৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০
নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে ভারতসহ উপনিবেশের স্বাধীনতার লড়াই
দেবাঞ্জন দে
মহান নভেম্বর বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার ঠিক ৬৪ বছর আগে আগস্ট, ১৮৫৩-র 'ট্রিবিউন' পত্রিকায় কার্ল মার্কস প্রাক্ আধুনিক ভারতীয় সমাজকে ব্যাখা করলেন ‘‘প্রতিরোধহীন ও পরিবর্তনহীন’’ বলে। সামনে রাখলেন এমন এক ধারণা যে নিজ মুনাফা গড়ার স্বার্থেই ব্রিটেন ভারতে আধুনিক উপাদান আমদানি করছে বলেই তার ধ্বংসাত্মক ও নিপীড়নমূলক আচরণকে উপেক্ষা করা চলে। সিদ্ধান্ত বদলালেন ঠিক চার বছরের মাথায়- ১৯৫৭’র মহাবিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে। ঘটনাচক্রে ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে এই পূর্ব ধারণা ’৫৭- পরবর্তী কোনো রচনায় আর উচ্চারিত হয়নি। ১৮৫৭-৫৮ সালের নোটসের পাণ্ডুলিপি, যা পরবর্তীতে গ্রুন্ডিসে নামে পরিচিত, সেখানে মার্কস ভারতে এক অনন্য সামাজিক কাঠামোর ব্যাখা সামনে আনলেন, যা দাসপ্রথার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। যা মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল-যৌথ কৃষিকাজ ব্যতিরেকে গ্রামীণ সমাজ ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্র যা আসলে জমিদারদের খাজনাই কর হিসেবে আদায় করে। প্রাক্ ধনতান্ত্রিক এই ব্যবস্থাকে ব্যাখা করতে ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডে অধনতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে ধনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ছাড়া কাজ করে তা বোঝাতে ভারত সম্পর্কে বহু তথ্য ব্যবহার করেছিলেন।
ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডেই পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের ব্যাখা প্রসঙ্গে মার্কস বলছেন, ‘‘আমেরিকায় সোনা ও রূপোর আবিষ্কার, আদিম অধিবাসীদের সমূলে উৎপাটন, দাসত্ব ও খনিতে প্রোথিত করা, পূর্ব ইন্ডিজ (ভারত ও পূর্ব এশিয়া) দখল ও লুটপাট শুরু, আফ্রিকাকে কালো চামড়ার বাণিজ্যিক শিকার এক ভূখণ্ডে পরিণত করা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের স্বর্ণালী উষার সূচনা করেছিল। এই মনোরম প্রক্রিয়া আদিম সঞ্চয়ের মুখ্য মুহূর্ত।’’ আদিম সঞ্চয়, যা কিনা বর্বর লুট তার অভ্যন্তরীণ উৎসের বাইরে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ইংলন্ডে উপনিবেশগুলির সম্পদ চালানের মধ্য দিয়েই ধনতন্ত্রের দ্রুত উত্থানের পথ প্রশস্ত হচ্ছিলো। ’৫৩ সালেই মার্কস চিহ্নিত করেন ব্রিটিশ অর্থতন্ত্র ভারতে লুটের জন্য প্রস্তুত ও মিলতন্ত্র বাজার দখলের পরিকল্পনায়। ’৫৯ সালে স্পষ্টতই দেখতে পান, চীনের সাথে ব্রিটিশ বাণিজ্য ঘাটতি ৬০লক্ষ পাউন্ডের অধিক এবং তা মেটানো হয়েছে ভারত থেকে চীনে আফিম ও তুলো রপ্তানির ৯০ লক্ষ পাউন্ড উদ্বৃত্তের মাধ্যমে। ক্যাপিটালের তৃতীয় খণ্ডে মার্কস ভারত থেকে ইংলন্ডে ‘ট্রিবিউট’ যাওয়ার হিসেব পেশ করে দেখান ’৫৫ সাল নাগাদ তা প্রায় ৫০লক্ষ পাউন্ড। লুটপাটের এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে প্রথম সুনির্দিষ্ট মাইলফলকের খবর পেয়ে মার্কস লক্ষ করলেন সিপাহিদের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তা ব্যাপক অংশের জনগণকে একজোট করার দিকে এগিয়েছে। অভিহিত করলেন প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে।
’৮১ তে ড্যানিয়েলসন’র প্রতি লেখা চিঠিতে শোষণের মাত্রা বোঝাতে উল্লেখ করলেন বার্ষিক যে ট্রিবিউট ভারত থেকে ইংলন্ডে যাচ্ছে তা ভারতের ৬কোটি কৃষি ও শিল্পশ্রমিকের মোট আয়ের থেকেও অধিক। সাথে আশার আশ্বাসে লিখলেন, ‘‘ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের সহযোগিতায় প্রকৃত ষড়যন্ত্র হচ্ছে’’। প্রায় একই সময়ে ’৮২ সালে এঙ্গেলস লিখলেন কাউৎস্কি’কে, ‘‘ভারতে হয়তো, খুবই সম্ভবত, বিপ্লব হতে চলেছে এবং মুক্তিকামী (ইয়োরোপীয়) প্রলেতারিয়েত যেহেতু উপনিবেশে যুদ্ধ করতে পারবে না, সেই সম্ভাবনাকে পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে।’’ ’৫৭-র স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের এই সম্ভাবনা ব্রিটিশ শাসকের দমন-পীড়নের মুখে ব্যর্থ হলেও, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের স্ফুলিঙ্গের উত্তাপে ব্যাপক অংশের জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল এবং ধনতন্ত্রের লুঠতরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে স্বাধীনতার লড়াইয়ের এক অস্পষ্ট গ্রন্থি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল।
এর ঠিক ৬০ বছরের মাথায় ১৯১৭ সালে, বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণের মাধ্যমে মার্কসবাদের সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় মহান নভেম্বর বিপ্লব। প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত সমাজতন্ত্র। সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিতে শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার লেনিনীয় সম্ভাবনার সূত্রকে সফল করে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ ধনতান্ত্রিক বিকাশের রাশিয়া দুনিয়ার সামনে উন্মোচন করে ধনতন্ত্রের অসাড়তা, সামনে নিয়ে আসে সমাজতান্ত্রিক বিকল্প ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থার দিকনির্দেশক কাঠামোকে। বিশ শতকের দুনিয়ার ইতিহাসের ধারা পরিবর্তনের সবচেয়ে নির্ণায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ নভেম্বর বিপ্লব বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসে বিপ্লবের অনিবার্যতা ও প্রাক্শর্তগুলিকে। শোষণহীন সমাজ গড়ার পাশাপাশি উন্নত সৃজনশীল মানবসভ্যতা গড়ার বিকল্প হিসেবে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ আলোড়ন ঘটায় দুনিয়ার প্রতিটা প্রান্তে। মুক্তিকামী মানুষ স্বপ্ন দেখার পর্ব সেরে তা সত্যি করার সন্ধানে এগোয়, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ কাঠামো সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সমাজতন্ত্রের।
মার্কসবাদী বোঝাপড়াকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লেনিন সূত্রায়িত করলেন পুঁজির কেন্দ্রীভবনের মাধ্যমে একচেটিয়া পুঁজির জন্ম ও সাম্রাজ্যবাদী পর্বে তার উপনীত হওয়ার ফলে গোটা দুনিয়াকে পুঁজিবাদী শোষণ কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার ছক। একইসাথে পুঁজির দখলদারির স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ার সাথে সাথেই বিশ্বযুদ্ধের আবহে রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থি হিসেবে উন্মোচিত হওয়া। যার ফলে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে লেনিন পরিণত করলেন মুক্তির গৃহযুদ্ধে, রুশ শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে। পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ ধনতান্ত্রিক বিকাশের দেশে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল মোচন করার সাথে প্রতিষ্ঠা পেল এক দেশে সমাজতন্ত্রের ধারণা ও অনগ্রসর অর্থনীতি থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তরের পথে বিপ্লবের স্তরের লেনিনীয় তত্ত্ব। প্যারি কমিউনের শিক্ষার কথা মাথায় রেখে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর বুনিয়াদ মজবুত করে পশ্চাৎপদ দেশে সামাজিক রূপান্তরের পথের হদিশও উন্মোচিত হলো। গুরুত্বপূর্ণভাবে সামনে চলে এলো উপনিবেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দুনিয়াজোড়া লড়াই সংগ্রামকে সূত্রায়িত করার পথনির্দেশনা।
১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে গৃহীত ইশতেহারে উচ্চারিত হলো আন্তর্জাতিকতাবাদের নয়া পাঠক্রম। উপনিবেশের শ্রমিক-কৃষকের লড়াইয়ের সাথে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করা হলো পাশ্চাতের সংগ্রামী ভাবনাকে। ধনতান্ত্রিক ইয়োরোপের ঔপনিবেশিক শোষণ কাঠামোর বিরুদ্ধে ডাক দেওয়া হলো সমাজতান্ত্রিক ইয়োরোপের উপনিবেশের মুক্তিসংগ্রামে মতাদর্শগত, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ও সংহতির আওয়াজ। সেই আওয়াজ আরও সুস্পষ্ট হলো ’২০ সালের বাকুতে দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রাচ্যের উপনিবেশের মুক্তিকামী প্রতিনিধিদের একজোট করার মাধ্যমে। ইতিহাসবিদ ইএইচ কার বাকু কংগ্রেসকে অভিহিত করেছেন পাশ্চাতের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রাচ্যের ডাক হিসেবে। প্রায় ২৬টা দেশ থেকে আসা ২০০০’র অধিক প্রতিনিধিদের সম্মেলন সংগঠিত হয়। গঠিত হয় ‘‘প্রাচ্যের জনগণের প্রচার পরিষদ’’। পেশ হয় লেনিনের জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে থিসিসের খসড়া। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাথে একসূত্রে যুক্ত করা হয় উপনিবেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংঘর্ষে আগত সোভিয়েত সমাজতন্ত্র পরাধীন দেশগুলিতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের প্রস্তাব আসে।
ডাক আসে কমিউনিস্ট আন্তজার্তিক ও পরাধীন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি নিজ দেশের বৈপ্লবিক মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সাফল্যের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করবে এবং নয়া পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়ার গভীরতায় প্রবেশ করার বিশেষ সুযোগকে কাজে লাগাবে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র এই দেশগুলির স্বাধীনতার লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ালে, উপনিবেশের আগল ভেঙে এই দেশগুলির সামনে সমাজবিকাশের নয়া বৈপ্লবিক সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে এবং ধনতন্ত্রের পাথুরে পথ পরিহার করে, কয়েকটি অন্তর্বতীকালীন স্তরের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উপনীত হওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হবে। অর্থাৎ সোভিয়েত ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি যদি বিপ্লবের প্রবহমান ধারাকে বজায় রাখতে চায় তাহলে উপনিবেশের মুক্তিসংগ্রামের সহায়ক মিত্র তাদের হতেই হবে, আবার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যদি গভীরতায় প্রবেশ করে সাফল্যে পরিণত করতে হয় তাহলে সমাজতান্ত্রিক দেশের সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব নয়। উল্লেখযোগ্যভাবে এই ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র আট বছরের মধ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল ৪৬টি কমিউনিস্ট পার্টি, পনেরো বছরের মধ্যে সংখ্যাটা পৌঁছায় ৬১টিতে।
মাসখানেকের মধ্যেই মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি এবং আরও দুই খিলাফত আন্দোলনকারীদের হাত ধরে তাসখন্দে গড়ে ওঠে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। দেশের স্বাধীনতার লড়াইকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দুনিয়াজোড়া লড়াইয়ের সাথে সূত্রায়িত করার কাজ শুরু হয় খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতেই। পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন স্বামী কুমারানন্দ ও মৌলানা হসরত মোহানির পক্ষ থেকে পেশ করা হয় পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব। গৃহীত না হলেও সম্পূর্ণ বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াইয়ের এই ডাক আলোড়ন ফেলে গোটা দেশজুড়ে। ’২২ সালে গয়া অধিবেশনে ব্রিটিশ কমনওয়েলথে সমান অংশীদারিত্বের তত্ত্ব উত্থাপিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্তেহারে। ’২৭ সালে মাদ্রাজ অধিবেশনে জওহরলাল নেহরুর পাশাপাশি পূর্ণ স্বরাজের দাবিকে সামনে রাখেন কমিউনিস্ট প্রতিনিধি যোগলেকর। ’২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনে উল্লেখযোগ্যভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার স্লোগান তুলে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে মিছিল সংগঠিত করে প্রায় ৫০,০০০ শ্রমিক। ’২৯-র লাহোর অধিবেশনে গৃহীত হয় পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব। মধ্যরাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এক নয়া পর্যায়ে উন্নীত হয় ভারতের স্বাধীনতার লড়াই। পতাকার রং ছিল লাল, সাদা ও সবুজ - সমাজতান্ত্রিক ভাবনার নির্ণায়ক লাল রঙ বদলে পরবর্তীতে যুক্ত হয় গেরুয়া। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় দেশজুড়ে। বোম্বেতে জাতীয় পতাকার পাশাপাশি উত্তোলিত হয় লাল পতাকা।
একই বছর সামনে আসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মপন্থা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে রচিত কর্মপন্থা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যুক্ত করলো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে - প্রথমত, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে বুর্জোয়া সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে সংযুক্ত করা হলো কৃষিবিপ্লবের সাথে। দ্বিতীয়ত, সংযুক্ত করা হলো পুরোনো সামাজিক ধর্মীয় ব্যবস্থা দ্বারা আরোপিত সমস্ত ধরনের বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে। ঘোষিত হলো - ‘‘ভারতীয় জনসাধারণের দাসত্ব বন্ধনের উচ্ছেদ ঘটাতে হলে এবং যে দারিদ্র্যের কবলে শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষকেরা নিষ্পেষিত তা থেকে তাদের মুক্ত করতে হলে দেশের স্বাধীনতা অর্জন জরুরি এবং মধ্যযুগ থেকে এযাবত জিইয়ে রাখা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে দিতে ও সমগ্র ভূখণ্ডকে যাবতীয় মধ্যযুগীয় আবর্জনা থেকে উদ্ধার করতে যা সমর্থ, সেই কৃষিবিপ্লবের পতাকা জমিদারি ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা একান্তভাবে আবশ্যক। ব্রিটিশ পুঁজি ও জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৃষিবিপ্লবকেই হতে হবে ভারতে সেই বৈপ্লবিক মুক্তি অর্জনের ভিত্তি।’’
নভেম্বর বিপ্লব দ্বারা অর্জিত আত্মবিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিণত হলো বৈপ্লবিক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে। জাতীয়তাবাদী ধারার পর্ব শেষ করে বিপ্লববাদী ধারার প্রসারে যুক্ত হলো একের পর এক নয়া উপাদান। বিপ্লববাদী ধারার সশস্ত্র সংগ্রামের প্রাথমিক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গ কাটিয়ে তা উন্নীত হলো ধর্মনিরপেক্ষ দেশপ্রেমের নির্ণায়ক শক্তিতে। একইসাথে যুক্ত হলো সমাজতন্ত্রের ভাবনা। বৈদেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তির লড়াই উপনীত হলো শোষণহীন সমাজ গড়ার লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে। এই দুই প্রবণতার উন্মেষের ধারাতেই গড়ে উঠলো ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তৃতীয় ধারাটি - সংগঠিত গণআন্দোলনের ধারা। মূলত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক, ছাত্র, লেখক-শিল্পীদের আন্দোলনের উত্তাপে।
ফ্যাসিবাদের উত্থানের সাথে সাথে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নয়া মাইলফলক গড়ে তুললো দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষের পয়লা নম্বর দুশমনের বিরুদ্ধে জানকবুল লড়াইয়ের বীরগাথা রচনা করে। এই পর্বে উপনিবেশগুলির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সর্বোচ্চ তীব্রতায় পৌঁছালো। সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বেপরোয়া ও মারাত্মক রূপের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাথে আরও গভীর সূত্রে আবদ্ধ হলো পরাধীন দেশগুলির স্বাধীনতার লড়াই। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে ফ্যাসিবিরোধী লড়াই সংগ্রাম সংগঠিত করার কর্মকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ডিমিট্রভ চিহ্নিত করলেন - ‘‘এইসব দেশে গড়ে তুলতে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণফ্রন্ট। এইসব দেশে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে যে গণভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন চলছে তাতে কমিউনিস্টদের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে।’’ সব মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইকে তীব্র থেকে তীব্রতর করাই ছিল কমিউনিস্টদের প্রধান কাজ। একদিকে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি এই কাজ করে চলেছিল তেমনই এশিয়ায় জাপানি সমরবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিল চীন, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়ার পার্টি ও জনগণ। ভারতের মাটিতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কার্যক্রম যুক্ত হয়েছিলো স্বাধীনতার লড়াইয়ের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থি সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারাকে রক্ষা করার ডাকে। এই সময়ে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আন্দোলনের শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়েই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লাল ফৌজের বিজয়ের সাথেই দিকে দিকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম দুর্দমনীয় আকার ধারণ করে। রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকা ওড়ানোর পঁচিশ বছরের মধ্যে প্রায় একশোটি দেশ ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
নভেম্বর বিপ্লবের চিন্তাধারা উপনিবেশের স্বাধীনতার লড়াইতে যে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল তার একটি অনবদ্য চিত্র ফুটে ওঠে ১৯২০ সাল নাগাদ প্যারিসের এক রেস্টুরেন্টে বাসন মাজার কাজে নিযুক্ত কর্মরত এক শ্রমিকের বণর্নায় - ‘‘ল্যুমেনাইট প্রকাশিত লেনিনের ‘জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে থিসিস’ পড়তে দিলেন এক কমরেড। থিসিসে এমন সমস্ত রাজনৈতিক ভাষা ছিল যা সহজবোধ্য নয়। কিন্তু বারবার পড়ে আমি তার মূল মর্ম বুঝতে পারলাম। আমার মধ্যে কি পরিমাণ আবেগ, উৎসাহ, স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস এনে দিল ওই থিসিস! আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল। যদিও আমি একাই ঘরে বসেছিলাম, আমি চিৎকার করে উঠলাম যেন বিশাল জনতার সামনে বক্তৃতা দিচ্ছিঃ প্রিয় শহিদ দেশবাসীরা! এই হচ্ছে যা আমরা চাই, এই হচ্ছে আমাদের মুক্তির পথ!’’ নভেম্বরের বিপ্লবের আলোকে নিজের দেশকে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জেদ, আত্মবিশ্বাস, চিন্তাধারার উত্তাপ গ্রহণ করা এই শ্রমিকের নাম - হো চি মিন! শহিদ-এ-আজম ভগৎ সিং কি নিজের জীবনের শেষ কয়েকটা ঘণ্টা জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে বসে এমনই কিছু ভাবছিলেন?