৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯
পার্টি পত্রিকার গুরুত্ব
গৌতম দেব
কমিউনিস্ট আন্দোলনে পত্রিকার ভূমিকা এবং গুরুত্ব অপরিসীম। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পার্টি পত্রিকা পার্টি সমাজে বিশেষ সম্মান, লেখা ও পড়ার বিশেষ তাগিদ সহ অন্যান্য বুর্জোয়া সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে এবং বিশেষ করে কঠিন দিনে পার্টি সংগঠকের ভূমিকা নিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে মার্কস-এঙ্গেলসের কথা বাদ দিলে, লেনিনের ভূমিকাই প্রধান এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়। এছাড়া বিষয়টি যে বহুবিধ লক্ষ্যে চালিত, সময়ের সাথে সাথে মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অবিকৃত রেখে, সঙ্গে নিয়ে চলা আরও অনেক সহযোগী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে চলা পত্রিকার তত্ত্ব নিয়ে পার্টির তত্ত্বের চাইতে কম বিতর্ক এবং বিরোধ কমিউনিস্ট আন্দোলনে হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে পার্টি নেতৃত্ব দখল করার চাইতে পত্রিকার পরিচালনার ভার হাতে নিতে তৎপরতা অনেক বেশি। নেতৃত্বের স্তরে ভোট পর্যন্ত করতে হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পার্টির মতাদর্শগত-রাজনৈতিক বিরোধ ফুটে উঠেছে পত্রিকার লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এরকমই কিছু কিছু তৎপরতা রুশ বিপ্লবের সাফল্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। আবার ইয়োরোপের পশ্চিমাংশে এগিয়ে থাকা অনেক দেশে বিপ্লব আজও হতে পারেনি। তাদের নাবালকত্ব আজও কাটেনি।
কিন্তু শুধু আমাদের মতে যে বিশ্বাসী নয় তাকে গালমন্দ করলেই সমস্যাটা মেটে না। কমিউনিস্টরা খোলা মন এবং চোখ দিয়ে সবটা দেখতে চায় এবং তাতে যদি নিজেদের মনোভাবের কিছু পরিবর্তন করতে হয় সেই বিষয়েও একগুঁয়ে মনোভাব দেখায় না। বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ইতিহাস সঠিক কারণেই রুশ কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল এবং রুশ দেশে পার্টির অভ্যন্তরে যে জাতীয় বিতর্ক উঠেছে, আমরা অন্য দেশের কমিউনিস্টরা তাতে জড়িয়ে পড়েছি - সব ব্যাপারে একমত হই বা না হই। নীতিগতভাবে সেই বিতর্কে আমরা অংশ নিয়ে থাকি। এছাড়া আমাদের বোঝার দরকার যে, বিশ্বে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ৭০/৮০ ভাগ জন্মগ্রহণ করেছে রুশ বিপ্লবের পর। ফলত এর প্রভাব থাকবেই। এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রসারে যে অসম বিকাশ দেশে দেশে হয়েছে তাও খেয়াল রাখতে হবে - এই বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য। দেখা যাচ্ছে ভারতে এখন এক নম্বর ধনী ব্যক্তি আম্বানিরা থাকার জন্য বাড়ি করেছে সমুদ্রের জলের ধারে, যেখানে পাঁচ-ছটা হেলিকপ্টার নামতে পারে। প্যারি কমিউন যেভাবে হয়েছে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। জার্মানিতেও চল্লিশের দশকে যা হয়েছে - যদিও বিপ্লব সফল হয়নি, কিন্তু এদের প্রত্যেকের আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে, গণতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রশ্নকে সামনে রেখে ঘটেছে।
সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি মার্কিন দেশের ফ্লোরিডা থেকে ইট ছোঁড়া দুরত্বের দেশ কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো-চে গুয়েভারার নেতৃত্বে যে বিপ্লব বা ন্যাপামের ফুল বিছানো পথেঘাটে মার্কিনীদের পরাস্ত করে বিপ্লবকে সফল করা - সবারই পথ এবং বাস্তবতা আলাদা। এমনকী বাংলার ঘরে ঘরে আওয়াজ উঠল ‘তোমার নাম আমার নাম - ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম’। ‘ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’।
কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সব এমনভাবে চলে না যে, অনেক আগে থেকেই সমাজের পরিবর্তনের নির্দিষ্ট দিকগুলি চিহ্নিত করা যায়। বা যা যা চিহ্নিত করা যায় তার সবগুলি সেই পারম্পর্যে ঘটতে থাকে। ‘War is nothing but politics by other means!’ মনোজগতের ঈশান কোণেও কোনো কমিউনিস্ট এটা মনে করেননি যে, দুটো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার পর সমাজতান্ত্রিক দেশ নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করবে। কিন্তু যুদ্ধ হলো চীন রাশিয়ার মধ্যে। চীন ভিয়েতনামের মধ্যেও হলো। অবাঞ্ছিত এই দুই একটা ঘটনা বাদ দিলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি তাদের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তা না হলে ভাবুন আজ চীন প্রচার করে যাচ্ছে - সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের জনগণের এক বড়ো শত্রু। অথবা বিপ্লব-উত্তর রুশ নেতারা চীনের দিকে আঙুল তুলে অভিযোগ করছেন যে, চীন তাদের দেশে সমাজতন্ত্র ধ্বংস করে পুঁজিবাদকে ফিরিয়ে আনছে অথবা লেনিনের দেশে সমাজতন্ত্র ধ্বংস করছে।
সমাজতন্ত্র কী? কবে আমরা কাকে সমাজতন্ত্র বলব? আর কাকে বলব না। আজকের দিনে পুঁজিবাদ যে ফাটকা পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়েছে - এটা বোঝাতেই হবে। কারণ ইহাই সত্য। তাই তো ভারতের আদানি, আম্বানিরা দেশ ছাপিয়ে বিশ্বের সেরা ধনকুবের। এবং এরা কী এদের উৎপাদিকা শক্তির উন্নতির জন্য কোনো চেষ্টা করছে? সরকারের বহু কষ্টে নির্মিত বিমানবন্দর, নৌবন্দর খুবই সস্তায় কিনে নিচ্ছে। এরা exploitation-এর থেকে expropriation করতে বেশি দড়।
‘সমাজতন্ত্র কী’ এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা একটা সাধারণ ধারণা পেয়েছিলাম। তা হচ্ছে প্রাথমিক স্তরে সমাজতন্ত্র আর দ্বিতীয় স্তরে সমাজতন্ত্র যা খানিকটা প্রথম দিকের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সমাজতন্ত্র, যেহেতু দ্বন্দ্বতত্ত্বেও বা বহুত্ববাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বেও আদিম মানুষ থেকে মহাকাশে উপগ্রহে বসবাসকারী মানুষ পর্যন্ত সমাজটাকে একটা বিভাজনের মধ্যে নিয়ে এসেছে। ব্যাপারটা সামগ্রিকভাবে ঠিক। যদিও উপগ্রহ থেকে নেমে আসা মানুষ আমাজনের জঙ্গল দিয়ে যখন গভীরে বেড়াতে যান, তখন যে জাতীয় প্রাচীন মানুষের সাথে তাঁরা কথাবার্তা বলেন তাতে dialectics বোঝালেও, এও এক সমাজভুক্ত এটা মানতে মন এবং বোধবুদ্ধি চায় না। কিন্তু তা হলেও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মার্কসবাদের সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত। একটা ছোট্ট পাখির বাসা বাঁধা থেকে শুরু করে ডাইনোসরের ধরাধামে আসা থেকে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া, এ সবই সমাজবিজ্ঞানের এই অমোঘ আলোকে ছাড়া বোঝা মুশকিল। পত্রিকা একে আরও শানিত করে তোলে। আরও দৃঢ় করে।
গণশক্তি, দেশহিতৈষী, নন্দন চলছে সেই সাথে আমাদের গ্রে ম্যাটারকে আরও তীক্ষ্ণ, তীব্র করছে। তাই বলতে ইচ্ছা করে সরোজদা, সুধাংশুদা, বিপ্লবদা, অনিলদা, অশোকদা, অনিরুদ্ধ, দেবু, পলাশ, অতনু ও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা পার্টির পত্রিকাগুলিকে সময়োপযোগী এবং তাত্ত্বিক বিতর্কগুলিকে আরও গভীরে নিয়ে গেছেন ও যাবেন এবং সম্প্রসারিত করবেন। আগামী দিনে এই বিশ্বাস আরও প্রসারিত করবেন বলে আমার বিশ্বাস। আশা করি দেশহিতৈষী আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।