৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০
পুঁজিবাদী সংকট ও ভারতের অর্থনীতির অভিমুখ
সৌভিক ঘোষ
প্রেক্ষাপট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে অর্থনীতির নামে নয়া-উদারবাদী মডেলের মূলকথা তিনটি। এক - ব্যাপক জোগান-নির্ভর গোঁজামিলের অর্থনীতি। বাজারে ক্রেতার সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাবে এবং তার ধাক্কা সামলাতে ক্রমাগত দাম বাড়িয়ে চলা হবে। দুই - পুঁজির অবাধ চলাচল নিশ্চিতকরণ অর্থাৎ মুনাফার গন্ধ পাওয়া পুঁজি আচমকাই কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার দখল করবে, অভূতপূর্ব কর্মসংস্থানের অজুহাতে উচ্ছেদ করবে সেদেশের যাবতীয় উৎপাদন-বণ্টন ব্যবস্থাকে এবং মুনাফার হার কমতে শুরু করার মুহূর্তেই পুঁজি সেই বাজার ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে স্বাধীন থাকবে। সবশেষে তিন - প্রথম দুটি বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রথমে দুর্বল, গরিব দেশে ঋণ রপ্তানি করা হবে, তারা ঋণ নিতে অস্বীকার করলে যুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়া হবে - ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ সেটাই। আরও পরে ঋণচুক্তির জোরে সেইসব দেশের যাবতীয় জনকল্যাণমুখী সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বাতিল করে দেওয়া হবে - গ্রিস, আর্জেন্টিনা এবং শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অবস্থাই এসবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ক্ল্যাসিকাল বা ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্রীরা একটি মৌলিক ধারণার উপরে ভিত্তি করে যাবতীয় তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। মূল কথাটি ছিল বাজার ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্রীয় অথবা সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া চলতে পারে তবে বেকারির সমস্যা কখনোই তৈরি হবে না। অর্থশাস্ত্রে এহেন উপপাদ্যের ভিত্তি ছিল দুটি। প্রথম - বাজারে কাজ না থাকলে মালিকরা সবাই মিলে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কমিয়ে দেবে, এর ফলে শ্রমিকদের নিয়োগ করতে বাজারে নতুন করে উৎসাহের পরিবেশ তৈরি হলে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে, ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে। দ্বিতীয় - পথটিকে সাপ্লাই ড্রিভেন (জোগান নির্ভর) মডেল বলে। এর মূল কথা - চাহিদার সংকটের মোকাবিলায় পণ্যের জোগান বাড়িয়ে দেওয়া। পণ্যের জোগান বাড়াতে গেলে বাড়তি উৎপাদনের জন্য আরও বেশি শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। ইতিমধ্যে যারা কাজ হারিয়েছে তাদের কেনার ক্ষমতা কমেছে, ফলে বাজারে চাহিদার সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থার মোকাবিলা করতে নতুন নিযুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীরা বাজারে উপযুক্ত ক্রেতা হিসাবে হাজির হবেন এবং তখনই মন্দার অবস্থা কেটে যাবে, ফলে পুনরায় কাজের বাজারে তেজিভাব ফিরে আসবে, ফলে সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সবাই আবার কাজ পাবে। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও এমন কিছু ঘটেনি।
(দুই)
দেশ গঠন বা ইতিহাস
যেসকল প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বাধীন ভারতে দেশের সরকার এগিয়েছিল পরে তারা ধীরে ধীরে সেই অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসে। কাজের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু হলেও কোনোটাই শেষ হয়নি। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এসবের একটি ক্ষেত্রেও আমরা শেষ বিচারে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারিনি। নিজেদের দেশে আমরা কোন্ পথে চলব সেই সংক্রান্ত রাজনৈতিক স্বাধিকারটুকু ছিল বলা যায়, বর্তমানে সেটুকুও কার্যত আর নেই। মিশ্র অর্থনীতির নাম নিয়ে শুরু করে করপোরেট, একচেটিয়া পুঁজির সমীপে আত্মসমর্পণে ব্যাপারটা শেষ করা হলো। আমরা না হলাম প্রকৃত অর্থে পুঁজিবাদী দেশ, না গড়তে পারলাম নিজেদের প্রয়োজনমতো বিকল্প অর্থনীতির উপযুক্ত পরিকাঠামো। কৃষি (অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন), শিক্ষা (অর্থাৎ দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ), স্বাস্থ্য (অর্থাৎ বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার) এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি (অর্থাৎ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ) এসবই অর্থনীতির ক্ষেত্রে একেকটি বুনিয়াদ বা পিলার। ভারতে জমিদারি ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ না করেই পুঁজিবাদী বিকাশের পথে চলা শুরু হয়েছিল। ফাঁপা জমির উপরে বিরাট অট্টালিকা নির্মাণের মতো ব্যাপার। দেশের ব্যাপক কৃষিজীবী জনগণ প্রকৃত অর্থে জমির মালিকানা পেলেন না, অথচ কৃষিকাজেই যুক্ত থাকতে বাধ্য হলেন। দেশীয় পুঁজির মালিকরা নিজেদের জোরে বড়ো বড়ো কলকারখানা গড়ে তুলতে চাইলেন না, সরকারি সাহায্যে সেই কাজ শুরু হলো। সেই সরকারি বন্দোবস্তে যেটুকু শিক্ষার সুযোগ তৈরি হলো তার সুবাদেই এক বিরাট সংখ্যায় শিক্ষিত কর্মক্ষম যুবসমাজ তৈরি হলো যারা কৃষি ব্যতীত বিভিন্ন আধুনিক পেশার কাজেও যুক্ত হতে চাইলেন। কিন্তু সরকারি পরিকাঠামো এত মানুষের উপযুক্ত কাজের সুযোগ দিতে অপারগ ছিল, অবশ্য তেমন কিছু করার কোনো পরিকল্পনাই কখনো নেওয়া হয়নি।
ঠিক কী ঘটল? স্বাধীন ভারত অর্থনীতির প্রশ্নে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকেই শুরু করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শাসন দীর্ঘকাল জোঁকের ন্যায় যাবতীয় সম্পদ লুঠ করেছে। অতএব প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর। সবাই জানে ভারি শিল্প নির্মাণ ব্যতীত একাজ হয় না। জওহরলাল নেহরু প্রথমদিকে পশ্চিমিদের সভ্যতায় ভরসা রেখেছিলেন। রপ্তানির পরেও প্রযুক্তির চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রেখে এবং চড়া হারে সুদ সহ তারা (ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা) সাহায্য করতে চাইলেন। বোঝা গেল সুদের ঢাকেই মনসা বিকিয়ে যাবে। আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। অয়েল রিফাইনারিজ, কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সার সহ বিভিন্ন কেমিক্যালস উৎপাদনী ক্ষেত্র এমনকী ইস্পাত কারখানা অবধি সেই সহযোগিতার ফলাফল। ভিলাই স্টিল প্লান্টের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা তাদেরই প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু বিরাট কারখানাই নির্মাণ করে দেয়নি, সেইসব কলকারখানায় প্রস্তুত সামগ্রীও তারা নিজেদের দেশে আমদানি করে - সোজা কথায় উৎপাদন থেকে বৈদেশিক বাজারে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির সুযোগ অবধি দিয়েছিল। আজকের প্রজন্মের অনেকেরই এসব অজানা। নয়ের দশকে বলা হলো, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার প্রায় শেষ। আমাদের রপ্তানি যেমন কম, আমদানি ততোই বেশি। অথচ আমদানির মূল অংশটা ছিল ভোগ্যপণ্যের- বড়োলোকরাই মূলত সেসবের খরিদ্দার। কিছুতেই বলা হলো না আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেই তো সরকার বাজারে চাহিদা বাড়াতে পারে, নিজেদের উদ্যোগে কারখানা বানিয়ে কর্মসংস্থান ও জোগান দুই-ই সামাল দেওয়া যায়। ওসব বললে লগ্নি পুঁজি চটে যাবে, এদেশের পুঁজিপতিরাও কাজের কাজ কিছু করবেন না। অতএব বাজার খুলে দাও। ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে আইএমএফ’র সামনে দাঁড়াতে হলো, তারাও শর্ত দিলেন যত খুশি ধার নাও, কিন্তু নিজেদের মুদ্রার দাম কমাও। ভারতীয় মুদ্রার সেই অবনমন আজও চলছে - এই প্রবন্ধ লেখার সময় এক ডলার কিনতে ৮৩ টাকা ৩১ পয়সা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নাকি গতি নেই! এরই জোরেই লগ্নি পুঁজি আমাদের দেশে ব্যাঙ্কে সুদের হার বাড়তে দিতে চায় না। মানে সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা না রেখে বিভিন্ন খাতে সরাসরি বাজারে টাকা খাটাতে বাধ্য হোক, এতে পয়সা মেটানোর আইনি বিধিনিষেধ এড়িয়ে যাওয়া যাবে। লগ্নি পুঁজির স্পর্ধা এতদূর বেড়েছে যে, তারা দেশীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আওতা থেকে নগদ অর্থসম্পর্কিত যাবতীয় ক্ষমতাকে সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছে। কিছুদিন আগেই মোদি সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলের অর্থ কমিয়ে দিতে বিশেষ ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে - লগ্নি পুঁজির কারবারে কারোর সন্দেহ হতে পারে তাই ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেওয়া গেল।
ভারতের বেশিরভাগ মানুষ কর দেন না, এমন বোকা বোকা কথাটি হিন্দি সিনেমার এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী ক’বছর আগেই প্রকাশ্যে (ট্যুইট লিখে) বলে ফেলেছিলেন। তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন সাহেব মনে করিয়ে দেন বাজারে কেনা বেচা সমস্ত পণ্যেই কর আদায় হয়। এর পরেই রাজন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে বিদেশে চলে গেলেন, ওই অভিনেত্রীও অভিনয় ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মালব্য অ্যান্ড কোম্পানি বরাবরই মরা সাহেবের কোট গায়ে চাপিয়ে সাদা চামড়ার অহঙ্কার দেখায়, তাই তারা অমন কথাকেই আরেকবার বাজারে ছড়িয়ে চলেছেন। ভারতের প্রত্যক্ষ করদাতাদের সংখ্যা সাধারণভাবে পাঁচ কি ছয় শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এরাই নাকি চাইছেন ভারতে বাদবাকি সবার জন্য সরকারি তহবিল থেকে খয়রাতি বন্ধ হোক। খয়রাতি মানে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে? জনকল্যাণে রাষ্ট্রকে যে সমস্ত দায় স্বীকার করতে হয় তার সবই নাকি পয়সা নষ্ট।
যারা বলছেন তাদের করের টাকায় খয়রাতি বন্ধ হোক তারা কি ভুলে গেছেন এই কিছুদিন আগেই অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজে গঠিত ট্রাস্টের তহবিলে জমা করা অনুদানের অর্থে করছাড়ের সুবিধার কথা ঘোষণা করেছে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস (সিবিডিটি)। তারা কি ভুলে গেছেন ওই সময়েই দেশের আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করতে স্বাধীনতার পর থেকেই যা কার্যকরী সেই প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলকে ইচ্ছাকৃতভাবে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। কেন? কারণ সেই তহবিলের হিসাব ক্যাগ (সিএজি) দ্বারা নিরীক্ষিত (অডিট) হতো। কেন্দ্রীয় সরকারের তিনজন মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী সহ মোট চারজনকে নিয়ে পি এম কেয়ার’স নামে আরেকটি তহবিল খোলা হলো। সেই তহবিলে জনগণের পয়সাতেই বিপুল অর্থের জোগান দেওয়া হলো - অথচ জনগণের দেওয়া অর্থের হিসাব-নিকাশ করার এক্তিয়ার কোনো সরকারি সংস্থার নেই! সুপ্রিম কোর্টেও তারা এর পক্ষে সওয়াল করেছে। অথচ করপোরেটদের করছাড়ে বিরতি নেই। কেউ বলতে পারেন, বাড়তি কর দেয় যারা তাদের জন্য বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়া কেন অন্যায় হবে? অন্যায়, অবশ্যই অন্যায়। কারণ যে দেশে করপোরেটদের ৩৫,০০০ কোটি টাকার মতো করছাড় দেওয়া হয় সেই দেশেই নেট ইনডায়রেক্ট ট্যাক্স (এনআইটি) আদায় হয় ৯.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা (২০২০-২১ অর্থবর্ষের হিসাব)। এই কর শুধু বড়োলোকেরা দেন না, সারা দেশের সমস্ত জনসাধারণ একসাথে জেনারেট করেন। যদি গোদা ভাবেও হিসাব করা হয় যে, ভারতে বড়োলোক ও শ্রমজীবীদের আনুপাতিক উপস্থিতি ৭০:৩০, তবে সরকারি ভরতুকিতে কাদের অধিকার বেশি? অথচ এদেশেই করোনা সংক্রমণে কাজ হারানো গরিব পরিবারগুলি মাথার উপরে ছাদ পায় না, বিনামূল্যে জরুরি অক্সিজেন সিলিন্ডার পায় না, উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য মেলে না তাদের, শিক্ষার সুযোগ পেতে নেট প্যাকেজ রিচার্জ করতে হয়।
আসলে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বাজার ভারতকে কবজা করতে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির দরকার ছিল সরকারের নামে এমন কারোর, যাদের অতীতেও বেপরোয়া পুঁজি বিরোধী কোনোরকম কর্মসূচি ছিল না, এখনও নেই। ইউপিএ আমলের শাসন দেখার পরে জাতীয় কংগ্রেসকে দূরে সরিয়ে বিজেপি’কে পছন্দ করার আসল কারণ সেটাই। নরসিমা রাও’র আমলে নয়া উদারবাদ আইনানুগ করা হলে লালকৃষ্ণ আদবানি সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন - ‘এতদিনে সরকার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার পক্ষে আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি’। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদি যা কিছু করেছিলেন তাতেই বোঝা গেছিল লুটেরা পুঁজির স্বার্থরক্ষায় আপাতত এদেশে তার জুড়ি নেই। আর তাই মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। ওটা লুঠেরা পুঁজিরই উল্লাস।
(তিন)
আজকের ভারত
নয়া-অর্থনীতির প্রকোপে আমাদের দেশে দুটি সমস্যা সবচেয়ে উৎকট চেহারা নিয়েছে। বেকারি ও মূল্যবৃদ্ধি দুই-ই বেড়েছে। পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ একাধিক। ভারতের ক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনা উৎপাদনে ঘাটতি - অর্থাৎ উচ্চ হারে চাহিদার অবস্থায় জোগানের ঘাটতি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, তখন পরিকাঠামো খাতসমুহে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে চাহিদা-জোগানের ফারাক মেটাতে হয়। এমন না হলে বাড়তি মুনাফার আশায় বেআইনি মজুতদারির সুযোগ তৈরি হবে। দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ নিয়ন্ত্রণহীন আমদানি-রপ্তানি, বিশেষ করে যখন অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ক্রমশ চেপে বসছে সেই অবস্থাতেও জরুরি সামগ্রীকে নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে না আসা।
প্রথম সম্ভাব্যতার আলোচনার সময় মনে রাখতে হবে সরকারের কাছে বাজারের ওঠানামার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে রাখার উপায় থাকায় প্রতিষেধক হিসাবে অনেকটা আগে থাকতেই গণবণ্টন ব্যবস্থা (পিডিএস)-কে আরও মজবুত করা উচিত ছিল। প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত পরিকল্পনা মাফিক সরকারি খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণকে খাদ্যশস্যের মজুত ও বণ্টনে ব্যবহার করা। পরিকল্পিত অর্থনীতি নয়া-উদারনীতির স্বার্থক্ষুণ্ণ করে, সবকিছুকেই খোলা বাজারের ভরসায় ছেড়ে দিয়ে সরকার নিজের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায় - একথা আর তত্ত্ব নয়, ভারতের জনসাধারণ নিজেদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতায় বুঝে নিচ্ছেন। তাই দাম বাড়লেও সরকারের কিছুই করার নেই এমনটা প্রচার করে দেশের মানুষকে ভুখা পেটে দিন গুজরানে বাধ্য করতে চাইছে মোদি সরকার।
নরেন্দ্র মোদির দূরদৃষ্টি অনুযায়ী আত্মনির্ভরতা অর্জন করতে গিয়ে একের পর এক কেন্দ্রীয় বাজেটে জনকল্যাণ খাতের যাবতীয় বরাদ্দে কাটছাঁট করা হয়েছে। এই জন্যই গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র কৃষিকাজে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সেই উৎপাদন ঘাটতিই মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। একইসাথে রোজগারের সুযোগ কমে যাওয়ায় গ্রাম ভারতের এক বিশাল অংশের মানুষেরই ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
এমন পরিস্থিতির মোকাবিলায় দ্বিবিধ পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমটি নিকটতম সমস্যার সমাধানে প্রতিষেধকমূলক - অর্থাৎ সংকট আরও গভীরে যাওয়ার আগেই আপৎকালীন সমাধান হিসাবে যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীকেই গণবণ্টনের আওতায় নিয়ে আসা, অন্তত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। বিত্তবানদের সম্পত্তি কর বাড়িয়ে এবং করপোরেটদের করছাড় বন্ধ করে দিয়েই একাজে প্রয়োজনীয় বাড়তি অর্থের সংস্থান করা যায়। দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো খাতে ক্রমশ সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দেশীয় উৎপাদন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং বাজারে চাহিদা বাড়াতে এর বিকল্প হয় না। যতদিন না দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে ততদিন অবধি সংকটে পড়া দুঃস্থ পরিবারগুলির জন্য ক্যাশ ট্রান্সফার জারি রাখতে হবে।
যোগ্যতা অর্জনের পরেও উপযুক্ত কাজ না পেয়ে আমাদের দেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ৮০’র দশক থেকেই ব্যাপক হতাশ ছিলেন। চলতি বন্দোবস্তের প্রতি ক্রুদ্ধও ছিলেন - সেই সুযোগে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া গেল সরকারি বিধিনিষেধের কারণেই আমাদের দেশে শিল্প-পরিকাঠামো গড়ে তোলা যাচ্ছে না। এভাবেই বেসরকারিকরণের পক্ষে বিরাট জনসমর্থন তৈরি হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধান, কৃষিনীতি ও শিক্ষানীতির জোরেই আমাদের দেশে আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনবোধ নির্মিত হয়েছে। এই অংশের জনসাধারণ সর্বদাই আরও ভালো থাকতে সচেষ্ট এবং মূল্যবৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ খারাপ হতে দেখে ক্রমশ গরিব হতে বাধ্য হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত। এহেন পরিস্থিতির জন্য দেশীয় পুঁজিপতিদের অকর্মণ্যতা (কিংবা ধান্দার মনোভাব) আর সরকারি পরিকল্পনাহীনতার মধ্যে কোনটি বেশি দায়ী সেই প্রশ্ন ইতিহাস গবেষণার অন্তর্গত। আমরা আপাতত ফলাফলটুকুতেই নিজেদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি। ভারতের মধ্যবিত্ত জনসাধারণ যেভাবেই হোক কাজের সুযোগ পেতে যতটা আগ্রহ দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদের লুঠেরা চেহারা সম্পর্কে জরুরি পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকায় (আসলে তারা বিশ্বাস করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ আর কোনোদিন ফিরে আসবে না) নয়া-উদারবাদের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে ততটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। যারা সেইসব বিপদের কথা ভাবতে বলেছেন তাদেরকে উন্নয়নবিরোধী, পশ্চাৎপদ ইত্যাদি বলে দাগিয়ে প্রচার করা হয়েছে। আজকের ভারতে জনগণের বিরাট এক অংশের সমর্থন নিয়েই নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সত্যকে অস্বীকার করে কিছুতেই সামনে এগোনো যায় না। লেনিনের বিখ্যাত বই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’র খসড়া (আসলে প্যামফ্লেট) শিরোনামটি বিশেষরূপে প্রাসঙ্গিক। সে নামের বাংলা করলে দাঁড়ায়- কোথা থেকে শুরু করতে হবে?
নয়া-উদারবাদী জমানায় জনগণের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। স্বপ্ন দেখার অভ্যাসকে দোষারোপ না করে, স্বপ্ন পূরণের পথ নির্মাণে বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকর বিকল্প যে রয়েছে - একথা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলাই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি।
কেউ কেউ বলেন কমিউনিজম নাকি ইতিহাস। আমরা আজও জনগণকে লড়াই করতে আহ্বান জানাই। কারণ, আমরা জানি সমাজতন্ত্রের সামনে পুঁজিবাদের মুখ থুবড়ে পড়ার ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হবেই। বরং পুঁজিবাদীরাই ঠিক করুন মার্কসকে সঠিক প্রমাণ করতে এবারেও কি তারা প্রহসনেই পরিণতি খুঁজে নেবেন?