৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত গণতান্ত্রিক কাঠামো তত্ত্ব ও তথ্য (তিন)
ঈশিতা মুখার্জি
২০১১ সালের পর গ্রাম বাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু গবেষণাপত্র আছে যেখানে কিছু জেলার কয়েকটি ব্লকের, গ্রামের সমীক্ষা করা হয়েছে। বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক কাঠামোর মূলে আঘাত করা হলো ২০১১ সালের পর তৃণমূল কংগ্রেস দলের শাসনকালে। গ্রামের মানুষের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ থাকলে তৃণমূল কংগ্রেস দলের শাসন যথাযথ হয় না। পরবর্তীকালে আমরা যে দুর্নীতির কথা জানি, তার বেশিরভাগটাই গ্রামবাংলার অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে। সম্পদ লুঠের কর্মসূচি গ্রামের মধ্যে গণতন্ত্র বজায় রেখে করা সম্ভব ছিল না। এছাড়া গ্রামে যে বাস্তুঘুঘুরা একটু একটু করে ফিরে আসছিল, তারাই তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনব্যবস্থা জোরদার করে। গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিজেপি-আরএসএস সরকারের কর্মসূচিতেও নেই। তাই দেশজুড়ে নিয়ম বদল করা হয়েছে প্রশাসনিক স্তরে। পরিকল্পনাই জলাঞ্জলি দেওয়া হলো, তো বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার পরিচালন তো বিসর্জন দিতেই হবে। এই দুই রাজনৈতিক দল পঞ্চায়েত পরিচালন ব্যবস্থা বলতে কী বোঝে তা এই দুটি দলের পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণ এবং বিশেষকরে পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের পর কেমন চলেছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়।
সংবিধানের ৭৩তম এবং ৭৪ তম সংশোধনীর এবার ত্রিশ বছর পূর্তি ।এবছর ভাবার কথা ক্ষমতা এবং সম্পদ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ কতটা করা গেল। আমাদের রাজ্য এমন একটি রাজ্য যা প্রথমের দিকেই এই বিকেন্দ্রীকরণ চালু করে। কিন্তু যে বাতাবরণ বা গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছিল; তা টিকে থাকল না। নির্বাচিত পঞ্চায়েতের চেয়ে আমলারা বেশি যোগ্য এবং গ্রামসভা থেকে ব্লক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো ২০১১ সালের পর। কেরালায় বাম শাসনে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে মানুষের অংশগ্রহণে মানুষের জন্য পরিকল্পনার কাজ আজও অসম্পূর্ণ। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়ণ রাজ্য সরকার থেকে প্রশাসনিকভাবে উপকৃত মানুষের কাছে চলে আসবে - এমন ধারণাই চালু হলো। এর ফলে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে যে কমিউনিটির ধারণা উঠে আসছিল, সেই ধারণা ভেঙে পড়ল। গ্রামের মানুষকে আর পরিকল্পনায়, প্রকল্প রূপায়ণে অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখা হয় না। তাকে ‘প্রকল্পের দ্বারা উপকৃত’ হিসেবে দেখা হয়। নিজেরাই নিজেদের প্রকল্প রূপায়ণ আর চিহ্নিত উপকৃতর (টার্গেটেড বেনিফিসিয়ারি) ধারণা সম্পুর্ণ পৃথক। একটায় গ্রামের মানুষের হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়; অন্যটায় হয় ঠিক তার বিপরীত - রাষ্ট্র এবং আমলা করে প্রকল্প রূপায়ণ গ্রামের মানুষ হয় প্রকল্প গ্রহীতা। বিজেপি সরকার পঞ্চায়েতের এই ধারণাই চালু করে রেখেছে; তৃণমূল কংগ্রেস দলও চায়নি মানুষের হাতে ক্ষমতা এবং সম্পদ দিতে। বর্তমান কেলেঙ্কারিগুলি এই সব প্রকল্প ঘিরেই। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে যে আর্থিক সমীক্ষা বেড়িয়েছে, সেখানেও পঞ্চায়েতের একমাত্র কাজ যা নির্দিষ্ট করা আছে, তা হলো কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়ণ, যদিও এ রাজ্যে তা আলাদা নামে চালু করা আছে। সমস্যা এই যে, এই কেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কেমন আছেন গ্রামবাংলার মানুষ তা জানার জন্য রাজ্য সরকার পরিসংখ্যান প্রকাশ করে না। কেন্দ্রের সরকারও বিশেষ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে না। তাই বিভিন্ন গবেষণা এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্য থেকে আমাদের জেনে নিতে হয় কেমন আছে গ্রামবাংলার মানুষজন।
২০১৭ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ঋণ দেয় ২১ কোটি মার্কিন ডলার। এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রকল্প রূপায়ণের জন্য। বিশেষ করে যে সব ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হয়েছিল তা সবকটি গ্রাম পঞ্চায়েত অর্থাৎ ৩৩৪২টি গ্রাম পঞ্চায়েতে ৯২,০০০ কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য। বিশ্বব্যাঙ্ক তখন এও জানায় যে - এই প্রকল্পগুলির মধ্যে ৫৪ শতাংশ ছিল পরিবহণ ক্ষেত্রে, ২৩ শতাংশ জল এবং নিকাশী ব্যবস্থায় এবং ২০ শতাংশ সরকারি ঘরবাড়ির ক্ষেত্রে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক আবারও ১২.৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়। কিন্তু প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে। এই ঋণ নিয়ে যে প্রকল্প রূপায়ণ করার কথা ছিল পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষায় জানা যায় যে, সেই প্রকল্পে উপকৃত মানুষের হাতে টাকা ভালভাবে পৌঁছয়নি যদিও খাবার এবং কিছু সামগ্রী কিনে দরিদ্র মানুষের কাছে ওই টাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক মানুষ, বিধবা এবং প্রতিবন্ধীদের পেনশন প্রাপ্তির প্রকল্প রূপায়ণ খুবই দুর্বল বলে ওই সমীক্ষা জানিয়েছে।সমীক্ষা আরও জানায় যে, উপকৃতদের চিহ্নিত করার কাজে ভীষণ দুর্বলতা সমস্ত প্রশাসনিকস্তরে রয়েছে।অর্থাৎ পঞ্চায়েতের সাথে গ্রামের মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজ্য সরকার ‘জয় বাংলা’ বলে একগুচ্ছ প্রকল্পকে বিশ্বব্যাঙ্কের এই ঋণ প্রকল্পের অন্তর্গত করবে বলে বিশ্বব্যাঙ্ককে জানিয়েছে। কিন্তু সরকারের আর্থিক সমীক্ষায় এই নিয়ে কিছুই বলা নেই। গ্রাম পঞ্চায়েতকে শক্তিশালী করার এই ঋণ যে গ্রামের মানুষের কাজে আসেনি, তা স্পষ্ট। ‘জয় বাংলা’ কথাটি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেলেও এটি যে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রকল্প তা কোথাও উল্লেখ নেই।
২০১১ সালের পর পঞ্চায়েতের কর্মসূচির স্বচ্ছতা ছিল না।পঞ্চায়েত পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ, তার কতটা ব্যয় করা গেল তার সেভাবে কোনো খতিয়ান রাজ্য সরকার কখনো দেয়নি। পঞ্চায়েতের বরাদ্দ অর্থ দিয়ে কী কী কর্মসূচি রূপায়ণ করা গেল,তারও খতিয়ান দেয় নি সরকার। সেইভাবেই বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থ কীভাবে ব্যয় হয়েছে তারও খবর পাওয়া যায় না। ঠিক এই সব কারণেই পঞ্চায়েতের উপর গ্রামের মানুষের ভরসা ক্রমেই কমে গেছে।
বামফ্রন্টের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েতের কর্মসূচি নিয়ে সেভাবে গবেষণাপত্র লেখা হয়নি। তার কারণ আছে। একটি হলো তথ্যের অভাব, তথ্য আছে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। সরকারি তথ্যের ভাণ্ডার কিছু নেই। দ্বিতীয় কারণ এই যে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যে ভাবে প্রকল্পগুলি নিয়ে দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে , এবং সেই দুর্নীতি ঢাকার জন্য হিংসা, হুমকি এবং খুনোখুনির পরিবেশ মানুষের মধ্যে কোনরকম সমীক্ষা করার পক্ষে খুব সঠিক পরিবেশ নয়। তবুও স্বল্প হলেও কিছু সমীক্ষা হয়েছে। সেই সমীক্ষা হয়েছে মূলত বর্ধমান, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং আরও সামান্য কয়েকটি জেলার কয়েকটি গ্রামে। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে হিংসার বাতাবরণ ছিল, পঞ্চায়েতের মধ্যে যে দুর্নীতি এবং হিংসার চক্র কাজ করেছে, তা কার্যত মানুষকে পঞ্চায়েতের থেকে সরিয়ে দিয়েছে। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় জানা যায় যে, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে উন্নয়নের কাজ হবে এমন বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষের বেশিরভাগেরই হয় অল্প, নয় একেবারেই বিশ্বাস নেই। অন্য একটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামের মানুষ সবথেকে বেশি ভয় পাচ্ছে হিংসার। এই গবেষণাপত্রগুলি স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার মূল যে কেন্দ্র - মানুষের অংশগ্রহণে পরিকল্পনা রূপায়ণ - সেই জায়গাতেই আঘাত এসেছে। মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিয়েছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। পঞ্চায়েতের সঙ্গে গ্রামোন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সেই যোগাযোগকেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করে দেশের অর্থনীতি চালাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতি আর হিংসা মিলিয়ে গ্রামের মানুষের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, প্রয়োজন বা চাহিদা জানানোর ক্ষমতা এবং পঞ্চায়েতকে নিজেদের জায়গা বলে ভাবার ক্ষমতা। এমনিতেই নয়া উদারীকরণ কমিউনিটি উন্নয়নের ধারণার পরিবর্তন করেছে; গ্রামোন্নয়ন বা যে কোনো উন্নয়নের ধারণা হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তৃণমূল কংগ্রেস সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নয়নের ধারণাকে আরও পরিবর্তন করে গ্রামের মানুষকে দেখল প্রকল্প গ্রহীতা হিসেবে। সরকার উপকার করবে পঞ্চায়েতকে উপলক্ষ করে এবং উপকৃত মানুষ বা বেনিফিসিয়ারি তালিকা অনুযায়ী সেই প্রকল্পের বরাদ্দ গ্রহণ করবে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি মানুষকে বেনিফিসিয়ারি হিসেবেই দেখে। মানুষের পরিকল্পনা রূপায়ণে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা সেখানে আসে না। অর্থাৎ পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল গোড়ার দিকে, সেই সুযোগ আজ আর নেই। যদি পরিকল্পনার অর্থনীতি রাজ্যে টিকিয়ে রাখা যায়, তবেই এই সুযোগ কিছুটা হলেও পাওয়া সম্ভব, যেমন আছে কেরালায় বামপন্থী সরকারের শাসনে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায়।
মানুষকে বেনিফিসিয়ারি হিসেবে দেখেও তো মানুষের কিছু উপকার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অন্য কয়েকটি রাজ্যের পঞ্চায়েত যারা বামশাসনে ছিল না এবং পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ভূমিসংস্কার বা গ্রামোন্নয়ন দেখে নি, সেখানে শুধুমাত্র বেনিফিসিয়ারি হিসেবে দেখেও তো গ্রামের মানুষের উপকার করেছে পঞ্চায়েত। কেন তা হলো না তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায়? পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বামফ্রন্টের সময়ে প্রসিদ্ধ হয়েছিল; বলা হতো গ্রামের মানুষের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে ২০১১ সালের পর যে শ্রেণিমিত্রের সহযোগিতায় গ্রামে প্রভাব বিস্তার করল তৃণমূল সরকার তা কোনমতেই গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করে নি। কাজ করার কথাও ছিল না। গ্রামে কৃষি ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ল। অকৃষি উৎপাদনের কাজেও গতি অনেক কমে গেল। গ্রাম থেকে মানুষ অন্য রাজ্যে যেতে শুরু করল কাজের খোঁজে। ২০০৮-০৯ থেকেই এই পরিযায়ী শ্রমিকের অন্য রাজ্যে যাওয়া বেড়ে গিয়েছিল। ২০১১ সালের পর তা আরও বেড়ে গেল। গ্রামে দুর্বৃত্তরা ফিরে আসতে শুরু করল এবং সীমান্ত দিয়ে গোরুপাচার, কয়লাপাচার সহ দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করল। এই সবটাই হলো গ্রামের পঞ্চায়েতকে ভিত্তি করেই। তাই পঞ্চায়েত দখল করতে মরিয়া শাসকদল পঞ্চায়েত নির্বাচনে নামিয়ে এনেছিল হিংসা। বিকল্প হলো আবার গ্রামের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামোন্নয়নের কাজ সংগঠিত করা। বিভিন্ন জেলার চিত্র দেখলেই বোঝা যায় যে, গ্রামোন্নয়নের কাজ কীভাবে অগ্রাধিকারের পিছনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েতকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থই হলো গ্রামোন্নয়নের অগ্রাধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়া।
(ক্রমশ)