E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রয়োজন জাতিভিত্তিক জনগণনা


কনভেনশনে বক্তব্য রাখছেন রামচন্দ্র ডোম। মঞ্চে রয়েছেন বিকাশ ভট্টাচার্য, অলকেশ দাস প্রমুখ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশের মানুষের মধ্যে কারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত তা চিহ্নিত করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই চাই জাতিভিত্তিক জনগণনা। এই গণনা কেবলমাত্র সংরক্ষণের সম্প্রসারণের জন্যও নয়, আর সংরক্ষণ মানে শুধু দারিদ্র্য দূরীকরণ নয়, কয়েক হাজার বছর ধরে চলতে থাকা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের নামে ঐতিহাসিক অবিচারের প্রতিবিধান। ১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে আয়োজিত এক কনভেনশনে এই আহ্বান জানানো হয়। এই কনভেনশনের সূচনা করেন পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের সভাপতি অধ্যাপক বাসুদেব বর্মণ। এদিনের রাজ্য কনভেনশনে মঞ্চের পক্ষে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবিতে মূল প্রস্তাব পেশ করেন মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক প্রাক্তন সাংসদ অলকেশ দাস। এদিনের কনভেনশনে প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন সাংসদ রামচন্দ্র ডোম, বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রাক্তন বিধায়ক সুখবিলাস বর্মণ, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, ঐকতান পত্রিকার সম্পাদক নীতীশ বিশ্বাস প্রমুখ।

দলিত শোষণ মুক্তি মঞ্চের সম্পাদক রামচন্দ্র ডোম প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে কনভেনশনে বলেন, বাবাসাহেব আম্বেদকর দেশে বর্ণবাদভিত্তিক জাতিবাদী সমাজব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার কথা বলেছিলেন, যা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অন্যতম ভিত্তি। তার জন্য সংবিধানে বিধিবদ্ধ নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থার বদল আপনা থেকে হয় না। কারণ তা করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শাসকদের নেই। এখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জাতিগত বৈষম্য হাত ধরাধরি করে চলে।

তিনি বলেন, বর্ণবাদী ব্যবস্থার মূল পৃষ্ঠপোষক এই বিজেপি-আরএসএস যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে-থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রকৃত সংখ্যায়ন সামনে আসুক তা চায় না। এ কথা ঠিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে পিছিয়ে-পড়া অংশের ক্ষেত্রে কয়েক কদম এগোনো গেছে, কিন্তু বৈষম্য উচ্ছেদ হয়নি। কেন্দ্র বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ করে সংরক্ষণ প্রথাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। শ্লেষের সুরে তিনি বলেন, সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দিলে সংরক্ষণের কী দরকার!

কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, সাংবিধানিক অধিকারকে, তার মূলসূত্রগুলিকে অস্বীকার করছে বর্তমান বিজেপি-আরএসএস’র সরকার। এই সরকার ধর্মভিত্তিক লোকগণনার কথা বলে। জনগণনাকে ব্যবহার করে এনপিআর এবং এনআরসি কার্যকর করার চেষ্টা চলবে না। যদি ধর্মভিত্তিক লোকগণনা বিভেদ উসকে না দেয় তাহলে জাতিগত লোকগণনায় আপত্তি কিসের?

এদিনের রাজ্য কনভেনশনে জাতিভিত্তিক জনগণনাকে কার্যকরি করার প্রস্তাব পেশ করে পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের সম্পাদক অলকেশ দাস বলেন, জাতিভিত্তিক জনগণনার মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে সম্পদের সামাজিক অধিকার কোন অংশের হাতে কতটা রয়েছে, কারা কোথায় দাঁড়িয়ে। আম্বেদকর যা বলে গিয়েছিলেন তাঁর পরিপূর্ণ প্রয়োগ হলে পরবর্তীতে আর সংরক্ষণের প্রয়োজন হতো না। তা করা হয়নি। তাই বঞ্চনা, অস্পৃশ্যতা, সামাজিক নিপীড়ন থেকে গেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ২০১১ সালের সোশিও-ইকনোমিক কাস্ট সেনসাস রিপোর্ট প্রকাশ করলো না। করল স্পষ্টভাবে জানা যেত পিছিয়ে-পড়া অংশের মানুষ সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সংরক্ষণের ফলে কোথায় অবস্থান করছেন। তাদের কোনো উন্নয়ন হয়েছে কিনা। সংরক্ষণ কোনো সমাধান নয়, ভূমি সংস্কার যদি না হয়, মানুষের হাতে জমি যদি না যায়, অর্থনৈতিক কেন্দ্রীভূত চিত্র যদি ভাঙা না যায়।

তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে মণ্ডল কমিশন যে দুটি জনগণনার তথ্যের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে ওবিসি জনসংখ্যা নির্ধারণ করেছিল তার একটি ব্রিটিশের করা ১৯৩১ সালে এবং আরেকটি ১৯৭১-এর, দুটোই পুরনো তথ্য। তারপর তিন দশক কেটে গেছে তাই পর্যালোচনা প্রয়োজন স্পষ্টতা প্রয়োজন। এটা মানুষের অধিকারের প্রশ্ন। তিনি বলেন, দেশের উচ্চবর্ণের মানুষ যারা, সেই ৪০ শতাংশের হাতে বেশিরভাগ সম্পদ পুঞ্জিভূত। জাতিভিত্তিক জনগণনার তথ্য সামনে এলে পরিষ্কার হবে ‘ক্রিমি লেয়ার’ বা পুষ্ট অংশের পরিসংখ্যানও। রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে মাহিষ্যদের সংরক্ষণ দেবার কথা ঘোষণা করলেন কিসের ভিত্তিতে। ভোটের জন্য রাজ্য সরকারকে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বলতে হবে, প্রকৃত অবস্থাটা কী।

কনভেনশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতিভিত্তিক জনগণনার ক্ষেত্রে এক বড়ো বিপরীতার্থক প্রচার হচ্ছে তা জাতপাতের বিভাজনে উৎসাহ দেবে। এই প্রচারের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা, তারা নকল ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে অন্য ধর্মকে পায়ের তলায় পিষছে। এদের বোঝানোর দরকার জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি এই কারণে যে, তার মধ্য দিয়ে কোন সামাজিক গোষ্ঠী (সোশ্যাল গ্রুপ) সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত তা চিহ্নিত করা। অর্থনৈতিক সামাজিক ও শিক্ষাগত সমীক্ষার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর সামাজিক সম্পর্ক খতিয়ে দেখা। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রস্তাবে জাতিভিত্তিক সোশিও ইকনমিক কাস্ট সেন্সাস আর্থসামাজিক জাতিভিত্তিক জনগণনা ২০১১-র রিপোর্ট প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সমাজে বহমান এক ভয়ঙ্কর বৈষম্যের চিত্র পরিস্ফুটিত হবে। সমাজের তথাকথিত উচ্চজাতির শিরোপা পাওয়া মানুষের সংখ্যা, সরকারি বা বেসরকারি কাজ ও শিক্ষায় এত ব্যাপকতর যে এই দখলদারির চিত্র আমাদের ভাবনার বাইরে যা আমাদের বিস্মিত করবে।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, অনেকের আশঙ্কা জাতিভিত্তিক জনগণনা হলে সংরক্ষণের শতাংশ বাড়বে। তাদের বোঝা উচিত জাতিভিত্তিক জনগণনা কেবলমাত্র ওবিসি’র সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য নয় বা সংরক্ষণের সম্প্রসারণের জন্যও নয়। আর সংরক্ষণ মানে শুধু দারিদ্র্য দূরীকরণ নয় কয়েক হাজার বছর ধরে চলতে থাকা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের নামে ঐতিহাসিক অবিচারের প্রতিবিধান। শুধু কনভেনশনে এই দাবি সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রস্তাবে অসংখ্য মানুষকে নিয়ে বহুমুখী আন্দোলনের ডাক দিয়ে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক অবিচারকে চিরস্থায়ী করে রাখতে চায় কেউ তার ভোটব্যাঙ্ককে পুষ্ট করার জন্য - এই দুই প্রবণতাই ক্ষতিকর। চাই নির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতে সংরক্ষণের পূর্ণ প্রয়োগ। তা যতক্ষণ না হবে ততক্ষণ পশ্চাৎপদকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সকলকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল ন্যায় এবং রাজনৈতিক সুযোগের বিষয়ে। তার মূল লক্ষ্য ছিল - শিক্ষা, ক্ষমতায় তার অবস্থান এবং সরকারি চাকরিতে জনগণের ন্যায্য অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্ব। তার প্রতিবিধানের জন্যই জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রয়োজন। ভারতীয় সমাজে মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য, অধীনতার অন্যতম উপাদান ধর্ম এবং জাতি। ধর্মের ভিত্তিতে জনগণনা প্রচলিত। জাতির ভিত্তিতে জনগণনা কার্যকরি করার দাবি এই কনভেনশন জানাচ্ছে।

কনভেনশনে সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, লড়াইটা আদর্শগত, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এটা যদি আমরা বুঝে না থাকি তাহলে আমরা জীবনে কিছু পাবেনা। ব্রাহ্মণ্যবাদে যারা বিশ্বাস করেন তারা মনে করেন ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যদের কোনো মানবিক অধিকার নেই। ব্রাহ্মণ্যবাদ পূজা এবং এই ধরনের প্রতীক জাতিপ্রথা এবং বর্ণবিভেদের মতো বিষয়গুলি বিস্তার করার জন্য ব্যবহার করে। অমিত শাহ একজন আদিবাসী মানুষের ঘরে খেতে গেলে তার প্রচার হচ্ছে বিজ্ঞাপন হচ্ছে, এটা তুলে ধরা হচ্ছে মহান কাজ হিসেবে যে একজন উচ্চবর্ণের মানুষ তথাকথিত নিচু জাতির মানুষের বাড়িতে যাচ্ছেন। এই কথাগুলো অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলছি। রবীন্দ্রনাথ এর বিরোধিতা করেছেন, বলেছেন মন্দিরে দেবতা নেই দেবতা চাষী যেখানে চাষ করে, মজুর যেখানে শ্রম করে সেখানে রয়েছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কীভাবে একজন রাজনৈতিক নেতা বলতে পারেন, মেয়েরা ঘরে ফিরে যাও। তোমরা আঁতুড় আর হেঁসেল সামলাবে!

রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পুরোহিত ভাতার মতো বিষয়গুলি ব্যবহার করে গত ১০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থকরাই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শাসন করছেন এটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি না।

বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষের উন্নতি সাধন করা কিন্তু ভারতে বিজেপি শাসনে তা হচ্ছে না। সংবিধান রক্ষার্থে বর্ণবিদ্বেষ নয়, সমঅধিকারের লড়াই করতে হবে। বিশ্বাসের মধ্যেও এটা আনতে হবে।