৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০
কোন পথে রুশ বিপ্লব
সৌম্যজিৎ রজক
মার্কস-এঙ্গেলস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এই ধারণাটিকে প্রথম মূর্ত রূপ দিল নভেম্বর বিপ্লব। রুশ দেশে। অর্থাৎ মার্কস-এঙ্গেলস খাতায়-কলমে যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটাকে হাতে-কলমে করে দেখাল এই বিপ্লব। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো রাশিয়ায়।
কিন্তু একদিনে তো এটা হয়নি। জন রিডের বিখ্যাত বই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’; সেই দশদিনেও এটা হয়নি আসলে। এত বড়ো একটা কাজ, নিশ্চিতভাবেই, এর পেছনে ছিল দীর্ঘ পথপরিক্রমা।
“রক্ত আর কাদায় কলঙ্কিত রোমানভ রাজতন্ত্রের” সম্রাট (জার)-এর শাসনে অতিষ্ঠ রাশিয়ার মানুষ। সবচেয়ে বাজে অবস্থা বিপুল সংখ্যক চাষি, ছোটো চাষি এবং তারচেয়েও বেশি ভূমিদাসদের। উনিশ শতকের শেষার্ধে গড়ে উঠেছে নতুন শিল্পও। ১৮৯৯ সালের মধ্যে সে দেশে গড়ে উঠেছে ২৫ হাজার কলকারখানা। শ্রমিক সংখ্যা ২০ লাখ। শিল্প যত তৈরি হয়েছে ততই গঠিত হতে থেকেছে শ্রমিকশ্রেণিও। কৃষকদের মতো শ্রমিকদের অবস্থাও বেঁচে থাকার মতো নয়।
এমনটা নয় যে কেউ এই দিন পালটে দেওয়ার কথা ভাবেনি। কেউ কেউ তো ভেবেইছিল। তবে তারা ভেবেছিল, জনগণের শত্রু হিসেবে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে যে জারকে তাকে মেরে ফেললেই সমস্যা মিটে যাবে। এমন কয়েকজন মিলে জার দ্বিতীয় আলেকজান্দারকে খুন করেও দেয়, তৃতীয় আলেকজান্দার জার হয়ে যায়। কেউ কেউ তাকেও খুন করতে চেয়েছিল, পারেনি। পারলেও কিছুই হতো না, আরেকজন জার হয়ে যেত আর একইরকম জুলুমবাজিই চলত।
ওটা রাস্তা না। রাস্তাটা কী তাহলে? আলাদা আলাদা ক’রে অনেকেই খুঁজতে শুরু করে। অনেকে মার্কস-এঙ্গেলসের মতবাদের খোঁজ পায়, সেই নিয়ে চর্চা শুরু হয়। রাশিয়াজুড়ে নানান মার্কসবাদী গ্রুপ গড়ে ওঠে। একইসময় কারখানায় কারখানায় শ্রমিকরাও লাথ খেতে খেতে বাধ্য হয়েই সংগঠিত হতে থাকে। তৈরি করে একটা, দু’টো শ্রমিক ইউনিয়ন। ছোটো ছোটো লড়াই করে মালিকের বিরুদ্ধে। ধর্মঘটও। অনেক সময় শ্রমিকরা ক্ষেপে গিয়ে, খালি চোখে দেখা যায় যে মেশিনগুলোকে, সেগুলোকেই নিজেদের শত্রু ভেবে ভেঙেটেঙেও দেয়।
কিন্তু শোষণ তো মেশিনে করে না। দুশমন তো একটা কারখানার একজন মালিক নয়, এমনকী জার লোকটাও একা নয়। পুরো সিস্টেমটাই তো এই শোষণকে টিকিয়ে রাখছে। জার যাতে চাবুক চালাতে পারে, মালিক যাতে লাথ মারতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য গোটা রাষ্ট্রটা আছে। আসলে দরকার রাষ্ট্র নামের এই রাজনৈতিক কাঠামোটাকেই দখল করা। আর সেটা করতে গেলে বড়ো লড়াই লড়তে হবে। শুধু মজুরি বাড়ানো বা কাজের সময় কমানোর মতো অর্থনৈতিক লড়াই নয়, রীতিমতো রাজনৈতিক লড়াই।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করত যে, এসব রাজনৈতিক লড়াই শ্রমিকদের কাজ নয়। যদি লড়তেই হয় তাহলে তারা লড়ুক শুধু, খালিচোখে দেখা যাচ্ছে যে অর্থনৈতিক অভাবগুলো সেগুলোর বিরুদ্ধেই। আবার কেউ কেউ বুঝতে পারছিলেন যে, স্রেফ ওই অর্থনৈতিক লড়াইয়ের পেছন পেছন দৌড়ে কিছুই হবে না। শ্রমিকদেরকে একটি সচেতন শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত হতে হবে এবং লড়তে হবে কঠিন রাজনৈতিক সংগ্রামটা। এরকম যাঁদের মনে হচ্ছিল তাঁদেরই একজন লেনিন।
লেনিনকে লড়তে হলো মতাদর্শগতভাবে। তর্ক করতে হলো। বই লিখতে হলো। শ্রমিকদের কেবলই অর্থনৈতিক লড়াইতে যারা আটকে রাখতে চায় তাদের বিরুদ্ধে। শ্রমিকশ্রেণির একটি রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলার জন্যে।
পার্টি গড়ে তোলার জন্যে, মতাদর্শগত প্রচারের জন্য, এক অঞ্চলের চাষিদের লড়াইয়ের খবর অন্য অঞ্চলের চাষিদের বা এক কারখানার শ্রমিকদের লড়াইয়ের খবর অন্য কারখানার শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করতে হলো। তার নাম ‘ইসক্রা’, মানে স্ফুলিঙ্গ। স্ফুলিঙ্গ ছাড়া কী আর দাবানল সম্ভব?
পার্টি তৈরি করতে গিয়েও ঝামেলা। কেমন হবে এই পার্টি? ব্যান্ডপার্টির মতো নাকি শ্রমিকশ্রেণির সচেতন, সংগঠিত, ভ্যানগার্ড পার্টি? কারা হবে পার্টির সদস্য? শুধু চাঁদা দিলেই আর পার্টির কর্মসূচির সাথে একমত আছি বললেই চলবে নাকি তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে কোনো সংগঠনে কাজও করতে হবে জনগণের মধ্যে? কী নিয়মে চলবে পার্টিটা? গো অ্যাজ ইউ লাইক নাকি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিতে? এইরকম অনেক তর্ক।
লেনিন ছিলেন ব্যান্ডপার্টি বানানোর বিরুদ্ধে। শ্রমিকশ্রেণির ভ্যানগার্ড পার্টি বানানোর পক্ষে। এবং তাঁর পক্ষেই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই ওঁদের ভাষায় এবার থেকে লেনিন ও তাঁর মতের সমর্থকদের বলা হবে বলশেভিক।
এদিকে জুলুম চলছিলই। লড়াইও চলছিল তার বিরুদ্ধে। ১৯০৪-এ শুরু হলো রুশ-জাপান যুদ্ধ। মানুষের, বিশেষত শ্রমিক-কৃষকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপও বাড়ল। তাঁদের ক্ষোভও বাড়ল। সেবছরই ডিসেম্বরে বাকুতে তেল শ্রমিকদের বিরাট হরতাল হলো। এক মাসের মধ্যে, ১৯০৫-র জানুয়ারিতে, একটা বড়ো ঘটনা ঘটে গেল পিটার্সবার্গ শহরে।
পাতিলভ কারখানায় ৩ তারিখ চারজন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। প্রতিবাদে ৪ তারিখই রাস্তায় নেমে পড়ে ১২ হাজার শ্রমিক। ধর্মঘট। লড়াই বাড়তে থাকে, অন্য কারখানার শ্রমিকরাও যুক্ত হয়। ৮ তারিখ ধর্মঘটে যোগ দেয় দেড় লক্ষ শ্রমিক। পুলিশ পাঠিয়েও যখন ধর্মঘট ভাঙা যায় না তখন শাসকরা এক পাদ্রীকে পাঠায় শ্রমিকদের কাছে। শ্রমিকদের সে বোঝায়, ধর্মঘট করে কিছু হবে না! তারচেয়ে সবাই মিলে যিশুখ্রিস্টের ছবি নিয়ে জারের কাছে যাওয়া ভালো। জার তো ঈশ্বরেরই প্রতিনিধি!
বলশেভিকরা বলেছিল, এটা ফেরেপবাজি। যদিও অধিকাংশ শ্রমিকই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিতে, জারের প্রতি মোহে পাদ্রীর কথাতেই ভুলল। এবং ৯ তারিখ, রবিবার, সকালবেলা চার্চ থেকে সুসজ্জিত মিছিল করে চলল জারের কাছে। পাদ্রী সব খবরই দিয়ে রেখেছিল যেখানে দেওয়ার এবং জারের প্রাসাদের কাছাকাছি মিছিল পৌঁছানোর আগেই নির্বিচারে গুলি চালাল পুলিশ। স্পটেই মারা গেল এক হাজারের বেশি শ্রমিক। আগুন নেভানোর জন্যে জল ভেবে ওরা, কিন্তু আসলে, ঢেলে দিয়েছিল পেট্রল।
রীতিমতো ফুঁসে উঠল রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণি। ধর্মঘট, মিছিল, মিটিং শুধু না, এবার মহল্লায় মহল্লায় সেনাবাহিনীর সাথে রীতিমতো সশস্ত্র লড়াই লড়ল শ্রমিকরা। ওদিকে গ্রামের কৃষকরাও নামল লড়াইতে। লড়াই হলো খেতে, খামারেও। বলশেভিকরা এতদিন এই কথাটাই বলছিল, শ্রমিকদের লড়াইয়ের সাথে কৃষকদের সংগ্রামকে যুক্ত করে তবেই পৌঁছানো যাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
১৯০৫ সালজুড়ে তুলকালাম লড়াই সারা রাশিয়ায়। শ্রমিক, কৃষকরা তো ছিলই; এবার পোটেমকিম যুদ্ধজাহাজের নাবিকেরাও বিদ্রোহ করল। সে বিদ্রোহ দমন করা হলো নির্মমভাবেই। যদিও দমল না কিছুই, দেশের সব কারখানা, অফিস, কাছারি, স্কুল, কলেজ সব বন্ধ। সশস্ত্র লড়াই লড়ছে শ্রমিকরা। এবং তাঁদের দাবি মজুরি বাড়ানো নয়, কাজের সময় কমানো নয়, অর্থনৈতিক কিছু নয়। দাবি, স্বৈরতন্ত্রের অবসান। রীতিমতো রাজনৈতিক।
ভয় পেয়ে ১৭ অক্টোবর জার এক ইশ্তেহার প্রকাশ করল। তাতে ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, সভা সমিতি করার অধিকার এবং সংসদ (‘ডুমা’)-কে আইনসভার রূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ জার পিছু হটল। কেউ কেউ বলল, এই তো কেল্লাফতে! স্বৈরতন্ত্র শেষ, এবার ঢালাও গণতন্ত্র এলো দেশে। বলশেভিকরা বলল, লড়াইয়ের চাপে জার একটু ঢোঁক গিলেছে বটে, কিন্তু জারতন্ত্রই থেকে গেল। অতএব লড়াই থামানোর প্রশ্নই নেই, বরং তা বাড়াতে হবে।
লড়াইয়ের ব্যাপ্তি আরও বাড়লও অক্টোবর নভেম্বরে। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ মস্কোতে শুরু সাধারণ ধর্মঘট। সশস্ত্র অভ্যুত্থান। যদিও শেষঅবধি জারের সেনাদের কাছে হারতে হলো। বলশেভিক নেতারা ততক্ষণে সকলেই জেলে বা নির্বাসনে। নেতৃত্বহীনভাবে শ্রমিকরা অনেকক্ষণ লড়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। লড়াই প্রত্যাহার করা হয় ১৮ তারিখ।
লড়াই স্তিমিত হয়, ভাটা আসে একতা। তবে থেমে যায় না একেবারে। ১৯০৬ সালজুড়েও ছোটো বড়ো ধর্মঘট হয়, ১০ লাখ শ্রমিক অংশ নেয়। ১৯০৭ সালে ধর্মঘটী শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ। এর মধ্যে ১৯০৬-এ ডুমার নির্বাচন হয়, বলশেভিকরা তা বয়কট করে। ডুমা ভেঙে দেওয়া হয় কয়েক মাস পর। আবার নির্বাচন হয় ১৯০৭-এ। বলশেভিকরা এবার ভোটে লড়ে, কিছু জায়গায় জেতেও। কিন্তু আবার ভেঙে দেওয়া হয় ডুমা। জুন মাসে। ৩ জুন প্রতিক্রিয়ার অভ্যুত্থান হয়। এবং রাশিয়ায় শুরু হয় স্টালিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগ।
১৯০৫-’০৭ ব্যর্থ বিপ্লব বেশ কিছু রসদ দিয়ে যায় রাশিয়ার বিপ্লবী সংগ্রামকে। এই প্রথম শ্রমিক-কৃষক একসাথে হিসসা নেয় রাজনৈতিক সংগ্রামে। এই প্রথম দেশে গড়ে ওঠে শ্রমিকদের সোভিয়েত, এগুলোই ভবিষ্যতের সোভিয়েত রাষ্ট্রের বীজ। এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণি ও তার পার্টি পায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানেরও অমূল্য শিক্ষা। নানাবিধ ভুল থেকে পায় জরুরি অনেক শিক্ষা।
ব্যর্থ বিপ্লবের ফলে তৈরি হওয়া হতাশাকে কাজে লাগিয়ে কেউ বলল, বিপ্লবের দিন শেষ তাই পার্টিরও আর দরকার নেই। কেউ কেউ বলল, এবার সব জায়গা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা উচিত বলশেভিকদের। মার্কসবাদের উপর দার্শনিকভাবেই আক্রমণ নামল। এদিকে স্টালিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগে ধরে ধরে জেলে পোরা হয়েছে বলশেভিক নেতাদের। অনেকে নির্বাসনে। লেনিনও। বিদেশে। সেখানে বসেই দার্শনিকভাবে মার্কসবাদকে রক্ষার জন্য বই লিখছেন। এদিকে দেশে স্তিমিত হলেও লড়াই একেবারে থেমে গেছে তা নয়। ছোটো ছোটো পায়ে এগোচ্ছে শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রাম।
১৯১২ সালের ১৭ এপ্রিল সাইবেরিয়ায় লেনা স্বর্ণখনির শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাল জারের সেনারা। বলশেভিকদের পত্রিকা মারফত সে খবর ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। জ্বলে উঠল আগুন। এলো আন্দোলনের নতুন তরঙ্গ। আবার ধর্মঘটের পর ধর্মঘট। লেনিন এবারের ধর্মঘটগুলোকে বললেন, ‘বৈপ্লবিক ধর্মঘট’। বৈপ্লবিক আন্দোলনের এই নতুন পর্বেই প্রকাশিত হলো বলশেভিকদের দৈনিক মুখপত্র ‘প্রাভদা’। মানে সত্য।
১৯১২ সালে ডুমার নির্বাচন আবার। বলশেভিকদের প্রচারে আবার সাড়া দিচ্ছে রাশিয়ার শ্রমিকরা। কয়েকটা শ্রমিককেন্দ্র থেকে তারা জিতলও। আন্দোলনের জোয়ার যে কীভাবে বাড়ছিল তার প্রমাণ মিলল ১৯১৪-র ৯ জানুয়ারি। সেই রক্তাক্ত রবিবারটির বার্ষিকীতে। ধর্মঘটী শ্রমিকের সংখ্যা আড়াই লাখ। সেবছরের পয়লা মে সংখ্যাটা দাঁড়াল ৫ লাখ।
এই ১৯১৪-তেই শুরু হলো বিশ্বযুদ্ধ। ৩৮টি দেশ জড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলল, এখন দেশ খতরে মে হ্যায়, আপাতত দেশের শাসকের সাথে লড়াই বন্ধ থাক। আগে দেশ বাঁচানোর লড়াই তারপর ওসব হবে। বলশেভিকরা বলল, যুদ্ধ না থামলে দেশ বাঁচবে না, দেশের মানুষও বাঁচবে না। আসলে এই যুদ্ধ হলো বিভিন্ন দেশের পুঁজিপতিদের নিজেদের মধ্যেকার ঝামেলা, দুনিয়ার বাজারটা ভাগবাঁটোয়ারা করার জন্য। আর যাদের তারা চুষে খায় সেই গরিব চাষি, মজুরদেরকেই নিজেদের এই ঝামেলায় কামানের খাদ্য হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ওরা। এক দেশের মজুর কেন অন্য দেশের মজুরভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে? ওদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যে? দুনিয়াজোড়া সাম্রাজ্যবাদের এই যে শেকলটা এতে তো বাঁধা পড়ে আছে সব দেশের মজুররাই। তাই সত্যিই যদি বাঁচতে হয় তাহলেই এই শেকলের সবচেয়ে দুর্বল গ্রন্থিটাতে আঘাত হানতে হবে। এবং লেনিন তাঁর বইতে যুক্তি দিয়ে দেখালেন যে রাশিয়াই হলো সেই দুর্বলতম গ্রন্থি। অতএব এখন সময় সাম্রাজ্যবাদী এই যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার।
কে করবে? শ্রমিকরা করবে। চাষিরা করবে। এবং সেনাবাহিনির উর্দি পরা চাষার ঘরের সন্তানেরা করবে। অর্থাৎ সেনারা। চূড়ান্ত এই আঘাত হানার সময় তাই বলশেভিকরা স্লোগান দিয়েছিলেন “রুটি, জমি, শান্তি”। শ্রমিক, কৃষক ও সেনাদের দাবি।
সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে এই বোঝাপড়া লেনিনের অন্যতম অবদান। মার্কস-এঙ্গেলসের সময় পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের এই স্তরে প্রবেশ করেনি। তখন ছিল পুঁজিবাদের ছেলেবেলা, বাড়ন্তবেলা। এখন, সাম্রাজ্যবাদের এই যুগে, সে মুমূর্ষু। মরণাপন্ন। এখনই গোর দিতে হবে তাকে। যদিও লেনিন বললেন আর সকলে মেনে নিল, এত সহজ হয়নি ব্যাপারটা। পার্টির ভেতরে, এমনকী অন্য দেশের পার্টিগুলির বিভিন্ন নেতার সাথেও ব্যাপক মতাদর্শগত লড়াই লড়তে হয় তাঁকে। বলশেভিকদের।
আর এই লড়াইতে লেনিনের ও বলশেভিকদের সবচেয়ে বড়ো সুবিধেটা ছিল শ্রমিক-কৃষকদের অভিজ্ঞতা। জীবনের অভিজ্ঞতাতেই তাঁরা বুঝছিলেন যে, এই যুদ্ধ আসলে সর্বনাশাই। ফলে বলশেভিকদের শান্তির দাবিতে তাঁরা সাড়া দিচ্ছিলেন ব্যাপক। এরই মধ্যে রাশিয়া প্রবেশ করে ১৯১৭ সালে।
ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ একটা বড়ো ধর্মঘট শুরু হয় পুতিলভ কারখানায়। ২২ তারিখের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য কারখানাগুলিতেও। ২৩ তারিখ তা রূপ নেয় রাজনৈতিক ধর্মঘটের। নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেটা ৮ মার্চ, আন্তর্জতিক নারী দিবস। পরদিন আরও বড়ো ধর্মঘট, মিছিল, পুলিশ হামলা করতে এলে সশস্ত্র প্রতিরোধ হয়। ২৬ তারিখে পেত্রোগ্রাদের কিনারাবর্তী গোটা জেলা চলে আসে শ্রমিকদের দখলে। শ্রমিক কৃষকদের ওপর গুলিচালনার নির্দেশ অমান্য করে সেনারা। ২৭ তারিখ সকালে বিদ্রোহী সেনার সংখ্যা ১০ হাজার, দুপুরে ২৫ হাজার, সন্ধ্যায় ৬৭ হাজার। ভয়ে আগের দিনই ডুমা ভেঙে দিয়েছে জার। তবে তার মন্ত্রণাদাতা বুর্জোয়া ডেপুটিরা রাতারাতি বানিয়ে নিল ডুমার অস্থায়ী কমিটি। শ্রমিক ও সেনাদের পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতও তৈরি হয়ে গেল সেই ২৭ রাতেই। ২ মার্চ ইস্তফাপত্রে সই করল জার। বুর্জোয়া ডেপুটিদের অস্থায়ী ডুমা কমিটি এবং শ্রমিক ও সেনাদের সোভিয়েত দুইয়ের চুক্তিতে তৈরি হল অস্থায়ী সরকার।
১৯০৫-এর গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যর্থ হলেও, ’১৭-র ফেব্রুয়ারি-মার্চে সফল হলো।
দীর্ঘ ১০ বছর নির্বাসন শেষে ৩ এপ্রিল দেশে ফিরলেন লেনিন। পেত্রোগ্রাদ স্টেশনে। হাজার হাজার শ্রমিক উপস্থিত। স্টেশন চত্বরে পড়ে থাকা সাঁজোয়া গাড়িতে উঠে তাঁদের সামনে বক্তৃতা করলেন তিনি। বললেন, এখানে থামলে চলবে না। গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে এবার এগোতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে। শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে।
৪ তারিখ সকালে লেনিন মিটিং করলেন শ্রমিক ও সেনাদের ডেপুটিদের সোভিয়েতগুলোর সারা রুশ সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সাথে। পরে বলশেভিক ও মেনশেভিক নেতাদের সাথে যৌথ সভা করলেন। এখানে তিনি যা বললেন তাই ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে বিখ্যাত। মোদ্দা বক্তব্য ছিল, “পুঁজিকে উৎখাত না করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানো অসম্ভব।’’ কোনও সংসদীয় সাধারণতন্ত্রেও আর কাজ চলবে না। শ্রমিক-সোভিয়েত থেকে এখন সংসদীয় সাধারণতন্ত্রে ফিরে যাওয়াটা হবে উল্টোমুখে পদক্ষেপ। এখন চাই “সারা দেশে আগাগোড়া শ্রমিক, খেতমজুর এবং কৃষক প্রতিনিধিদের সাধারণতন্ত্র। ...সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে।’’
যদিও দেশের সমস্ত সোভিয়েতে বলশেভিকরা তখন সংখ্যালঘু। আর বুর্জোয়া অস্থায়ী সরকারের দালাল মেনশেভিকরা সংখ্যাগুরু। এখন বলশেভিকদের কাজ হবে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার। অস্থায়ী সরকার যে তাঁদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ, এটা তাঁদের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে তাঁদের বলা। এই কাজটাই তাঁরা করে চললেন। এদিকে লেনিনকে আবার নির্বাসনে যেতে হলো। এবার নির্বাসনে তিনি লিখতে শুরু করলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’।
কিন্তু বই লিখতে লিখতেই পরিস্থিতি পালটাতে শুরু করে দেশে। বই লেখা থামিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিকে চিঠি লিখতে বসেন তিনি। ১৫ সেপ্টেম্বরের সেই চিঠিতে কী বার্তা ছিল? এক্ষুণি শুরু করতে হবে অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান শুরু করতে নির্দেশ দিয়ে নিজে বসে থাকবেন দূরে, এমন নেতা ছিলেন না লেনিন। বই লেখা থামিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই দেশে ফিরলেন, এসে দাঁড়ালেন লড়াইয়ের মাঠে, নেতৃত্ব দিতে। অক্টোবরের ৭ তারিখ। ১০ তারিখে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিঙে বসলেন। যুক্তি দিয়ে বললেন - কেন আর কাল বিলম্ব করা যাবে না! কেন তাড়াতাড়ি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে। ১২ হাজার লালরক্ষী প্রস্তুত ততক্ষণে।
১৬ তারিখ আবার কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং। ১৮ তারিখ দু’জন বেইমান মেনশেভিক কাগজে ফাঁস করে দিল অভ্যুত্থানের গোটা পরিকল্পনাটা। সরকারও প্রস্তুত হয়ে গেল অভ্যুত্থান মোকাবিলা করার জন্য। বলশেভিকদেরও সব প্রস্তুতি সারা। এইবার দেখা যাবে, কার কত দম!
২৫ অক্টোবর (নতুন ক্যালেন্ডারে ৭ই নভেম্বর) শুরু হবে সারা-রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসের দ্বিতীয় কংগ্রেস। ২১ তারিখে বলশেভিক নেতাদের নিয়ে মিটিঙে বসলেন লেনিন, বললেন, ২৪ তারিখ (নতুন ক্যালেন্ডারে ৬ই নভেম্বর) কংগ্রেসের সমস্ত প্রতিনিধি পেত্রোগ্রাদে এসে পৌঁছাবেন না। অথচ বিপ্লবের একটা সারা-রুশ ভিত্তি চাই। তাই সেদিনটা অভ্যুত্থান শুরুর জন্য বেশি জলদি হয়ে যাবে। আবার ২৬ তারিখে (অর্থাৎ ৮ নভেম্বর) হয়ে যাবে বেশি দেরি। কেননা ততক্ষণে কংগ্রেস বসে যাবে আর অত বড়ো একটা সংগঠিত সভার পক্ষে দ্রুত ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। অতএব আঘাত হানতে হবে ২৫ অক্টোবরই (৭ নভেম্বর)। অকাট্য যুক্তি, অকাট্য সিদ্ধান্ত।
আর এই সিদ্ধান্ত মতোই ৭ নভেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগেই, তিনটের সময়, নেভা নদীর তীরে নিকোলায়েভস্কি ব্রিজের সামনে নোঙর ফেলে অরোরা জাহাজ। লালরক্ষী বাহিনী ঘিরে নেয় জারের শীতপ্রাসাদ। তার আগেই ডাকঘর, রেলস্টেশন দখল হয়ে গেছে। সকাল ১০টায় কংগ্রেসের জন্য উপস্থিত সোভিয়েতের প্রতিনিধিদের সামনে উপস্থিত হয়ে লেনিন ঘোষণা করলেন, সামরিক-বিপ্লবী কমিটির পক্ষ থেকে ঘোষণা করলেন, “অস্থায়ী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। ...শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!”
৭-১৭ এই দশদিনে দুনিয়া কাঁপানো ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সম্পন্ন হয় মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। পৃথিবীর বুকে এই প্রথমবার।