E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯

বিপর্যয়ের উপান্তে বাংলার শিক্ষা... আসন শূন্য আজি (দুই)

সুকুমার পাইন


(গত সংখ্যার পর)

তোমরা আমাদের টাকা দাও, আমরা তোমাদের চাকরি দেব...

১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ৬-৭ হাজার শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন। এরপর থেকে কোনো বছরেই আর নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়নি। যাও বা হয়েছে, তাও দুর্নীতিতে আপাদমস্তক কলঙ্কিত, যার জেরে আজ সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সুবীরেশ চট্টোপাধ্যায়, প্রাইমারি বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য আদি ক্রিমিনালরা আজ জেলে।

এই সময়কালে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে অজস্র মামলা হয়েছে যেগুলির সূত্রে জানা গেল, কারচুপি করে কম নম্বরের পরীক্ষার্থীদের তালিকায় শীর্ষে রাখা হয়েছে এবং নিয়োগ করা হয়েছে, এমনকী পরীক্ষায় পাশ করেনি এমন প্রার্থীদেরও নিয়োগ করা হয়েছে। শাসকদলের নেতারা নিজ আত্মীয়-পরিজনদের নিয়োগ করেছেন। অর্থের বিনিময়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। এখন সেই সমস্ত ঘুষের কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছে এক একজনের ঘর থেকে।

যেটুকু নিয়োগ হয়েছে, তার মধ্যে আর্থিক বেনিয়ম ছাড়া অন্য অনিয়মও ছিল। কখনো কাজে যোগ দিতে গিয়ে প্রার্থী দেখেছেন, ওই একই পদে নিয়োগের জন্য একাধিক নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে, আর তাঁর পদে আগেই কেউ যোগ দিয়েছেন, নয়তো বা দেখেছেন, যে স্কুলে যে বিষয়ে নিয়োগপত্র পেয়েছেন সেই স্কুলে ওই বিষয়টিই নেই।

এই অব্যবস্থার ফলে স্কুলে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। অনেক স্কুল আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ করে সামাল দেবার চেষ্টা করেছে, সবটা পারেনি।

যাও যেথা যেতে চাও...

আর স্কুলে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগে এই চূড়ান্ত অরাজকতার যোগ্য দোসর হলো ট্র্যান্সফার প্রকল্প। ১ মার্চ, ২০১১ তারিখের 233-L নং নির্দেশনামা - যা কি না আসলে স্কুল সার্ভিস কমিশন আইনের ২০১০ সালের দ্বিতীয় সংশোধন - সেই নির্দেশনামা অনুসারে শুরু হলো মিউচুয়াল ট্র্যান্সফার, তারপরে ১১ জুলাই, ২০১৩ তারিখের 1097-L নং নির্দেশনামা - যা কি না আবার আসলে স্কুল সার্ভিস কমিশন আইনের ২০১৩ সালের সংশোধন - সেই অনুসারে শুরু হলো জেনারেল ট্র্যান্সফার। ২০১৫ সাল নাগাদই নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে, যে ট্র্যান্সফারের ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হচ্ছে, এক একটি ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত-আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত। সরাসরি অভিযোগ ওঠে স্কুল সার্ভিস কমিশন আর উচ্চশিক্ষা দপ্তরের আধিকারিক আর কর্মীদের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে ট্র্যান্সফারের প্রক্রিয়াটি অনলাইন হয়ে যায়, আর তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় উচ্চশিক্ষা দপ্তরের কমিশনারকে। আর তার আগে, ২০১৬ সাল থেকে কোনো অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ মিউচুয়াল ট্র্যান্সফারের ক্ষেত্রে ক্যাটেগরি মানা বন্ধ করে দেওয়া হলো। শুরু হয়ে গেল চূড়ান্ত বেনিয়ম। ভূগোলের শিক্ষিকা ট্র্যান্সফার পেলেন এমন স্কুলে, যেখানে ভূগোলের শূন্যপদ নেই। ইকনমিক্সের শূন্যপদে আবেদন করেও শিক্ষক পাওয়া গেল না, এলেন ইতিহাসের শিক্ষক, যে বিষয়ে শূন্যপদ নেই। এই ট্র্যান্সফার নিশ্চয়ই ছাত্রছাত্রীদের তথা শিক্ষাব্যবস্থার স্বার্থে নয়।

তারপরে এলো উৎসশ্রী। আবেদনমাত্রেই ট্র্যান্সফার। গত বছর পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক এই প্রক্রিয়ায় ট্র্যান্সফার নিয়েছেন। আর এর নিট ফল কী হয়েছে? শিক্ষকের ‘প্রয়োজনকে’ অগ্রাধিকার দেবার নামে বিশেষত গ্রামাঞ্চলের একাংশের বিরাট সংখ্যক স্কুল আর তার ছাত্রছাত্রীদের বঞ্চিত করে বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে সুগম সকল নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন শহুরে স্কুলগুলিতে ট্র্যান্সফার করা হলো। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের বিরাট ফারাক সরকারি উদ্যোগেই তৈরি হয়ে উঠল। স্কুলের পঠন-পাঠনে নেমে এলো বিপর্যয়।

এই বিপর্যয়ের প্রকৃত চরিত্র বুঝতে আরও দুটি বিষয় নজরে আনা দরকার - স্টাফ প্যাটার্ন আর রোস্টার অফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

স্টাফ প্যাটার্ন হলো প্রত্যেকটি সরকারি, সরকার-পোষিত আর সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে সরকারের নিয়ম অনুসারে কত পড়ুয়া, তার নিরিখে বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি কোন বিষয়ে কতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকবেন তার হিসেব। সেকেন্ডারি স্কুলে এর ন্যূনতম সংখ্যা ১২। এই হিসেবের একটি-ওদিক করার কথা না। কিন্তু তা করা হলো।

রোস্টার অফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বলে আরও একটি নথি প্রত্যেক সরকারি, সরকার-পোষিত আর সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলেই ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার দপ্তর (তফশিলি জাতি আর জনজাতি উন্নয়ন দপ্তর) আর শিক্ষা দপ্তরের অনুমোদন করা থাকে। সরকারের ওই তফশিলি জাতি আর জনজাতি উন্নয়ন দপ্তরের নির্দেশ অনুসারে কোন স্কুলে কোন শূন্যপদে কোন ক্যাটেগরির শিক্ষক নিযুক্ত হতে পারবেন - জেনারেল, এসসি, এসটি বা ওবিসি ইত্যাদি - তা প্রতিটি ১০০ পদের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে (হান্ড্রেড পয়েন্ট রস্টার)। এই নিয়মও পরিবর্তন করা যায়না, অথচ এই বেআইনি কাজ করা হয়েছে।

এলোমেলো করে দে...

এলোপাতাড়ি ট্র্যান্সফারের ঠেলায় স্টাফ প্যাটার্নের মতো সেই রোস্টারও তছনছ হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছে সংরক্ষণের নিয়মকানুন। ২০১৬ সালেই ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার দপ্তর এইসব বেনিয়মি নিয়োগ রোস্টারে অনুমোদন করতে আপত্তি জানায়। কিন্তু শুনবে কে?

শিক্ষক নেই। ক্লাস হচ্ছে না। বিজ্ঞান বা কমার্স বিভাগগুলি উঠে যাচ্ছে। অভিভাবকেরা পড়ুয়াদের স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সরকার কী করছে?

১২ মার্চ, ২০১৮ তারিখে বেরলো 227-ES/S/1S-4/95 নং নির্দেশিকা, তাতে বলা হলো, বিভিন্ন স্কুলে যেমন যেমন শূন্যপদ রয়েছে, সেই অনুসারে সরকার দরকার মতো অন্যান্য স্কুল থেকে, যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন, সেখান থেকে যে শিক্ষককে ওই সব স্কুলের যেখানে যেখানে মনে করবেন সেখানে ট্র্যান্সফার করতে পারবেন, যাকে বলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্র্যান্সফার। আশ্চর্য! এই নির্দেশিকায় কাস্ট ক্যাটেগরি মেনে চলার কথা বলা হয়নি।

৪ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে মহামান্য আদালতে WPA 10184 of 2020 নামক একটি জনস্বার্থ মামলার রায়ে মহামান্য আদালত বিভিন্ন স্কুলে স্টাফ প্যাটার্ন আর ছাত্র শিক্ষক অনুপাতের নিরিখে শিক্ষক ‘প্রেরণের’ (মূল ইংরেজিতে allocation) নির্দেশ দেয়।

এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা দপ্তর তড়িঘড়ি এক বিরাট অংশের শিক্ষককে কিছু নতুন স্কুলে ‘প্রেরণ’ করলেন - হাঁসজারু বা বকচ্ছপের মতো সেই ‘প্রেরিত’ শিক্ষকেরা নিজ নিজ পূর্বের স্কুলেই নিযুক্ত রইলেন, সেখানকার স্টাফ প্যাটার্নের অন্তর্ভুক্ত রইলেন, সেখানকার ও এস এম এস-এ স্যালারি টেবিলে বহাল রইলেন, আর ক্লাস নিতে গেলেন ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরের কোনো অন্য স্কুলে।

এদিকে খোদ মুখ্যমন্ত্রী জনসভায় ঘোষণা করে দিলেন শিক্ষকের অভাব মেটাতে তিনি স্কুলে স্কুলে সিভিক টিচার নিয়োগ করবেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির এমন ধারা ছত্রে ছত্রে প্রয়োগ বোধহয় এখনও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও আরম্ভ করেনি।

‘এডুকেশন ক্যান ওয়েট...’

নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি দীর্ঘদিন ধরেই একটি দাবি জানিয়ে এসেছে - শিক্ষকদের শিক্ষা-বহির্ভূত কোনো দায়িত্বে নিযুক্ত না করতে। বিভিন্ন সময়ে বছরে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বাধ্য করা হয়, জনগণনার কাজেও তাঁদেরই ডাকা হয়। এতে পড়াশোনারই ব্যাঘাত ঘটে। বিদ্যালয়ের ভিতরেও তাঁদের নিয়মিত মিড-ডে মিলের বাজার, ভাঁড়ার, রান্না তদারকি আর হিসেবের দায়িত্ব সামলাতে হয়। পাঠ্যবই আর পোশাক বিতরণ তাঁরাই করেন। স্কুলের বাইরে বেরিয়ে স্কুলছুট ছাত্রদের হিসেব রাখাও তাঁদের ওপরেই চাপানো হয়। নিয়মিত ক্লাসের ওপর কোপ দিয়েই এই দায়িত্ব পালন করা হয়। তার ওপরে আছে সরকারের প্রচারমূলক সব সপ্তাহ, দিবস আর উপলক্ষ পালন-কলাচর্চা (যামিনী রায় পুরস্কার) প্রতিযোগিতা, নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ, ছাত্রছাত্রী সপ্তাহ, হরেক জন্মদিবস পালন, রাস্তায় হাঁটা পদযাত্রা, আর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক - শাসক নেত্রীর প্রচারমূলক সব কর্মসূচিতে ইন্ডোর স্টেডিয়াম বা রবীন্দ্রসদন ভরানো।

সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ভাবুন, পঠন-পাঠনের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কযুক্ত কাজকর্মগুলি সেরে শিক্ষাদানের সামগ্রিক দায়িত্ব একজন শিক্ষক কখন কীভাবে পালন করবেন?

এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার...

গত ১২ মার্চের পত্রিকায় একটা খবর চমকে দিয়েছিল - গত বছরের তুলনায় এ বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে গিয়েছে ৪ লক্ষ! খবরে প্রকাশ, এ বছরে রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ভরতি করেও প্রায় ২ লক্ষ ছাত্রছাত্রী শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেনি।

দেশের সর্বত্র মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বেড়েছে, এমনকী কেরালাও, যেখানে কোভিড রোগের সংক্রমণ ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অর্থাৎ কোভিডের ওপর দায় চাপালে হবে না। তবে একথা সর্বৈব সত্য যে, কোভিড রোগের সংক্রমণকালে স্কুলের কলেজের পড়াশোনা সময়োপযোগী পদ্ধতিতে চালু রাখতে এই রাজ্য সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। সারা দেশের মধ্যে বোধহয় এই রাজ্যেই স্কুল-কলেজ সবচেয়ে বেশি দিন বন্ধ ছিল।

আমাদের রাজ্যে ক্লাস হিসেবে তিন রকম স্কুল রয়েছে - প্রাইমারি স্কুল, জুনিয়র হাইস্কুল আর হাইস্কুল।প্রাইমারি স্কুলের চেহারা কী? ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে গণশক্তি পত্রিকার খবর, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন (আগে সর্বশিক্ষা মিশন) রাজ্যের মোট ৭২৫টি চক্র বা সার্কেলের ৭৪টি সার্কেলে, মানে প্রায় ১০শতাংশ অঞ্চলে, সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, কোভিড অতিমারীর আগে যা ছাত্রছাত্রী এই এলাকার স্কুলগুলিতে ছিল, তার মধ্যে অতিমারীর পরবর্তী সময়ে শুধু এটুকু জায়গা থেকেই ২৫,৬৪৬ জন পড়ুয়া স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। শিক্ষা দপ্তরের হিসেবে, ওই সময়ে রাজ্যে প্রি-প্রাইমারি থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা কমবেশি ৮০ লক্ষ থেকে ৭২ লক্ষে নেমে গেছে, মানে পড়ুয়া কমেছে কমবেশি ৮ লক্ষ, আর ৫৪,০০০ প্রাইমারি স্কুলের মধ্যে পড়ুয়ার অভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ২,০০০ স্কুল। চিন্তার বিষয় আমাদের রাজ্যে স্কুলের ঝাঁপ বন্ধ হওয়া আর পড়ুয়া কমে যাওয়া কোভিড অতিমারীর আগেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ২০২২ সালের মার্চে শিক্ষা দপ্তরের নথিতেই প্রকাশ গত দশ বছরে রাজ্যে প্রাইমারি স্কুল কমেছে ৭,০১৮টি। এই ঘটনা ঘটেছে মূলত দারিদ্র্য কবলিত এলাকাগুলিতে, যেখানে কাজের খোঁজে স্কুল ছেড়ে দেবার উদাহরণ বেশি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্কুল বন্ধ হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, ১,১৯২টি। তার পরেই রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, ১,০৪৭টি। পূর্ব মেদিনীপুরে এই সংখ্যা ৮৬৭। যত দিন গেছে, স্কুল বন্ধ হবার হার ক্রমশ বেড়েছে।

আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা। ২০১২ সালের মার্চ মাসে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ৭৮,০৪,৬৮৪, আর ২০২২ সালের মার্চে ওই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭১,৯৫,৭২৮, তার মানে কমল ৬,০৮,৯৫৬ জন। জুনিয়র হাইস্কুল আমাদের রাজ্যে মোট ৯৮০টি। ২০২১ সালের সরকারি হিসেব বলছে, তার মধ্যে ৬৪টি জুনিয়র হাই স্কুলই বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্র কম বা একেবারেই নেই বলে। আবার যে সব স্কুলে ছাত্র রয়েছে, সেখানে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক ভীষণ কম। ছাত্র আর শিক্ষকের অনুপাত ৭২:১। যে সব জেলায় জুনিয়র হাই স্কুলগুলির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ, তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া আর পূর্ব মেদিনীপুর।

আর হাই স্কুলগুলি কেমন আছে? ২০২১ সালে ১৬ নভেম্বর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে করা একটি সার্ভেতে জানা যায়, ৯০টি হাই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বাস্তবে শূন্য। প্রাইমারি, জুনিয়র হাই আর হাইস্কুল মিলিয়ে তাহলে সারা রাজ্যে শুধু ২০২১ সালেই ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে ৪০৯টি স্কুলে। পরিসংখ্যান বলে, প্রাইমারি, জুনিয়র হাইস্কুল সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে রাজ্যে মোট স্কুল ছিল ৯৭,৮২৮টি, ২০২০ সালে কমে হলো ৯৫,৭৫৫, ২০২১ সালে আরও কমে হলো ৯৫,১৫৩, আর শেষমেষ ২০২২ সালে মোট স্কুলের সংখ্যা দাঁড়াল ৯৪,৭৪৪টি।

স্কুলে স্কুলে শিক্ষকের অভাব। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের রিপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশে শিক্ষকের শূন্য পদের নিরিখে তৃতীয় - প্রাইমারি, জুনিয়র হাই আর হাই স্কুল মিলিয়ে মোট শূন্যপদ ১,১০,০০০। আর সে ৭০ ভাগই রাজ্যের গ্রামাঞ্চল তথা পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে। আবার এইসব শূন্যপদের একটা বড়ো অংশ হলো বিজ্ঞান শাখার বিষয়গুলিতে - ৩,১২৩টি শূন্যপদ গণিত বিষয়ে, ১,৭৯৫টি পদার্থবিদ্যায়, ১,৭৮৭টি শূন্যপদ রসায়ন বিষয়ে, আর জীববিদ্যা বিষয়ে ২,১৭৮টি। শহরে ৩০ জন ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক, গ্রামে ৭২ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক। খোদ মুখ্যমন্ত্রী বলছেন পড়া যাই হোক, বেশি বেশি নম্বর দিয়ে দাও। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার চক্রান্ত করেছে এই সরকার।

রাস্তার লড়াই লড়াইয়ের রাস্তা...

এই রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির একমাত্র পথ লড়াই।

এবিটিএ, এবিপিটিএ সহ শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের দাবি জানিয়ে বহুবার সভা-সমাবেশ পদযাত্রা হয়েছে। মিছিলে লাঠি চলেছে, শিক্ষকদের রক্ত ঝরেছে, সভায় পুলিশি নির্যাতন চলেছে, শারীরিক নিগ্রহ ঘটেছে। শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, হাজারো মানুষের প্রতিবাদে মুক্তিও দিতে হয়েছে।

আজকের সমস্যা শিক্ষক সমাজের একার নয়।সমগ্র সমাজের বিকাশের প্রশ্ন এর সাথে জড়িত। আজ তাই কেবল শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সমাজের কর্মসূচি নয়, ভুক্তভোগী সরকারি কর্মচারী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-ছাত্র-অভিভাবক এবং সমাজের সকল অংশের সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই না করলে কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না। আসুন, আপনি আমি আমরা সবাই সেই লড়াইয়ে শামিল হই।

(সমাপ্ত)