E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০

নারীমুক্তির সংগ্রাম - সোভিয়েতেই পথের নিশানা

গীতশ্রী সরকার


এই বিপুল মানবসভ্যতা রোজ ছুটছে, অবিরাম ছুটছে। কারণ তার পেটে খিদের আগুন। ধনী-দরিদ্র, পুরুষ-নারী, হিন্দু-মুসলমান, উঁচু জাত বা নিচু সকলেই ছুটছে। কারণ সবার ওপরে সত্য এই খিদের জ্বালা, নির্ভেজাল বেঁচে থাকার তাগিদ। এই পৃথিবীর অন্যতম বুদ্ধিমান, উন্নত প্রজাতির জীবের ন্যূনতম চাহিদা - খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি। কিন্তু আজও মানুষ রোজ লড়াই করছে এই আবশ্যক উপাদানগুলোর অধিকারের দাবিতে। এই লড়াইয়ের অন্যতম কারণ অসাম্য। অসাম্যের সৃষ্টিকর্তাও মানুষই। অসাম্য ধর্মে, অসাম্য লিঙ্গে, অসাম্য জাতিতে, বর্ণে, বিত্তে- সর্বত্র। মানবসভ্যতা সৃষ্টির অব্যবহিত পরবর্তী সময়েই এই দ্বৈরথগুলির আবির্ভাব। এই বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের অন্যতম পুরাতন দ্বন্দ্ব নারী-পুরুষের অধিকারের লড়াই। মানব সভ্যতার ইতিহাসের ক্রমপরিবর্তনশীল ধারা আমাদের সকলেরই পাঠ্য। মার্কস-এঙ্গেলসের রাজনৈতিক বীক্ষণ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বা রাহুল সাংকৃত্যায়নদের সরস ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আমাদের সামনে আদিম সমাজ ব্যবস্থার এক নিপুণ ছবি তুলে ধরে। দিবা, নিশাদের কাহিনি প্রমাণ করে নারী জাতির গৌরবময় উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা। তারপর ইতিহাসের বিস্তীর্ণ ধারাপথে গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদের বৃত্তে নারীর অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। সহজ কথায় আদিম সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত পাওয়ার স্ট্রাকচারের বদল ঘটেছে। যে নারী একসময় গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছে, শিকার করেছে, পরবর্তীতে শক্তিমান পুরুষ তাঁকে দেগে দিয়েছে সন্তানের পালিকারূপে। এঙ্গেলস এই ঘটনাকে চিহ্নিত করেছিলেন নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয় রূপে।

ইতিহাসে পরিবর্তনই ধ্রুব। একদিকে নারীর ক্ষমতার অবনমন যেমন সত্য, তেমনি আধুনিক ব্যবস্থায় নারীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সমানাধিকারের লড়াইও সত্য। কিন্তু প্রশ্ন আজও, এই তথাকথিত ‘আধুনিক’ সমাজে দাঁড়িয়েও কেন নারীর অধিকার, প্রকৃত অবস্থানের স্বরূপ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই আমরা। সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী সুরক্ষা আজও কেন বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে? আজও খবরের পাতা ভরে থাকে কন্যাভ্রূণ হত্যা থেকে পণের দাবিতে বধূ হত্যার খবরে। আজও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয় মেয়েটির চরিত্র; প্রতিদিন ঘরে বাইরে মেয়েদের লড়তে হয় ন্যূনতম অধিকারের দাবিতে। ইতিহাস সাক্ষী মানব সভ্যতার প্রাচীনতম অসাম্য- লিঙ্গগত অসাম্য। গোষ্ঠী ভিত্তিক সমাজ থেকে রাজ শাসন, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে পুঁজিবাদী অর্থ কাঠামো মেয়েদের পণ্য হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার স্বরূপ অন্যান্য ধন দৌলতের সঙ্গে বিজেতা গোষ্ঠী লাভ করত নারীসম্পদও। সেই প্রাচীন কাল থেকে নারীর পণ্যায়নের পথ চলা শুরু। বিভিন্ন যুদ্ধে মেয়েদের গৌরবময় অংশগ্রহণের পাশাপাশি মেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের কাহিনি, পশুর মতো নারীসম্পদ হরণ, বিক্রির কাহিনির ছকটি খুব অজানা-অচেনা নয়। বিভিন্ন দেশে মেয়েদের লেখাপত্রেও এই ছবি, এই যন্ত্রণার বিবরণ স্পষ্ট, দগদগে। দীর্ঘসময় পর্যন্ত মেয়েরা নিজেদের মূক পশু, খাঁচায় বন্দি পাখির সঙ্গে তুলনা করেছে। কিন্তু সেই প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ, উনিশ-বিশ শতকের বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পালাবদলের জমানা পেরিয়েও মেয়েদের অবস্থা কি খুব বদলেছে? মেয়েদের সামাজিক স্বাধিকার, মর্যাদার প্রশ্নে আজও কেন সরব হতে বাধ্য হচ্ছে সমাজ। তথাকথিত নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের অবস্থানের খুঁটিনাটি খবর খানিক বোঝার চেষ্টা করব। আমাদের আলোচনা স্বভাবতই আমাদের দেশের কক্ষপথেই ঘোরাফেরা করবে।

আমাদের দেশ সার্বিকভাবে এক সংকটের জাঁতাকলে বন্দি। ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত-জাতি-লিঙ্গের অসাম্যই আজ শাসকের হাতিয়ার। বৈচিত্র্যময় দেশের স্বাতন্ত্র্যর টুঁটি চেপে ধরেছে আজকের সরকার। এক জাতি-এক ধর্ম-এক বর্ণ-এক ভাষার দাবিতে মেতেছে একদল উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি। পুঁজিবাদ যখন একদিকে এক শ্রেণির উন্নতির লক্ষ্যে বাজার দখলের খেলায় মেতেছে, তখন আরেকদিকে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শিবির একদেশ একনীতির যজ্ঞে উগ্র হিন্দুত্ববাদকে হাতিয়ার করেছে। পুঁজির মালিক এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মনেতার এই ‘গঁটবন্ধন’ দেশের বাতাসকে রোজ একটু করে বিষিয়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেই আদিমতম অসাম্য - লিঙ্গগত অসাম্য মাথা চাড়া দিতে বাধ্য। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন হবে, ভারতের মেয়েরা কি গৃহবন্দি? না, এক বড়ো অংশের মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে রয়েছে। রাজনীতির ময়দান থেকে কৃষিক্ষেত্র, সফটওয়্যার কোম্পানি থেকে নিজস্ব ব্যবসা মেয়েদের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। কিন্তু প্রশ্ন মেয়েদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী? ঘরের কাজ থেকে অফিসের কাজ সর্বত্রই মেয়েদের অধিকারের লড়াই আজও বহমান। আজও মাতৃত্বকালীন ছুটির দাবিতে, সবেতন ছুটির দাবিতে, কর্মরতা মায়েদের ন্যূনতম সুবিধার দাবিতে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকারের দাবিতে, লড়তে হয় ঘরে-বাইরে যৌন হেনস্থার, অসাম্যের বিরুদ্ধে। এই লড়াই গৃহকর্ত্রী থেকে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির কর্মরতা প্রায় সমস্ত মেয়েদেরই। এই পরিস্থিতিতেই আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন নেতা অবলীলায় ধর্ষিতা মেয়েটির ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেন, ধর্ষণে অভিযুক্ত ক্ষমতাবানের মুক্তির দাবিতে মিছিল করেন কোনো বিজেপি'র নেতা, স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরেও অবলীলায় শাসকের অনুগ্রহে বহাল তবিয়তে ঘুড়ে বেড়ায় দোষী। আপাতভাবে খানিক ‘প্রগতি’র মুখোশের অন্তরালে মনুসংহিতার যুগে পিছিয়ে যেতে চাইছে সরকার। মনুর নীতি, সামাজিক নৈতিকতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আজকের সমাজে। যখন গণতান্ত্রিক দেশে মুক্তসভায় মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য হিন্দু মেয়েদের সন্তান ধারণের নির্দেশ দিচ্ছে আরএসএস’র নেতা, যখন মেয়েদের পোশাক-কাজ নির্ধারণ করে দিচ্ছেন ধর্মগুরু তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এই আপাত আধুনিকতা প্রগতিশীল মননের জন্ম দিতে পারে নি। মেয়েরা প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলেও তার সার্বিক মুক্তি ঘটে নি। তাই আজও গৃহস্থালির কাজ কেবল মেয়েদের, আজও নারীর সার্থকতা কেবল মাতৃত্বে, আজও মেয়েদের শেখানো হয় সব কিছুর পরও তোমার আসল জায়গা ঘরে-রান্না ঘরে। সমাজ রোজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মেয়েরা কতটা অসুরক্ষিত; আর শাসক সুরক্ষার বদলে মেয়েদের চরিত্র সংশোধনের শিক্ষা দেয়। লক্ষ্মণের মতো গণ্ডি কেটে নির্ধারণ করে দেয় সীমা।

এইরকমই দমবন্ধ করা অবস্থায় ফিরে তাকাতে বাধ্য হতে হয় - একটা দেশের দিকে। দেশটির আজ অস্তিত্ব নেই; সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার স্বপ্নের সোভিয়েত আজ শুধুই রাশিয়া। পুঁজিবাদের উল্লাস আজও শোনা যায় - সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের স্মৃতিচারণায়। কেউ বলবে আমরা অতীতপ্রিয়, কল্পনাবিলাসী, বা স্মৃতিসর্বস্ব। আসলে বর্তমানের প্রাগসর সমাজে দাঁড়িয়েও বারবার লেনিনের বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হতে হয়। নারী প্রগতি নিয়ে সোভিয়েতই প্রথম কথা বলেছে, এমনটা নয়। বহু সভ্যতাতে, আধুনিক সমাজে, তথাকথিত উন্নত দেশে নারী প্রগতি, নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটেছিল। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীশিক্ষা, নারী অধিকারের সম্প্রসারণ ঘটেছিল আধুনিক, শিক্ষিত পুরুষের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। বহু প্রাচীন সভ্যতায় গণিকারা শিল্পচর্চা করতেন, প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতেন পুরুষের উপযোগী হয়ে ওঠার তাগিদে। আমাদের বাংলাতেও উনিশ শতকে নারী শিক্ষা, নারীর অধিকারের দাবিতে সমাজ সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে দেখেছি। নারীর ওপর বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনচেতনা গঠনের লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর, রামমোহনরা লড়াই করেছেন, মেয়েদের উন্নতির স্বার্থে শিক্ষাদানের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন বিদ্যাসাগর থেকে বেথুন, ডেভিড হেয়াররা। কিন্তু উনিশ শতকের বহু লেখাপত্রে প্রমাণ মেলে সমকালে বাঙালি ‘ভদ্রমহিলা’ নির্মাণের চাহিদা। শিক্ষিত পুরুষের শরীর-মনের যোগ্য সহধর্মিণী নির্মাণের তাগিদে লেখাপড়ার প্রচলন গঠনে অন্দরমহলে। এই সময়ের নারী শিক্ষার বড়ো অংশই গৃহনির্মাণ এবং সন্তান প্রতিপালন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও শিক্ষানীতিতে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে হোম সায়েন্স, সেলাই, গৃহসজ্জার শিক্ষা প্রদানের বাড়বাড়ন্ত। এই প্রভাব কেবল ভারতের মতো ঔপনিবেশিক দেশের ছবি নয়, এই ছবি বহু উন্নত দেশেও দেখা গেছিল। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া নারীর কাজকে সীমাবদ্ধ করেনি, লেনিনের রাশিয়া গৃহস্থালির কাজকে সামাজিক কাজের মর্যাদা দিয়েছিল। এইখানেই অন্যান্য দেশের নারী প্রগতির সঙ্গে রাশিয়ার পার্থক্য। আজও মেয়েদের ঘরের কাজ সামাজিকভাবে মর্যাদা পায় না, কারণ সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লেনদেন নেই। বিশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকেই রাশিয়া মেয়েদের নিত্যদিনের কাজকে সামাজিক কাজের মর্যাদা দেয়। তাই যিনি ভালো সেলাই করতে পারেন তার সঙ্গে একজন মহিলা ইঞ্জিনিয়ায়ের সামাজিক ব্যবধান ঘুচে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে আজও এই পার্থক্য, সামাজিক অবমাননা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। অর্থনৈতিক লেনদেন ছাড়া কাজের মূল্য না থাকার এই ভাবনা পুঁজিবাদী অর্থনীতির গর্ভজাত। আজও যখন মাতৃত্বকালে মহিলা কর্মী ছাঁটাই হয় তখন ফিরে তাকাতেই হয় সোভিয়েতের বিকল্প নীতির দিকে। সোভিয়েতে মাতৃত্বকালীন অবস্থায় প্রোটেকশন কার্ড (রেশনে, ট্রামে-বাসে, কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা) এর ব্যবস্থা আজও বহু ‘উন্নত’ দেশে নেই। রাশিয়ায় কোনো মেয়ের মাতৃত্বকালীন সময়ে ছাঁটাই হয় নি, অবিবাহিত মায়েদের জন্য ছিল বিশেষ সুবিধা, প্রচলিত ছিল ভাতা। এই প্রতিটি উদাহরণ আজও ‘প্রগতিশীল’ সমাজপতিদের শিক্ষণীয়। আজ যখন প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিক-প্রেমিকার ওপর 'নীতি পুলিশি' করে বজরং দল, আজও যখন অসহায় মা গর্ভপাত করতে বাধ্য হন, যখন নিচু জাতে প্রেম করার অপরাধে পুরিয়ে মারে পরিবার, তখন ওই ভেঙে যাওয়া দেশটার দিকেই ফিরে তাকাতে হয়। লেনিন-স্তালিনের রাশিয়ায় গর্ভপাত থেকে ভ্রূণহত্যা, বিবাহবিচ্ছেদ থেকে গণিকাপ্রথার অবলুপ্তি ঘটেছিল। তার অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং চিন্তন-মননে সংগঠিত বিপ্লব। সোভিয়েত রাশিয়া কেবল নিজ দেশের মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক অধিকারের দাবিতেই লড়াই করেনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের ওপর সোভিয়েতের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েতের আদর্শ, চর্চা-চর্যার প্রভাবে পরিবর্তনের বাতাস বয়েছিল আফগানিস্তান থেকে তুরস্ক, কাজাকিস্তান, ইরানের পথে। বিশ শতকের বহু পত্র-পত্রিকায় এই অঞ্চলের মেয়েদের স্বাধীন চলা ফেরা, শিক্ষাগ্রহণ, কর্মক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ছবি প্রকাশ পেয়েছিল। যে ইসলামিক দেশগুলির আধুনিকতা আজ প্রশ্নের মুখে পড়ছে, সেই দেশগুলিতেই পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল সোভিয়েত আদর্শের ধারাপথে। সোভিয়েতে মানবজাতির মেরামত, নারী সমাজের গঠন প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “...সোভিয়েত প্রথম দৃষ্টি রাখল মানবীর প্রতি, মেয়েদের প্রতি, পুরুষের প্রতি নয়। কেননা মেয়েদের বাদ দিয়ে মানবজাতির মেরামতটা শুধুই ফাঁকা কথা, হৃদয়াবেগের কথা, বিজ্ঞানের কথা নয়।”

আমাদের রাজ্যেও বামপন্থী সরকারের আমল থেকেই অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের পুষ্টির ব্যবস্থা, শিশুর প্রাথমিক গঠনের দায়িত্ব পালন করেছে সরকার। এই সূত্রে মেয়েদের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে; স্বাস্থ্যকর্মী, আশাকর্মী হিসেবে কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন মেয়েরা। আসলে নারীর অধিকার, অগ্রগতির প্রশ্নে সরকারের ভূমিকাই মূল আলোচ্য। এই বিষয়ে সোভিয়েত যে মাপকাঠি নির্দিষ্ট করেছে, তা আজও বহু ‘উন্নত’, উদার অর্থনীতির দেশ পালনে অক্ষম। আজ যখন আমাদের দেশের সরকার পরিকল্পনা মাফিক গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য, সদ্যজাতের খাদ্য নিয়ে ব্যবসা করে, এই ন্যূনতম অধিকারটুকু বেঁচে দেয় বেসরকারি কোনো দালালের হাতে তখন ফিরে তাকাতেই হয় সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েতের ইতিহাসের দিকে, ‘অতীত’-এর দিকে।

আজ হয়তো পুঁজির দালাল শ্রেণি এই আলোচনাকে কটাক্ষ করবে, কেবল স্মৃতিমেদুরতা হিসেবে দেগে দেবে, কিন্তু আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া যে প্রগতিশীলতার চর্চা করেছিল সেই কক্ষপথে আজও অনুপ্রবেশ ঘটেনি তাবৎ উন্নত দেশের। আমাদের দেশের শাসক যখন মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের উদাহরণ তুলে ধরছে, তখন আমাদের মনে করতে হবে সীতার অগ্নিপরীক্ষার অবমাননার কথা। যখন মনুসংহিতার বাঁধনে বাঁধতে চাইছে আমাদের সমাজকে তখন মনে করতে হবে এই সংহিতাই জমি, গোরুর মতো মেয়েদের দানযোগ্য সামগ্রী হিসেবে তুলে ধরেছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য্যদের শিক্ষা সোচ্চারে বলতে হবে। বলতে হবে ‘আজকের দিনে বেদ পড়লে পিছিয়ে পড়ব’। নারী পুরুষ এই মানবসভ্যতার দুই স্তম্ভ, যার ওপর নির্ভর করছে সভ্যতার নিরবচ্ছিন্ন চলন। কয়েক শতক ধরে চিন্তাবিদদের মূল আলোচ্য বিষয় - এই দুই স্তম্ভের সমান অধিকার, সমমাত্রিক অগ্রগতি। আজ পুরাণ, স্মৃতি মুখাপেক্ষী শাসকের পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে আজ প্রকৃত প্রগতিশীল চিন্তন চর্চার প্রয়োজন। আজ প্রয়োজন বদলের; এই শ্যাওলা জমা ধ্যানধারণার শিকড় উপড়ে ফেলার শিক্ষা প্রয়োজন, অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদের চেতনার সম্প্রসারণ প্রয়োজন। চিন্তাজগতে বিপ্লবের জন্য সকল অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সত্যিকারের ইতিহাসের পাঠ প্রয়োজন। আজকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং পুঁজির দালালের আপোশের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের শিক্ষাই একমাত্র ভবিষ্যৎ।