E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৭ মার্চ, ২০২৩ / ২ চৈত্র, ১৪২৯

মতাদর্শের চর্চা

ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (দুই)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


ভারতে প্রাচীন কাল থেকে দর্শন বিষয়ে বহু পুস্তক প্রণীত হলেও তার মোট সংখ্যা বলা সহজ নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভারতে একাদশ শতাব্দীর পর বৌদ্ধ মতবাদের প্রভাব দুর্বল হচ্ছিল অর্থাৎ ভারতে বৌদ্ধ মতবাদের বুদ্ধ-পরবর্তীকালের প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকারদের রচনাগুলি যখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছিল; কিন্তু সেগুলি তখন হারিয়ে যায়নি। সেগুলি টিকে ছিল চীনা, মঙ্গোলীয়, তিব্বতী ভাষায় অনুবাদের মধ্যে। এগুলির মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, তিব্বতী ভাষায় অনূদিত দুইটি সংগ্রহ সমগ্র যথা, ‘কবজুড়’ (Kavjur) ও ‘তনজুড়’ (Tanjur)-এর কথা। এই দুইটি সংগ্রহ সামগ্রীতে ছোটো বড়ো মাপের চার হাজার পাঁচশত-র বেশি (৪,৫০০) পুস্তক রয়েছে। তবে এটা ঠিক তিব্বতী মধ্যযুগের মঠগুলির বাইরে তিব্বতী চর্চার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত সাফল্যের ফলে এই পুস্তকগুলির অধিকাংশের পাঠও সম্ভব হয়নি। এগুলির অন্তর্বস্তু সম্পর্কে ধারণা স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠেনি। তবে, এটা বলাই যায় যে, এই পুস্তকগুলি দার্শনিক মর্মবস্তুর দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পরবর্তীকালের ভারতীয় বৌদ্ধ দার্শনিকদের সমালোচনায় স্ট্যাচারবাটস্কি, বিদ্যাভূষণ এবং অন্যান্য কয়েকজন দেখিয়েছেন যে, এই গ্রন্থগুলিতে বহুবিধ দার্শনিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যে সমস্ত গ্রন্থের আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি সমসাময়িক বিশ্ব দর্শনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় এবং দার্শনিক আলোচনা অত্যন্ত দক্ষতার প্রতিফলন ও উন্নত মানের। এই আলোচনাগুলিতে সমসাময়িক অন্যান্য দর্শন সম্পর্কিত আলোচনাও রয়েছে। এই পুস্তকগুলির সবই উন্নত মানের না হলেও অনেকগুলি যথেষ্ট উন্নতমানের।

কয়েক হাজার বছর পূর্ব থেকে পরিমাণগত দিক দিয়ে যেমন ভারতীয় দর্শনের বিকাশ ঘটছিল, সাথে সাথে গুণগত দিক দিয়েও ভারতীয় দর্শনের বিকাশ ঘটছিল। বস্তুবাদী ও ভাববাদী এই দুই দর্শনের অস্তিত্ব সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় দর্শনে বিরাজ করছে। বস্তুই আদি, মুখ্য ও সত্য এবং বস্তুকে আশ্রয় করে বিকাশের ধারায় চেতনার উদ্ভব ঘটেছে, এই তো হলো বস্তুবাদী দর্শনের মূল বক্তব্য। আবার ভাববাদী দর্শনের বক্তব্য হলো, ভাব বা চেতনাই আদি, মুখ্য ও সত্য এবং চেতনার চাহিদা অনুসারে বস্তুর উদ্ভব ঘটেছে। এই ধরনের দর্শনের দ্বন্দ্ব প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষ করা যায়।

যারা ভারতকে কর্মফলবাদের ভিত্তিভূমি হিসাবে বর্ণনা করেন তারা একপেশে চিত্র ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে উপস্থিত করেন। কর্মফলবাদের তত্ত্বর অর্থ পূর্বজন্মের কর্মফলের ভিত্তিতে জন্মান্তরের তত্ত্বের ওপর বিশ্বাস স্থাপন। পূর্বজন্ম, পরজন্মের তত্ত্বের ওপর বিশ্বাসই হলো কর্মফলবাদের ওপর বিশ্বাসের অর্থ। তাই তো ভারতকে বেদান্তের দেশ, ভাববাদের দেশ হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস লক্ষিত হয়। ‘আধ্যাত্মিকতাই ভারতীয় দর্শন’ এভাবে কয়েকজন প্রখ্যাত ভারতীয় দার্শনিকও ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতে প্রাচীনকাল থেকে যে বস্তুবাদী দর্শনের শক্তিশালী অস্তিত্ব রয়েছে এই সত্যকে অস্বীকার করা হয়।

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন ধারা

‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ যা জনৈক মাধব দ্বারা লিখিত, সেখানে ভারতে ষোলটি দর্শনের কথা উল্লিখিত হলেও সাধারণভাবে নয়টি দর্শনের অস্তিত্ব স্বীকৃতও বটে এবং বারে বারে উল্লিখিতও হয়। এই নয়টি দর্শন নিচে উল্লেখ করা হলো -
(১) লোকায়ত, যা চার্বাক বা বৃহস্পতি দর্শন নামেও অভিহিত; (২) বৌদ্ধ দর্শন; (৩) জৈন দর্শন; (৪) পূর্ব মীমাংসা; (৫) বেদান্ত (যাকে উত্তর মীমাংসাও বলা হয়); (৬) সাংখ্য; (৭) যোগ; (৮) ন্যায়; (৯) বৈশেষিকা।

বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো এই নয়টি দর্শনের মধ্যে প্রথম তিনটি দর্শন যথাক্রমে লোকায়ত দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন ও জৈন দর্শন হলো নাস্তিক দর্শন।

অন্য ছয়টি যথাক্রমে পূর্ব মীমাংসা, বেদান্ত, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ও বৈশেষিকা হলো আস্তিক দর্শন।

সাধারণভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী অর্থে আস্তিক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ঈশ্বর বিশ্বাসী নয় অর্থে নাস্তিক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ভারতের চিরায়ত দর্শনের দৃষ্টিতে আস্তিক বলতে ‘বেদ ও আনুষঙ্গিক দর্শনে আস্থাশীল’ এটাই বোঝায়। অন্যদিকে নাস্তিকের অর্থ হলো বেদের কর্তৃত্বে আস্থাহীনতা। পাশ্চাত্য দর্শনে দর্শনের বিরোধ আলোচিত হয় ভাববাদ ও বস্তুবাদী দর্শনের বিরোধের নিরিখে। পক্ষান্তরে ভারতীয় দর্শনে দার্শনিক বিরোধ আলোচিত হয় আস্তিকতা ও নাস্তিকতার বিরোধের মধ্যে। ভারতীয় দর্শনের ঐতিহ্য অনুসারে বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের প্রতি আনুগত্যই প্রাথমিক মানদণ্ড। এমনকী যদি কেউ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেও বেদের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় তবে তাকে আস্তিক বলা হয়। বেদের কর্তৃত্বের অর্থ হলো শাসক আশ্রিত ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব। অপরদিকে, ভাববাদের প্রচার করেও বেদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করলে নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ছয়টি আস্তিক দর্শনের মধ্যে বেদান্ত দর্শন ভাববাদ বা আধ্যাত্মিকতাবাদকে তুলে ধরে। ছয়টি আস্তিক দর্শনের বাকি পাঁচটি অর্থাৎ পূর্ব মীমাংসা, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন আস্তিক দর্শন হিসাবে স্বীকৃত হলেও শক্তিশালী বস্তুবাদী ধারণা বহন করে। ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী দর্শনের শক্তিশালী অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। ছয়টি আস্তিক দর্শনের পাঁচটি আস্তিক দর্শন হিসাবে স্বীকৃত হলেও শক্তিশালী বস্তুবাদী ধারণা বহন করে।

এবারে আমরা বেদ ও বেদের কর্তৃত্ববাদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।

(ক্রমশ)