৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯
প্যালেস্তাইন মুক্তিসংগ্রামের ৭৫ বছর পূর্তিতে কলকাতায় সংহতি সভা
প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে জায়নবাদী আক্রমণের কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ
প্যালেস্তাইন সংহতি সভায় বক্তব্য রাখছেন রবীন দেব।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ প্যালেস্তাইনের সংগ্রামী জনগণের প্রতি সমর্থন ও সংহতি দৃঢ়তর করতে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় শক্তিগুলিকে আরও জোটবদ্ধ হবার আহ্বান ঘোষিত হয়েছে কলকাতার সংহতি সভায়। গত ১০ মার্চ রামমোহন লাইব্রেরি প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত এই সভা থেকে প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি আন্দোলনকে গণ আন্দোলনের রূপ দেবার আহ্বান জানানো হয়েছে। সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা (এআইপিএসও)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ডাকে এই সংহতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় বক্তব্য রাখেন এআইপিএসও-র অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ভানুদেব দত্ত এবং শমীক লাহিড়ী। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সর্বভারতীয় নেতা রবীন দেব।
সভায় মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অঞ্জন বেরা। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘‘প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে জায়নবাদী বর্বরতার চরম হিংস্ররূপ দেখছে বিশ্ববাসী। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২২) বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’র নেতৃত্বাধীন কট্টর জায়নবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি সামরিক হানা তীব্রতর হয়েছে। নেতানিয়াহু সরকার প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাংক এলাকাকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার হুমকি দিয়েছে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর থেকে ওয়েস্ট ব্যাংক এলাকা ইজরায়েলেরই দখলে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘের কোনো প্রস্তাবই ইজরায়েল মানতে নারাজ। ইজরায়েল অধিকৃত এলাকায় একদিকে প্যালেস্তিনীয়দের উপর চলছে নির্বিচার হত্যাভিযান,বাস্তুচ্যুত হচ্ছে হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয়; অন্যদিকে বেআইনিভাবে স্থাপন করা হচ্ছে ইহুদি জনবসতি একের পর এক। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাতেও দখলদারি বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে।প্যালেস্তাইনের অস্তিত্ব লোপাট করাই জায়নবাদীদের মূল লক্ষ্য।’’
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সাল প্যালেস্তাইনের মুক্তি সংগ্রামের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে ভারতেও বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। তারই অঙ্গ হিসেবে এদিন কলকাতায় এই সংহতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় উত্থাপিত প্রস্তাবে মোদি সরকারের লজ্জাজনক ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ইজরায়েলি হানাদারির নিন্দা করতেও এই সরকার অপারগ। এছাড়াও উল্লেখিত হয়েছে, ‘‘সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইজরায়েলের সঙ্গে গঠিত তথাকথিত মধ্য-প্রাচ্য ‘কোয়াড’-এ ভারত যোগ দিয়েছে। ভারতই হচ্ছে ইজরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা। নজরদারি সংক্রান্ত ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তি নাকি কেনা হয়েছে ইজরায়েল থেকে। ইজরায়েলি সংস্থা ভারতে ‘ফেক নিউজ’ ছড়িয়ে নির্বাচনী প্রচারেও হস্তক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ।’’
সভায় ভানুদেব দত্ত বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা বিশ্ব ইহুদিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এবং হিটলার-মুসোলিনির প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করেছিল। আজ সেই ইহুদিরা প্যালেস্তিনীয়দের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতারিত করছে, তাদের উপর নৃশংস আক্রমণ চালাচ্ছে। প্যালেস্তাইনের জনগণ ও ইজরায়েলিদের বিরোধকে সাম্রাজ্যবাদ জিইয়ে রাখতে চায় যাতে পেট্রোলের উপর দখলদারি ও সুয়েজ খালের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। প্যালেস্তাইনের ভৌগোলিক, সার্বভৌমত্ব ও পুনর্বাসনের সমস্যার সাথে তাদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের সমস্যা রয়েছে। তাদের নির্বিচারে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তারা কোথায় যাবে? এর সাথে রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধান না করে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান করা যাবেনা। আজ ইজরায়েলকে অস্ত্র সজ্জায় জুড়ে দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। প্যালেস্তাইনের সংগ্রামী জনগণের প্রতি সংহতি আন্দোলনকে আরও তীব্র করার আহ্বান জানান তিনি।
শমীক লাহিড়ী তাঁর বক্তব্যে ১৯৪৭ সালে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে পৃথক প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ইজরায়েলের কট্টর জায়নবাদী সরকার রাষ্ট্রসংঘের একটা প্রস্তাবও মানছে না। ওরা একের পর এক প্যালেস্তাইনের এলাকা দখল করে নিচ্ছে। নানা জায়গায় এমনকী স্কুলেও বোমা বর্ষণ করছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৭০ জনের বেশি নিরীহ প্যালেস্তাইনবাসীকে হত্যা করেছে ইজরায়েলের উগ্র জায়নবাদী বাহিনী।
তিনি উল্লেখ করেন, হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকর এই জায়নবাদীদের প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই জায়নবাদীদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস একই কায়দায় চলছে। ইজরায়েলের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আধুনিক পৃথিবীর কোনো আইন মানছে না। ওখানে কয়েকটা কোম্পানি নিজেদের মুনাফার স্বার্থে তাকে সমর্থন করছে। এখানে যেমন নরেন্দ্র মোদির পাশে রয়েছে বিভিন্ন করপোরেট সংস্থা। তিনি বলেন, একটা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে, বৈষম্যমূলক এবং ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে ইজরায়েলের সৃষ্টি। চরম দক্ষিণ পন্থার উত্থান হয়েছে সেখানে। আমাদের দেশও চলছে একইভাবে।এদের লক্ষ্যই হচ্ছে ভাগ করো, যুদ্ধ করো। এই বিপজ্জনক দর্শনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে তীব্র করতে হবে। প্যালেস্তাইনের সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সংহতি আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
সভাপতির ভাষণে রবীন দেব বলেন, ২০০২ সালের ১০ মার্চ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের উপর হামলা চালিয়েছিল। সেই দিনটিকে স্মরণে রেখে চার দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্যালেস্তাইন সংহতি কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আজকের এই সভায় প্যালেস্তাইনের প্রতিনিধির আসার কথা ছিল। কিন্তু ভারত সরকার তাঁকে ভিসা দেয়নি। ইজরায়েলের বর্বরোচিত আক্রমণে প্রতিদিন প্যালেস্তাইনে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আজও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এরকম একটা ভয়াবহ অবস্থায় ওরা সেখানে হামলার মোকাবিলা করছে। তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্যালেস্তাইন প্রশ্নে রাষ্ট্রসংঘের বৈঠকে ১৯২টি দেশের মধ্য ১৩৯ দেশ প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। সেখানে ভারত সরকারের ভূমিকা লজ্জাজনক। অথচ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের চেয়ারম্যান হিসেবে ভারত প্যালেস্তাইনের পক্ষে ছিল। আর আজ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে। আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চাই। কিন্তু ইজরায়েল যখন বর্বরোচিত আক্রমণ করছে প্যালেস্তাইনের উপর তখন ভারতের উচিত তার নিন্দা করা। প্যালেস্তাইনের জনগণের প্রতি সংহতিতে আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জন্য ৬৪টা সংগঠন মিলিত হয়ে এআইপিএসও-র নেতৃত্বে সংহতি আন্দোলনে শামিল হয়েছে। এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান তিনি।
এদিনের সভার শুরুতে উত্থাপিত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। এদিনের সভা থেকে দাবি জানানো হয়েছে -
(১) রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব মতো সমস্ত প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের (৫০ লক্ষেরও বেশি) স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে দিতে হবে;
(২) প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইজরায়েলের তৈরি করা বর্ণবাদী প্রাচীর এবং সমস্ত অবৈধ বসতি ভেঙে ফেলতে হবে;
(৩) ইজরায়েলি কারাগার থেকে প্যালেস্তিনীয় রাজনৈতিক বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে;
(৪) রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব মতো প্যালেস্তাইন সমস্যার ন্যায্য সমাধানের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিতে ভারত সরকারকে সরব হতে হবে;
(৫) প্যালেস্তিনীয়দের প্রকৃত সমর্থন জানাতে হবে ভারত সরকারকে;
(৬) ইজরায়েল নীতি বদল না করা পর্যন্ত তার সঙ্গে সামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সম্পর্ক ছেদ করতে হবে ভারতকে।
সংহতি সভার সূচনায় সংগীত পরিবেশন করেন কাজি কামাল নাসের, আবৃত্তি পরিবেশন করেন রীনা দেব এবং স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন মন্দাক্রান্তা সেন।