৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০
অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের প্রদীপ জ্বালিয়ে এগিয়ে চলেছে ইনসাফ যাত্রা
হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য
ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে গত ৩ নভেম্বর কোচবিহার থেকে শুরু হয়েছে পায়ে হেঁটে ‘ইনসাফ যাত্রা’। পশ্চিমবঙ্গের সব জেলা অতিক্রম করে আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেডে সমাবেশের মাধ্যমে এই ‘ইনসাফ যাত্রা’-র সমাপ্তি ঘটবে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী লড়াই-আন্দোলনের ইতিহাসে এক অন্য মাত্রা যোগ হবে। ইতিহাস সাক্ষী আছে যখন সমাজ বিপদে পড়েছে, শাসকের অত্যাচার সীমাহীন হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদ তার তীক্ষ্ণ দাঁত, নখ নিয়ে অমানবিক হয়েছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি তার বিষবাস্প বাতাসে ছড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করেছে, তখন আমাদের রাজ্যের বামপন্থীরা কখনই চুপ করে থাকেনি। সময়ের সন্ধিক্ষণে, অন্ধকার রাস্তার বাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই লড়াই- আন্দোলনের ঐতিহ্যকেই বহন করে এগিয়ে চলেছে ‘ইনসাফ যাত্রা’।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ শাসকদলের নবজোয়ার যাত্রা দেখেছে। সেখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস, রাত্রি যাপনের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল তাঁবু (প্রতিদিন খরচ কয়েক লক্ষ টাকা), প্রশাসনের সবরকম সহযোগিতা, মানুষের থেকে পুলিশের সংখ্যা বেশি, লালবাতি ও সাইরেন লাগানো পুলিশের গাড়ির সারি সবই প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যবাসী। আর ‘ইনসাফ যাত্রা’ এগিয়ে চলেছে পায়ে হেঁটে, সাথে আছে প্রচারের জন্য একটি মাত্র ট্যাবলো। রাত্রে যেখানে যেমন স্থানীয় কমরেডরা থাকার ব্যবস্থা করছেন সেখানেই থাকছেন পদযাত্রীরা। হাঁটতে হাঁটতে তৃষ্ণা পেলে ভরসা স্থানীয় মানুষরা, নয়তো রাস্তার টিউবওয়েল। আর আছে প্রশাসনের সবরকম অসহযোগিতা। তাইতো কোচবিহার থেকে পদযাত্রা শুরুর আগের দিন বিকেলবেলা পুলিশ এসে মঞ্চ খুলে দেবার নির্দেশ দেয়। আর সবথেকে বেশি আছে পদযাত্রীদের প্রত্যয়, লড়াকু মেজাজ, হার না মানা মনোভাব।
আসলে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও খাতায়- কলমে বিরোধী দল বিজেপি’র (যারা কেন্দ্রের সরকারে আছে) মানুষমারা নীতির জন্য সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। পিঠ আর দেওয়ালের মাঝে আর কোনো ফাঁকই নেই। তার সাথে দুই শাসকের শারীরিক অত্যাচার, মানসিক নিপীড়ন, সমাজ-অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া এক দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। ন্যূনতম সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকার অধিকার নেই একটা বড়ো জনঅংশের মানুষের। প্রতিদিন বাড়ছে বেকারত্ব। তার সাথে বাড়ছে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ হয়ে বাইরে যাবার যুবদের সংখ্যা। এদের না আছে কোনোরকম সামাজিক নিরাপত্তা, না জানা আছে এদের সংখ্যা। গ্রামীণ কর্ম সংস্থানের মনরেগা (এমজিএনরেগা) প্রকল্প প্রতিদিন সংকুচিত করা হচ্ছে। এই অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেটেও বিজেপি এই প্রকল্পে প্রায় ৩৩ শতাংশ টাকা কম বরাদ্দ (আগের অর্থবর্ষের তুলনায়) করেছে। বরাদ্দ কমানো মানেই মোট কাজের দিনের সংখ্যা কমে যাওয়া। আর রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। ভুয়ো জবকার্ড তৈরি করে লক্ষ হাজার কোটি টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রকল্পে যারা অল্পবিস্তর কাজ পেয়েছেন তাদেরকেও নিজেদের মজুরি থেকে একটা বড়ো অংশের টাকা (কাটমানি) স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের দিতে হয়েছে। এইটাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে তৃণমূলের নেতারা। এই দুর্নীতির নামে এখন কেন্দ্রের বিজেপি’র সরকার এই প্রকল্পের বকেয়া টাকা আটকে রেখেছে, অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এরফলে ন্যায্য প্রাপকরাও বঞ্চিত হচ্ছে। যারা দুর্নীতি করলো তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক পদক্ষেপ কেন করা হচ্ছে না তার কোনো সদর্থক উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ বারো বছরে রাজ্যে একটাও শিল্প কারখানা হয়নি, কিন্তু হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে শিল্প সম্মেলন। আর সেইসব শিল্প সম্মেলন থেকে রাজ্যের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যা ভাষণ আর ভুয়ো প্রতিশ্রুতি শুনেছেন। আসলে সিঙ্গুরে যেভাবে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে (সেই সময় এদের সাথে সমস্ত অপশক্তি যুক্ত ছিল) ন্যানো গাড়ির কারখানা তাড়ানো হয়েছিল, তারপর কোনো শিল্পপতি আর এদের উপর ভরসা রাখেনি। বরং এই তৃণমূল সরকারের আমলে চালু থাকা শিল্প কারখানা (ছোটো, মাঝারি, বড়ো) বন্ধ হয়েছে। এক সময়ে আমাদের রাজ্যের গর্ব হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস এখন ধুঁকছে। যেদিন প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া ন্যানো গাড়ির কারখানাকে ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেদিন ডিওয়াইএফআই বলেছিল আসলে কর্মপ্রার্থী, আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন বাংলার যৌবন নিজের অভিজ্ঞতায় সেদিনের এই কথার সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছে। তৃণমূলের আমলে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি সামনে এসেছে। এই দুর্নীতির শেষ কোথায় সেটা কেউ বলতে পারছে না। প্রতিদিন নতুন দুর্নীতির ঘটনা সামনে আসছে। আদালতের বিচারকরা এই দুর্নীতির বহর দেখে কড়া পদক্ষেপের কথা বলেছেন অথচ সিবিআই যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সিবিআই’র তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে আদালতও উষ্মা প্রকাশ করেছে। কেন সিবিআই যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না সেটা এখন দিনের আলোর মতো মানুষের সামনে প্রকাশ পাচ্ছে। এসএসসি’র গ্রুপ ‘সি’ ও গ্রুপ ‘ডি’ -তে নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন বন্ধ। এখানে যতটুকু নিয়োগ হয়েছে সেটাও দুর্নীতিতে ভরতি। টাকার বিনিময়ে সাদা খাতা জমা দিয়ে তৃণমূলের বদান্যতায় অযোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছেন সেটা আজ প্রমাণিত। আদালতে মামলা চলছে৷ আর চলছে যোগ্য প্রার্থীদের রোদ, জল, শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কলকাতার রাজপথে বিক্ষোভ-ধরনা-অবস্থান। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে ঢাক, ঢোল পিটিয়ে চালু করেছিল ‘যুবশ্রী’ প্রকল্প ও এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক (আগের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের নাম পরিবর্তন করে)। ‘যুবশ্রী’ প্রকল্পের মাধ্যমে বেকারভাতা ও এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে শিক্ষিত বেকারদের চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল। দুটোই আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে চাকরির কোনো নাম গন্ধ নেই, আর অল্প কিছু যুবক যারা বেকারভাতা পেতেন তারা এখন বলছেন ও ডেপুটেশন দিচ্ছেন ভাতা নয় স্থায়ী কাজ দাও। ক্ষমতায় এসেই একশো শতাংশ কাজ করে দিয়েছি ভাষণ দেওয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দুয়ারে সরকার চালু করেছিলেন শেষ বিধানসভা নির্বাচনের আগে। শিবির করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেবার নাম করে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে দিয়ে ফর্ম ফিলাপ করানো হয়েছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেও এই দুয়ারে সরকার শিবির আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো ফর্ম ফিলাপের পর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা কতটা বাড়লো। কতজন নতুন মানুষের নাম বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা সহ বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত হলো। তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান এখনও কেউ আমাদের সামনে দিতে পারেনি। আসলে প্রায় কিছুই হয়নি এই দুয়ারে সরকার প্রকল্প থেকে। বেশিরভাগ মানুষই কোনো সুযোগ সবিধা পাননি। ফর্মগুলো বিডিও অফিসে পড়ে রয়েছে, প্রতিদিন ধুলোর আস্তরণ বাড়ছে। কিছুদিন পর ঠোঙা তৈরি হবে এগুলো দিয়ে। যারা ফর্ম ফিলাপ করে কোনো সুবিধা পেলেন না তারা বিডিও অফিসে হত্যে দিয়ে পরে থেকে এখন নিজেদের প্রতারিত মনে করছেন। ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই মুখ্যমন্ত্রীর সহাস্য ঘোষণা ছিল তার আমলে ‘পাহাড় হাসছে’, ‘জঙ্গল মহল’ হাসছে। তা কেমন হাসছে সেটা পাহাড় আর জঙ্গল মহলের মানুষ প্রতিদিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। পাহাড়ের যে বিমল গুরুংকে গ্রেফতার করবার জন্য তিনি উঠে পড়ে লাগলেন ও একজন পুলিশ অফিসারের প্রাণ চলে গেল বিমল গুরুংকে ধরতে গিয়ে, সেই বিমল গুরুং বিধানসভা নির্বাচনের আগে হয়ে গেলেন তার অন্যতম কাছের মানুষ। দুটো ফুটবল টুর্নামেন্ট করে, মাওবাদী তকমাধারী তৃণমূলের কয়েকজন খুনিকে পুর্নবাসনের নামে চাকরি পাইয়ে দিয়ে যিনি বলে দিলেন জঙ্গল মহল হাসছে তিনি চেষ্টা করেছিলেন মেলা, খেলা করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদিবাসী, জনজাতি, বনবাসী প্রান্তিক মানুষকে তিনি ভুলিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু সেটা আর পারছেন না। জঙ্গলমহলের মানুষ তৃণমূলের এই মিথ্যাচার ধরে ফেলেছে। নিজেদের জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সরকারি বঞ্চনার বিরুদ্ধে এরাও বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরব হয়েছেন। ঘোষণার ‘হাসি’-র আড়ালে প্রতিদিন জঙ্গল মহলের কান্না এই সময়ে বারবার সামনে চলে আসছে। রাজ্য জুড়ে প্রতিদিন লুঠ হয়ে যাচ্ছে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র। প্রসারিত হচ্ছে জবর দখল, গাঁ জোয়ারি। শাসকদলের সাথে থাকলে চরম অন্যায় করেও পার পাবে তুমি, শাসকের বিরোধিতা করলে তোমার জুটবে মিথ্যা মামলা, জেল, সাথে শারীরিক হামলা। ২০১১ সাল-পরবর্তী সব নির্বাচনেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি অবাধ ভোট লুঠ, বিরোধীদের উপর নৃশংস আক্রমণ। কিছুদিন আগেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে একই জিনিস দেখেছি আমরা। তবে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের আক্রমণ শেষ কথা বলেনি, অনেক জায়গায় প্রতিরোধও দেখা গিয়েছে। যেখানেই মানুষ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ভোট দিতে পেরেছেন সেখানেই তৃণমূল হেরেছে। এই হার আরও ব্যাপক ও প্রকট হতো যদিনা ভোট গণনায় লাগামছাড়া দুর্নীতি হতো। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের স্পষ্ট ঈঙ্গিত তারা তৃণমূলের শাসন থেকে মুক্তি চাইছে। মানুষ মুক্তি চাইছে সাম্প্রদায়িকতা থেকেও। তাইতো পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি’র ভোট কমেছে শেষ বিধানসভা নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের তুলনায়। প্রতিদিন ঘৃণার চাষ করছে বিজেপি, তাতে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। কখনো ভাগ করো হিন্দু-মুসলমানে। হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি না হলে জাতের নামে, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের নামে ভাগ করো, ভাগ করো আদিবাসী ও বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দাও। মানুষ ব্যস্ত থাকুক ধর্মের নামে, জাতের নামে নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে। তাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দাও প্রতিদিনকার জীবণযন্ত্রণা থেকে। এটাই চাইছে তৃণমূল এবং বিজেপি। এর থেকেও মানুষ চাইছে বেড়িয়ে আসতে। এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায় ছিনিয়ে নিতেই এগিয়ে চলেছে ‘ইনসাফ যাত্রা’।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করে এখন দক্ষিণবঙ্গের মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেছে ‘ইনসাফ যাত্রা’। প্রতিদিন লোক বাড়ছে এই পদযাত্রায়। পাড়া, মহল্লা, গ্রামে, জেলা সদরের শহরে ইনসাফের কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যেখান দিয়ে এই পদযাত্রা যাচ্ছে সেখানকার মানুষ দু’হাত তুলে সমর্থন করছেন ইনসাফের দাবিগুলিকে। পদযাত্রার মাঝে মাঝে হচ্ছে ছোটো- বড়ো সভা, সমাবেশ। তিন ঘণ্টা-চার ঘণ্টা মানুষ অপেক্ষা করছেন ডিওয়াইএফআই’র কথা শোনার জন্য। কোনো ক্লান্তি নেই পদযাত্রীদের, তেমনি ক্লান্তি নেই সাধারণ মানুষের। আসলে ন্যায়ের লড়াইকে ক্লান্তি কখনো ভারাক্রান্ত করতে পারেনা। ন্যায় ছিনিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত লড়াই চলে, তারপর লড়াই চলে সেই ন্যায়কে বাঁচিয়ে রাখতে। তাইতো কোচবিহার দিয়ে যখন এই পদযাত্রা চলে তখন সেখানকার চকচকায় শিল্প না হবার জন্য কাজের সুযোগ তৈরি না হবার যন্ত্রণা বেকার যুবদের ছিড়ে খায়। শিল্পের দাবিতে তারা পদযাত্রায় পা মেলায়। আলিপুরদুয়ার জেলাতে যখন পদযাত্রা এগিয়ে যায় তখন মানুষের মুখে উঠে আসে এথেলবাড়িতে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে শুরু হওয়া ছোটো ও মাঝারি শিল্পের সম্ভাবনার কথা। বামফ্রন্টের আমলে চালু হওরা শিল্প কারখানগুলি এখন ধুঁকছে, কেননা পরবর্তীতে যেভাবে এই এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হবার কথা ছিল সেটা তৃণমূলের আমলে হয়নি। হয়নি আর কোনো নতুন শিল্প। এখানকার পর্যটন শিল্পও যে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটা স্থানীয় মানুষদের কথাতেই উঠে এসেছে বারবার। অপরিকল্পিত পর্যটন নীতি, স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের শুধুমাত্র কামিয়ে নেবার ধান্দার জন্য এখানকার প্রকৃতিও এখন সংকটের মধ্যে। জলপাইগুড়ি জেলার চা শিল্পের দুর্দশার কথা শোনানোর জন্য এখানকার চাবাগানের শ্রমিকরা রাস্তার ধারে অপেক্ষা করে থেকেছেন অনেকক্ষণ। বানারহাটে চাবাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা শুনেছে যুব নেতৃত্বরা। তারা বলেছেন এবার দুর্গাপূজার আগেও তাদের যৎসামান্য বোনাস দিয়েছেন চাবাগানের মালিকরা। তাও আদায় করতে হয়েছে অনেক লড়াই করে। অনেক বাগানে বোনাস দেওয়াই হয়নি। হাজির ছিলেন বন্ধ চাবাগানের শ্রমিকরাও। কীভাবে তৃণমূল সরকার তাদের ঠকিয়েছে সেই কথাও উঠে এসেছে এই সমস্ত শ্রমিকদের কথায়। পদযাত্রা এগিয়েছে চাবাগানের শ্রমিকদের নিয়ে স্লোগানে মুখরিত হয়ে। তাতে গলা মিলিয়েছেন সাধারণ মানুষও। দার্জিলিং জেলার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে পদযাত্রা এগিয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম হলেও এখানে থাকা মানুষদের জীবন যন্ত্রণা সেই মনোরম পরিবেশকে ফিকে করে দেয়। মানুষের কথায় উঠে আসে কিভাবে তৃণমূল এবং বিজেপি পাহাড় ও সমতলের মধ্যে প্রতিদিন বিভেদ বাড়িয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য। উঠে আসে ভিডিয়োকন কারখানা ও ইলেকট্রনিকস হাব না হবার যন্ত্রণার কথা। এরপর পদযাত্রা এগিয়ে যায় উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়ার দিকে। রাত্রি ১০ টার সময়েও পঞ্চায়েত নির্বাচনে শহিদ কমরেড মনসুর আলমের বাড়ির এলাকায় কালাগছে কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। সবাই ডিওয়াইএফআই’র কথা শুনতে চায়। তারপর সেদিনের পদযাত্রা শেষ হয় শহিদ কমরেড মনসুরের কবরে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এরপর পদযাত্রা এগিয়েছে ইসলামপুর, গোয়ালপোখর ডালখোলা হয়ে রায়গঞ্জের দিকে। রাস্তার দু’ধারে মানুষের উপস্থিতি থেকেছে চোখে পড়ার মতো। মানুষ এগিয়ে এসেছেন কথা বলতে। সেই কথায় এই জেলার পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বারবার উঠে এসেছে। এরপর পদযাত্রা এগিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমণ্ডি, বুনিয়াদপুর হয়ে গঙ্গারামপুরের দিকে। পদযাত্রা যত এগিয়েছে মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তাজুড়ে। বারবার পদযাত্রীদের থামতে হয়েছে মানুষের কথা শোনার জন্য। অন্ধকার রাস্তায় মানুষ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে অপেক্ষা করেছে নিজেদের কথা বলবার জন্য। হিলি বর্ডারের সমস্যা, আরও ট্রেনের ব্যবস্থা, ট্রেনের গতি বাড়ানো সহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ তাঁদের কথা জানিয়েছেন। এরপর পদযাত্রা এগিয়েছে মালদার দিকে। গাজোল, কদুবাড়ি, ওল্ড মালদা শহর হয়ে মালদা শহর অতিক্রম করে কালিয়াচকে পৌঁছেছে পদযাত্রা। এখানেও মানুষের অনুরোধে পদযাত্রা বারবার দাঁড়িয়ে মানুষের কথা শুনেছে। রাস্তার আশেপাশের বাড়ির মানুষ ফুল নিয়ে, জল নিয়ে, চকোলেট নিয়ে স্বাগত জানিয়েছে পদযাত্রাকে। এখানে পরিযায়ী শ্রমিক, সাম্প্রদায়িকতা, গঙ্গার ভাঙন নিয়ে মানুষ সরব হয়েছেন। এরপর পদযাত্রা পৌঁছে গিয়েছে মুর্শিদাবাদে। এখনো সেখানে চলছে পদযাত্রা। মানুষ ডিওয়াইএফআই’র নেতৃত্বের সাথে কথা বলছেন। পরিযায়ী শ্রমিক, তৃণমূলের অত্যাচার, ১০০ দিনের কাজ, বাইরের রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশী বলে হেনস্তা হওয়া, গঙ্গার ভাঙন নিয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কোনো সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ না করা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষ সরব হচ্ছেন। ডিওয়াইএফআই’র নেতৃত্বরাও বাইরে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় নিহত পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের সাথে দেখা করছেন। তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। এইভাবেই মানুষের কথা শুনে, নিজেদের কথা বলে, অসংখ্য মানুষের আশীর্বাদ নিয়ে ন্যায় ছিনিয়ে নেবার স্পর্ধা নিয়ে এগিয়ে চলেছে পদযাত্রা। যা শেষ হবে আগামী ৭ জানুয়ারি যৌবনের ডাকে জনগণের ব্রিগেড-এ ঐতিহাসিক সমাবেশের মধ্য দিয়ে।