E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ / ৩০ কার্তিক, ১৪৩০

জীবনের কথা বলার লড়াই তবুও চলবে...

দীপ্তজিৎ দাস


‘We will fight for our journalistic freedom and our lives in accordance with the constitution of India.’

নিউজক্লিকের ওয়েবসাইটে এখনো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ৪ অক্টোবর সংস্থার জারি করা বিবৃতির শেষ লাইনগুলো। তার আগেরদিন গোটা ভারত টের পেয়ে গেছে মোদিরাজে নির্ভীক সাংবাদিকতার পরিণাম পাঠকের কাছে এক ক্লিকে খবর পৌঁছে দেওয়া নয় বরং এক ক্লিকে হেনস্তার বন্দোবস্ত হওয়া। ৩ অক্টোবর ভোর হতেই অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনস্ত দিল্লি পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা শাখার অফিসাররা দেশের পাঁচ শহরে প্রায় একশো জায়গায় হানা দেয় ৪৬ জন সাংবাদিক ও লেখকের বাড়িতে। টার্গেট নিউজক্লিক। কেবল ওয়েবসাইটের কর্মীরা নন, তদন্তের তালিকায় ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, উর্মিলেশ, অভিসার শর্মা, জনবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ডি রঘুনন্দন, সমাজকর্মী সোহেল হাশমিরাও, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে নিউজক্লিকের সাথে কাজ করেছেন। স্বাধীন ভারতের এমারজেন্সি ছাড়া এমন ঘটনা বিরল। প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসাবাদের আগে কোনো আইনি নোটিশ দেখানোর ধার ধারেনি অমিত শাহ’র পুলিশ। এমনকী নিউজ পোর্টালটির সাথে যুক্ত সাংবাদিকদের ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বাজেয়াপ্ত করার পর তার মেমো, হ্যাশভ্যালু, কপি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি তারা। সর্বশেষে সংবাদ মাধ্যমটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ, বিভাগীয় সহকর্মী অমিত চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা হয় নিম্ন আদালতের নির্দেশে তাঁদের আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখিতভাবে না জানিয়েই। প্রবীর পুরকায়স্থ এমারজেন্সির সময় জেলে গেছিলেন। আবারও তাঁর গ্রেফতারের মাধ্যমেই কার্যত পরোক্ষে ঘোষিত হয়ে গেল ‘এমারজেন্সি ২’।

বিজেপি সরকারের বহুচর্চিত কালা কানুন - ইউএপিএ ধারায় মামলা শুরু হয় প্রবীর পুরকায়স্থ ও অমিত চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে। কারণ হিসেবে বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসে গত ৫ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের কথা। সেই রিপোর্টে দাবি করা হয় বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে চীন অন্যান্য দেশের মিডিয়ায় টাকা ঢালছে তাদের কথা প্রচারের জন্য। এমনই এক মার্কিন বংশোদ্ভূত সাংহাই নিবাসী ব্যবসায়ী নেভিল রয় সিংহাম বিভিন্ন লাতিন ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন চীনের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য। ‘All the news that fit to print’ বলে স্লোগান দেওয়া সংবাদ সংস্থা যদিও এই অভিযোগের ‘ফিটনেসের’ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। কিন্তু তাদের রিপোর্টে কেবল উল্লিখিত ছিল নিউজক্লিকের নাম। পরবর্তী সময়ে আদালতে নিউজক্লিক চীন সরকারের প্রভাবে কোনো আর্থিক সাহায্য নেওয়া ও তাদের কথা প্রচার করার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। এমনকী তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবরে চীন বিপ্লবের ৭০ বছর নিয়ে একটি স্টোরি ছাড়া কোনো চীন সংক্রান্ত খবর আজ অবধি নেই। তবে কি মানব মুক্তির দিগন্ত দেখানো চীন বিপ্লবের অনুপ্রেরণার কথা বলা অপরাধ আজকের ভারতে? যে সকল সাংবাদিককে প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হতে হয় তাদের কথার নির্যাস থেকে জানা যায় তদন্তকারী সংস্থা বারবার তাদের কৃষক আন্দোলন নিয়ে লেখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তাদের জেরার মুখে পড়তে হয় এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে নিউজ কভার করার জন্য; দিল্লি,মণিপুরের দাঙ্গা নিয়ে সরকারের সমালোচনা করার জন্য। আসলে মানুষের কথা বলা,বাঁচার স্বপ্ন দেখা, উলঙ্গ রাজার অপকীর্তির সমালোচনা করাই আজকের ভারতে অপরাধ।

সংস্থার এডিটর ও পদস্থ কর্মকর্তার গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা বিবৃতিতে নিউজক্লিক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছে, তারা নেভিলের কথায় প্রভাবিত হয়ে কোনো সংবাদ পরিবেশন করেনি ও ভবিষ্যতেও করবে না। এমনকী নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই খবরের প্রেক্ষিতে মার্কিন সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে নেভিলের অপরাধের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে মার্কিন পত্রিকা দাঁড় করিয়েছে তাদের এক কর্মীকে, যিনি বলছেন নেভিলের মুখে তিনি বহুবার চে’র নাম শুনেছেন। অর্থাৎ আজও চে’র নাম পুঁজিবাদের দালালদের ভয়ের কারণ। মার্কিন তোষামোদে বুঁদ হয়ে থাকা মোদি সরকারও তাই ভীত। এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিডিয়া হোল্ডিং লিমিটেডের ম্যানেজার জ্যাসন ফেচার বিবৃতি জারি করেছেন। তার কথায় নেভিলের প্রাক্তন সংস্থা ‘থটওয়ার্ক’ এক সময় ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাথেও কাজ করেছে।পরবর্তীতে সেই কোম্পানি বিক্রি করে তারা পিপল সাপোর্ট ফাউন্ডেশন গড়ে তোলে। যার অন্তর্গত ওয়ার্ল্ড মিডিয়া হোল্ডিং লিমিটেড। বিভিন্ন সময় এই সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জনমুখী,প্রগতিশীল মিডিয়াকে সাহায্য করেছে। নিউজক্লিককে তাদের পাঠানো আর্থিক অনুদান সমস্ত ভারতীয় নিয়মবিধি মেনেই পাঠানো হয়েছে। কোর্টও সেই বিষয়ে অবগত। যে সরকার ৪,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহের পরও রাম মন্দিরের ট্রাস্টের বিদেশি অনুদান গ্রহণের জন্য নিমেষের মধ্যে ছাড়পত্র দিতে পারে, সংবাদ সংস্থার স্বচ্ছ অনুদান গ্রহণ দেখলেও তারা চিন্তিত হয়। এটাই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি। নিউ ইয়র্ক টাইমসে হিন্ডেনবার্গের আদানি সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তা বিজেপি সরকারের কাছে বিদেশের অপপ্রচার হয়ে যায়,আবার সেই সংবাদসংস্থার খবরের ভিত্তিতেই গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধে তৎপরতা দেখায় সরকার। কারণ যেকোনো বিরুদ্ধ মতকেই দমিয়ে দিতে চায় বিজেপি-আরএসএস।

সংবাদমাধ্যমের ধারা বদলের সাথে সাথেই এসেছে বিভিন্ন পোর্টাল,ওয়েবসাইট,সামাজিক মাধ্যম। এর মধ্যে নিউজক্লিক পোর্টাল সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এনআরসি - সিএএ বিরোধী আন্দোলন,ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অসাধারণ কভারেজের পর এই পোর্টাল হয়ে ওঠে মোদি সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বরের অন্যতম। পাশাপাশি আদানি দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিলগ্নিকরণ, মূল্যবৃদ্ধি, দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয় তারা। মানুষের জীবন যন্ত্রণার ছবি উদ্ভাসিত হয় নিউজক্লিকে। শোষিতের শৃঙ্খল মুক্তির শপথ প্রতিধ্বনিত হয় তাদের সংবাদে। স্বভাবতই তারা চলে আসে মোদি- শাহ’র রোষানলে। ২০২১ সাল থেকেই তারা অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ইডি,দিল্লির আয়কর বিভাগ বারবার হানা দেয় নিউজক্লিকের অফিসে। কিন্তু কোর্টে সমস্ত অভিযোগেই ক্লিনচিট পায় তারা। সাম্প্রতিক ইউএপিএ ধারায় অভিযোগ ছাড়াও বিদেশি অনুদান নীতি ভঙ্গের অভিযোগে গত ১১ অক্টোবর নিউজক্লিকের দফতরে তল্লাশি চালায় সিবিআই।

প্রেস মিডিয়া গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সংবাদমাধ্যমই মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্রণী প্রবক্তা,জনগণের বিবেক। দেশ ও সমাজ গঠনে, দেশে মুক্তচিন্তার চর্চা অব্যাহত রাখতে, জনজীবনের স্পন্দন প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দিতে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের কথায়, ‘Whoever controls the media, images controls the culture’। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা নেয় সংবাদপত্র। আদর্শ সংবাদপত্রের কর্তব্যের বিষয়ে গান্ধী তিনটি বিষয়ে আলোকপাত করেন। ১) জনতার মত অনুধাবন করা ও তার প্রতিফলন ঘটানো। ২) জনগণের মতকে দৃঢ়তা দেওয়া। ৩) সাহসিকতার সাথে সরকারের ত্রুটি তুলে ধরা। স্বাধীনতার পরে দেশে যে প্রেস কমিশন গঠিত হয় সেখানেও ভিন্ন মতের চর্চাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় প্রেস কমিশন সংবাদমাধ্যমের স্বকীয়তার জন্য অন্য ইন্ডাস্ট্রি থেকে মিডিয়াকে পৃথক করার সুপারিশ করে।

প্রেস মিডিয়ার এই ব্যাপক প্রভাবের জন্যই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ফ্যাসিবাদের প্রবর্তন আর প্রেসের উপর আক্রমণের সমাপতন লক্ষ করা যায়। নাৎসি জার্মানিতে হিটলার পৃথক প্রোপাগান্ডা দপ্তরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন গোয়েবলসকে। এই দফতরের নেতৃত্বেই সেই সময়ের জার্মানির সমস্ত লাইব্রেরির প্রায় এক তৃতীয়াংশ বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেন্সরশিপ জারি হয় সমস্ত সমাজতান্ত্রিক ও ইহুদি লেখকদের রচনায়। ফ্যাসিস্ট ইতালিতে মুসোলিনি সংস্কৃতি দফতরের মাধ্যমেই সমস্ত প্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। সরকারের তরফ থেকে দেওয়া সংবাদ ব্যতিরেকে অন্য কোনো খবর পরিবেশনা ছিল কড়াভাবে নিষিদ্ধ। পরাধীন ভারতেও ব্রিটিশরা সংবাদপত্র আইন এনে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। মহা বিদ্রোহ থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন - বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় রাজনৈতিক খবর পরিবেশনা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। স্বাধীনতার পরও এমারজেন্সির সময় প্রায় ২০০০ সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়, যাঁদের মধ্যে ছিলেন কুলদীপ নায়ার, বরুণ সেনগুপ্তর মতো সাংবাদিকরা।

ফ্যাসিবাদের এই প্রবণতা সুচারুভাবে বর্তমান দেশে নামিয়ে এনেছে বিজেপি সরকার। একাধিক আইনের ফাঁসে বাঁধা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন অস্তিত্বকে। সরকারি তথ্য ব্যবহার করে স্টোরি করায় নেমে এসেছে একাধিক বাধা নিষেধ। সামাজিক মাধ্যমে খবর পরিবেশনায় এসেছে কড়া নিয়মাবলি। বাদল অধিবেশনের শেষ দিন রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন বদলে আনা সংহিতা আইনের মাধ্যমে সরাসরি বিরুদ্ধ স্বর দমনের আইনি সিলমোহর দেওয়ায় উদ্যত হয়েছিল সরকার। একদিকে আইনি আগ্রাসন,তার অপরিণামদর্শী প্রয়োগ, সাথে সাথে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংবাদ সংস্থার মালিকানা গ্রহণ, দ্বৈত আক্রমণে কার্যত ভগ্ন হচ্ছে জনতার কণ্ঠস্বর। ‘ভারতীয় সংবাদমাধ্যমঃ প্রবণতা ও ধরন’ শীর্ষক সমীক্ষায় উঠে এসেছে অধিকাংশ সাংবাদিক মনে করেন তাদের চাকরির অন্যতম শর্ত বিজেপি’র হয়ে খবর করা। দেশের ৮২শতাংশ সাংবাদিক মনে করেন তাদের মিডিয়া হাউস সরাসরি বিজেপি’র পক্ষে। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মিডিয়া হাউসই মোদির পেটোয়া বুর্জোয়া গোষ্ঠীর অধীন। সাম্প্রতিককালে এনডিটিভি’র মালিকানা আদানির হাতে যাওয়ার মাধ্যমে আরও সংকুচিত হয়েছে স্বতন্ত্র মিডিয়ার পরিসর। তাই দেশ ক্ষুধা সূচকে নিম্নগামী হলে, বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষায় বেকারত্ব শীর্ষ ছুলেও মিডিয়া উদ্যত থাকে জি ২০-র সাফল্যের ফাঁপা প্রচারে, অথবা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভুলে আরএসএস’র ক্রনোলজি মেনে ‘স্বাভাবিক মিত্র’ ইজরায়েলের অমানবিকতার স্বপক্ষে জনমত গঠনে। বিপরীতে চাপা পড়তে থাকে জ্বলন্ত ইস্যুসমূহ। করপোরেট-কমিউনাল আঁতাতে আঘাত নামে ক্ষুরধার কলমে। প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-এ ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে পড়ে থাকে ১৬১ নম্বরে। বিরোধিতার পরিণামে মিডিয়ার জোটে সেন্সরশিপ। এক নোটিশে বন্ধ হয়ে যায় কাশ্মীরওয়ালা সহ একাধিক ইউটিউব চ্যানেল। তানাশাহির মুখোশ ছিড়লে তদন্তকারী সংস্থা লেলিয়ে দেওয়া হয় বিবিসি, দৈনিক ভাস্কর, নিউজলন্ড্রির বিরুদ্ধে। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ফেক নিউজ ধরিয়ে দেওয়ার পরিণামে জেলে যেতে হয় মহম্মদ জুবেইরকে। দাঙ্গাকারীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কারাবরণ করেন তিস্তা শীতলবাদ। মধ্যপ্রদেশের বিধায়কের কুকীর্তি ফাঁসের দায়ে নগ্ন করে রাখা হয় সাংবাদিকদের। অথবা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার যুক্তিতে খণ্ডন করলে নিথর হয়ে যেতে হয় গোবিন্দ পানসারে, গৌরী লঙ্কেশদের। সমীক্ষায় উঠে আসে কেবল ২০২২ সালেই ১৯৪ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। এটাই নতুন ভারত, মোদি- ফাইড ভারত। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মুক্তচিন্তার বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়ার নিদারুণ কাহিনি।

তবে প্রেস মিডিয়ার উপর এই আক্রমণ আসলে বিজেপি-আরএসএস’র সামগ্রিক প্রয়াসেরই প্রতিচ্ছবি। একদিকে তারা লিখতে চায় হিন্দু রাষ্ট্রের খোয়াবনামা। পাশাপাশি ফান্ডিং নিশ্চিত করতে সমগ্র রাষ্ট্রশক্তিকে সমর্পণ করাতে চায় করপোরেটের পায়ের কাছে। সেই বাতাবরণ সৃষ্টিতে ন্যূনতম সুযোগ হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়। ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইকনমি অফ দ্য মাস মিডিয়া’র সূত্র মেনেই তাই সংবাদমাধ্যমকে তাদের পরিণত করতে হবে ফেক নিউজের আখড়ায়। উত্তর-সত্যর হাত ধরেই তাদের পক্ষে জনমত গড়বে মিডিয়া। এই প্রয়াস আসলে গণতন্ত্রের সার্বিক সলিল সমাধির অভিপ্রায়েরই অংশ। গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা সমাহিত হলেই মানুষকে বোঝানো যাবে খাদ্য, শিক্ষা, চাকরির আগেও প্রয়োজন সংখ্যালঘুদের শায়েস্তা করা। তাই সিএজি রিপোর্টে বিজেপি সরকারের মদতে সাড়ে সাত লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি ফাঁস করে দেওয়া অফিসারদের বদলি আর নিউজক্লিকের উপর আক্রমণ এক সরলরেখায় আসীন। আইন বদলে নির্বাচন কমিশন দখলের প্রয়াস আর প্রবীর পুরকায়স্থর জেল যাত্রার মাস্টারমাইন্ড আলাদা নয়। অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি আর সাংবাদিকদের হেনস্তা একই পরিকল্পনার অংশ। পাঠ্যপুস্তক বদলে মগজ দখল আর সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ জারি করে জবরদখল একই মেশিনারির প্রোডাক্ট।

বিজেপি পরিচালিত,আরএসএস নিয়ন্ত্রিত সরকারের এক নগ্ন উইচ হান্টিংয়ের শিকার নিউজক্লিক। প্রসঙ্গত, নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই রিপোর্টের পরই মার্কিন সেনেটর মার্কো রুবিও অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডকে চিঠি লেখেন আমেরিকার যুদ্ধবিরোধী বামপন্থী দলের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য। সেই মার্কিন সেনেট যেখানে ৫০-এর দশকে নৌবাহিনী থেকে এসে ‘রক্তচোষা কমিউনিস্ট’ ভ্রান্ত প্রচারের মাধ্যমে মার্কিন মুলুকে রাজনীতির ডাইনামিক্স বদলে দিয়েছিলেন জোসেফ ম্যাককার্থি। সেই ম্যাককার্থিজমেরই নিখুঁত প্রয়োগ নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাতায়। তারই অব্যর্থ প্রয়োগ ভারতের মাটিতে নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে। ১৯২৪ সালে জিনোভিভের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনে ছড়িয়ে পরে ‘রেড স্কোয়ার’ তত্ত্ব। পরাজিত হয় রামসে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বাধীন প্রথম শ্রমিক সরকার। নভেম্বরের বাতাসে আজও পুঁজিবাদ কমিউনিজমের ভূত দেখে। সেই ‘রেড স্কোয়ার’ বিশ্বায়িত হয়ে ব্রিটেন আমেরিকা হয়ে ছড়িয়ে পরে ভারতে। তাই মোহন ভাগবতরা ডাক দেন দেশে কমিউনিস্ট ইকোসিস্টেম ধংসের জন্য। যা কিছু মানুষের হক তাই বামপন্থীদের লড়াইয়ে পাথেয়। তাই মানুষের কথা বলা মানে দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরাগভাজন হওয়া। নিউজক্লিকের উপর আঘাত তাই আমাদের কাছে সাইরেন সংকেত। জীবনের গানে ওরা ভয় পায়। আমাদের চেঁচিয়ে বলতে হবে জীবনের কথা, শাসকের বুকে ত্রাস সৃষ্টি করেই।