজ্যের দুই মন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং শশী পাঁজা সাংবাদিক সম্মেলন করে এই ঘোষণা করেন।
নিয়োগ দুর্নীতিতে কুন্তল এবং শান্তনুকে গ্রেপ্তার করেছে ইডি। স্কুলের নিয়োগে টাকার বিনিময়ে চাকরি দুর্নীতিতে সরাসরি যোগের তথ্য আদালতে এই দু’জনের বিরুদ্ধেই পেশ করেছে ইডি। তারপরও কেন জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ পদে শান্তনু, এই প্রশ্ন তুলে ১৩ মার্চ ডিওয়াইএফআই ঘেরাও করেছিল চুঁচুড়ায় হুগলি জেলা পরিষদের দপ্তর।
১৩ মার্চ আদালতে ইডি দাবি করে যে, শান্তনুর মোবাইল ফোন থেকে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ইডি’র বয়ান অনুযায়ী, ‘এমন সব নাম রয়েছে জানলে চমকে উঠতে হবে’। তৃণমূলের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে শান্তনু এবং কুন্তল দু’জনকেই দেখা গিয়েছে। অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গেও তাঁর একাধিক ছবিও দেখা গিয়েছে। যদিও সুজয় ভদ্র বলেছেন তার বস অভিষেক ব্যানার্জি ধরা ছোঁয়ার বাইরে।