E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০

কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার জীবনাবসান


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা, প্রাক্তন সাংসদ কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার জীবনাবসান হয়েছে। ১৩ নভেম্বর সোমবার হায়দরাবাদের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। বয়সজনিত অসুস্থতা নিয়ে তিনি ১৫দিন হায়দরাবাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি ছিলেন। এদিন সওয়া বারোটা নাগাদ তিনি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিকিৎসার জন্য তিনি হায়দরাবাদে তাঁর ছেলের কাছে থাকতেন।

শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের প্রতি এবং শ্রমজীবী জনগণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতার প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমেছে সর্বত্র। কমরেড আচারিয়ার মৃত্যুতে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো শোক বার্তায় বলেছে, রেল শ্রমিক আন্দোলনে এবং কয়লা শ্রমিক আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন কমরেড আচারিয়া। দীর্ঘসময় তিনি দক্ষ সাংসদ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি শোকবার্তায় প্রয়াত কমরেডের প্রতি শ্রদ্ধা ও লাল সেলাম জানিয়ে বলেছেন, কমরেড আচারিয়া ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য। ইয়েচুরি প্রয়াত কমরেডের পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।

শেষ বিদায়

১৫ নভেম্বর জনজোয়ারে শেষ বিদায় জানানো হয় প্রয়াত কমরেড বাসুদেব আচারিয়াকে। ১৩ নভেম্বর জীবনাবসানের পর ১৪ নভেম্বর তাঁর মরদেহ হায়দরাবাদ থেকে নিয়ে আসা হয় কলকাতায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে। সন্ধ্যায় সেখানে মরদেহে রক্তপতাকা আচ্ছাদিত করার পর মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টির প্রবীণ নেতা বিমান বসু, পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, সূর্য মিশ্র, রামচন্দ্র ডোম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, সুমিত দে, রেখা গোস্বামী, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পলাশ দাশ, কল্লোল মজুমদার সহ পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব, বিভিন্ন গণসংগঠন, পার্টির বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিনিধি ও রাজ্য দপ্তরের কর্মীবৃন্দ। এখানে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, আরসিপিআই নেতা মিহির বাইন। এখানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার মরদেহ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় সিআইটিইউ’র রাজ্য দপ্তর শ্রমিক ভবনে। এখানে পার্টি নেতৃত্ব, সিআইটিইউ এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল মালায় শ্রদ্ধা জানানো হয়। এদিন মরদেহ রেখে দেওয়া হয় পিস ওয়ার্ল্ডে।

১৫ নভেম্বর সকালে প্রয়াত নেতার মরদেহ কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয় পুরুলিয়া শহরে সিপিআই(এম) জেলা দপ্তরে। এখানে রক্তপতাকায়, ফুল-মালায় প্রয়াত কমরেডকে শ্রদ্ধা জানান বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায়, পার্টির ঝাড়খণ্ড রাজ্য কমিটির সম্পাদক প্রকাশ বিপ্লব, প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক জি কে বক্সী, পার্টির ধানবাদ জেলা সম্পাদক সন্তোষ দাস প্রমুখ। এছাড়াও এখানে মাল্যদান করেন সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শমীক লাহিড়ী, দেবলীনা হেমব্রম, বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অজিত পতি, পশ্চিম বর্ধমানের জেলা সম্পাদক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি সহ বামফ্রন্টের শরিক দল ও বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।

বেলা তিনটা নাগাদ ৮১টি অর্ধনমিত রক্তপতাকা নিয়ে জেলা পার্টি দপ্তর থেকে শোক মিছিল বের হয়। মিছিলে পা মেলান পার্টি নেতৃবন্দসহ অগণিত মানুষ। এবিটিএ-র জেলা দপ্তরেও সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কাশীপুরে। সেখানে পার্টি ও বিভিন্ন গণসংগঠনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয়। তারপর মরদেহবাহী শকট পৌঁছায় আদ্রায় কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার বাসস্থান এলাকায়। বিভিন্ন অংশের শ্রমজীবী মানুষ সহ পার্টি ও গণসংগঠনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয় এখানে। এদিন প্রয়াত নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে বাঁকুড়া, আসানসোল, বীরভূম, ধানবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ এসেছিলেন তাদের প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে।

আদ্রায় অন্তিম যাত্রায় ছিলেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম সহ পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ছিলেন বাসুদেব আচারিয়ার পুত্র ভেঙ্কট সৌমিত্র আচারিয়া, দুই মেয়ে জয়শ্রী, অনুশ্রী আচারিয়া। এদিন সন্ধ্যায় আদ্রায় বেনিয়াশোল শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

নেতৃবৃন্দের শ্রদ্ধা

কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কমরেড বাসুদেব আচারিয়াকে চিনি এবং তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দক্ষ সাংসদ হিসাবে দীর্ঘ সময় ধরে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে দায়িত্ব পালন করেছেন। শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রণী নেতা হিসাবে কমরেড আচারিয়া দায়িত্ব পালন করেছেন এবং জেলও খেটেছেন। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম প্রয়াত কমরেডের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, সংসদে এবং শ্রমিক আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য এদিন কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার জীবনাবসানে গভীর শোক জানিয়েছেন। সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার জীবনাবসানে গভীর শোক জানানো হয়েছে।

কমরেড আচারিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিআইটিইউ সভানেত্রী কে হেমলতা এবং সাধারণ সম্পাদক তপন সেন। এক শোকবার্তায় তাঁরা বলেছেন, কমরেড আচারিয়া ছিলেন একজন জনপ্রিয় শ্রমিকনেতা। কয়লা শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে রাস্তায় নেমে দাবি আদায় করেছেন। রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের পাশে সবসময় থাকতেন, বিমাকর্মীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করতেন। সিআইটিইউ সর্বভারতীয় সহ সভাপতি হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সারা ভারত কৃষকসভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে ও সাধারণ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণন গভীর শোক জানিয়ে বলেছেন, দেশের কৃষকদের সমস্যাকে সংসদে প্রতিফলিত করতে তিনি অনন্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম সাংসদ, যিনি দেশের কৃষক সমস্যা আলোচনার জন্য সংসদের পৃথক অধিবেশন আহ্বান করার দাবি জানিয়েছিলেন।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার জন্ম পুরুলিয়া জেলার বেরো গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর তিনি কাশীপুর পঞ্চকোটরাজ হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে কাজ করার সময় শিক্ষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে তিনি নিগমনগর এনএস স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির রাজ্য নেতৃত্বের দায়িত্ব পান এবং সমিতির পুরুলিয়া জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক আন্দোলনের নেতা হিসাবে কাজ করতে করতেই তিনি শ্রমিক আন্দোলনের কাজে যুক্ত হন। সেই সময়ই তিনি চাকরি ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে কয়লা শ্রমিক আন্দোলন এবং রেল শ্রমিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে রেল ধর্মঘটের সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালে তিনি সিপিআই(এম) পুরুলিয়া জেলা কমিটির সদস্য হন। ১৯৮৫ সালে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হন। তিনি পার্টির পুরুলিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৫ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ২০১৮সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত পার্টির কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮০ সালে তিনি বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথমবার সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪সাল পর্যন্ত ৯বার তিনি এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমরেড আচারিয়া রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া জেলায় রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি সংসদে পার্টির সংসদীয় নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংসদ হিসাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি রেলের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব যেমন পালন করেছেন, তেমনি সংসদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য থাকার পাশাপাশি সংসদের নিরাপত্তা কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সংসদের মধ্যে তিনি গরিব মানুষের উন্নয়নের কথা বলার পাশাপাশি সংসদের বাইরে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।

প্রয়াত কমরেড আচারিয়া ছিলেন একজন জনপ্রিয় নেতা, সাধারণ মানুষ তাঁদের সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে যেতেন। তাঁর বাড়িতে গ্রামের মানুষের ভিড় সবসময় দেখা যেত। ২০১৮ সালে এরাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেবার সময় তিনি তৃণমূল সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কমরেড আচারিয়ার স্ত্রী সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর এক পুত্র এবং দুই কন্যা বর্তমান।

প্রয়াত কমরেডের প্রতি শোক জ্ঞাপন করেছেন নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন। শোক জানানো হয়েছে সারা ভারত নাবার্ড কর্মচারী সমিতি, সারা ভারত পিয়ারলেস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, ভারতের কোলিয়ারি মজদুর সভা (সিএমএসআই) সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। এদিন রানিগঞ্জ কয়লা শ্রমিক ভবনে প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান এবং নীরবতা পালন করা হয়। কমরেড বাসুদের আচারিয়ার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ইসিএল-এর নাগকাজোড়ার শ্রমিকরা সমবেত হয়ে শোক জানিয়েছেন। কয়লাঞ্চলে সমস্ত খনি এবং ওয়ার্কশপে কমরেড বাসুদেব আচারিয়াকে স্মরণ করা হয়। এদিন চিত্তরঞ্জন রেলনগরীতে সিএলডব্লিউ লেবার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কমরেড বাসুদেব আচারিয়া স্মরণে মৌন মিছিল হয়।