৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮
২৭ সেপ্টেম্বর কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট
সঞ্জয় পূততুণ্ড
কৃষক ধর্মঘটের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ কৃষকরা।
সঙ্কট জর্জরিত কৃষি এবং অসহায় কৃষকের মৃত্যু পরোয়ানা প্রতিহত করতে দেশে কৃষক সংগ্রাম ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। শাসকদের ছলনা, অপপ্রচার, এমনকি প্রত্যক্ষ আক্রমণও সংগ্রামকে দুর্বল করতে পারেনি। বরং শ্রমিকশ্রেণিসহ নানা অংশের মানুষের সক্রিয় সহায়তায় যথেষ্ট ব্যাপ্তি লাভ করেছে। কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিল, ফসলের সহায়কমূল্য সহ অন্যান্য দাবিতে দিল্লির চারপাশে গত নয় মাস ধরে যে কৃষকরা অবস্থান করছেন, তাদের সংগ্রামের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব। পাঁচটি বামপন্থী দল তাদের সক্রিয় সমর্থন ঘোষণা করেছে।
হঠাৎ করে বিগত ২৬ নভেম্বর কৃষকরা বিভিন্ন রাজ্য থেকে দিল্লির সীমান্তে আস্তানা গাড়েনি - মজা করার জন্যও তারা এখানে বসে নেই। প্রচার আছে; উন্নত পরিচালন দক্ষতা, আধুনিক কৃষির প্রচলন কৃষিকে উন্নত করে। কৃষক আন্দোলনের কাজ কৃষকের উপর শোষণ পীড়নকে প্রতিহত করা। শোষকদের স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান শাসকদের লক্ষ্য সমগ্র কৃষি জমির মালিকানা অল্প সংখ্যকের কাছে কেন্দ্রীভূত করা। তাই দেখা যায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশে জমির মালিক মাত্র ৫-৭ শতাংশ। আমেরিকাতে এ সংখ্যা শতকরা ২ থেকে কিছু বেশি। ওই সমস্ত দেশের আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা চালু হবার সময় ৭০ শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল, যেমন স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশে ছিল। আজও ভারতের ৫০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
স্বাধীন ভারত কৃষির বিকাশে কিছুটা উদ্যোগী হলেও ’৮০-র দশক থেকে হাত গুটিয়ে নেয় এবং কৃষিসঙ্কট পরিপক্ক হতে থাকে। নয়াউদারনীতির যুগে প্রাকৃতিক সম্পদ-জমি-জঙ্গলে দখলদারি করতে থাবা বসিয়েছে। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই প্রবল প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে ’১৩ সালে আলোচনার ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন করা হয়। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই বিজেপি সরকার ওই আইন বাতিল করে নতুন অর্ডিন্যান্স চালু করে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি - শেষ পর্যন্ত আইন প্রত্যাহৃত। প্রবল আন্দোলনের চাপে পিছু হটতে হয়।
মুজফফ্রপুরে কৃষক পঞ্চায়েতের একাংশ।
করোনায় দেশবাসীর সর্বনাশ হলেও শাসক-শোষকদের কাছে তা পৌষ-পার্বনের মরসুম। সরকারের দায়িত্ব ছিল মানুষকে বাঁচাবার উদ্যোগ গ্রহণ। এদের কাছে সে প্রত্যাশা করা যায়না। করোনার তীব্রতার পর্যায়ে ২০২০ সালের ৫ জুন মন্ত্রীসভায় সিদ্ধান্ত করে নতুন অর্ডিন্যান্স জারি হয়। পরে সমস্ত রীতি-পদ্ধতি জলাঞ্জলি দিয়ে ৩টি কৃষি আইন পাশ করান হয়। আইনগুলি নাকি কৃষকের মুক্তি আনবে। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে কৃষিজমি মুষ্টিমেয়দের করায়ত্ত করা সম্ভব হয়। আমাদের দেশে এ অপকর্মটি অতি দ্রুত সেরে ফেলতে চাইছে বেপরোয়াভাবে।
কৃষি জমির সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীভবন হয়েছে আমেরিকায়। তাদের পরিস্থিতি বেশ সঙ্কটজনক। আধুনিক কৃষি চালু হবার সময় কৃষিতে নির্ভরশীল জনসংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশ, যা আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরে ছিল। সেখানে আজ মাত্র দুই শতাংশের কিছু বেশি মানুষের হাতে সমগ্র কৃষি জমি। ১০০ শতাংশ যন্ত্রপাতি, ৮০ শতাংশ সার, খুচরো ব্যবসা মাত্র ৪টি বৃহৎ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। সরকারি ভরতুকি বা কৃষিবিমার টাকা এদের পকেটেই যায়। কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাণীপালন ক্ষেত্রে যারা যুক্ত, তাদের ৭০ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে। ’৮০ সাল থেকে দেউলিয়া বা আত্মহত্যার সংখ্যা কৃষকদের মধ্যে ৪/৫ গুণ বেশি, জাতীয় গড়ের তুলনায়। গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্কটের কারণে বছরে গ্রামে ১,০০০ স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে - গ্রামে জনসংখ্যাও কমছে।
এরপরেই শয়তানদের হাত প্রসারিত হয় দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। ভারতে উদ্যোগী হয় এই শতাব্দীর প্রথমেই। ’০৭-০৮ সালে ১২ মাসে ১৩টি বৈঠক হয়। দিল্লি-মুম্বাই, ওয়াশিংটন-নিউ ইয়র্কে দু’দেশের কর্তাদের মধ্যে, দেশের মানুষ জানে আলোচ্য বিষয় ছিল পরমাণু চুক্তি। বাস্তবে তা নয়। একটি মাত্র বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশের সরকারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮টি কৃষি গবেষণাগারে বীজ সম্পর্কিত গবেষণার দায়িত্ব পাবে মনস্যান্টো কোম্পানি। তৈরি বীজের কর্তৃত্বও থাকবে তাদের। ফলে সরকারি উন্নত বীজ যেমন সস্তায় কৃষক পেত, সে সুযোগ আর থাকল না। উচ্চ মূল্য দিয়েই এসব বীজ কৃষককে কিনতে হবে। এমনি করে কৃষির প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ কিনতে এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রয়ে বিপুল লোকসানই কৃষি সঙ্কট তৈরি করেছে। সঙ্কটের মাধ্যমে কৃষককে জমিহারা করাই লক্ষ্য।
আত্মহত্যা নয়, বাঁচার লড়াইতে কৃষক। অপপ্রচার, হুমকি ও হামলা করে কৃষি আন্দোলন স্তব্ধ করা যায়নি। লড়াইয়ে যেমন নানা মতের সংগঠন যুক্ত, তেমনই সমাজের বিভিন্ন অংশের সহায়তা রয়েছে আন্দোলনের সাথে। বিপুল সংখ্যক কৃষক রমনী সংসার ছেড়ে রাজপথে।
বারুইপুরে কৃষক ধর্মঘটের সমর্থনে কনভেনশন।
২৮ আগস্ট হরিয়ানার সচিবালয় ঘেরাও করে হাজার হাজার কৃষক। সরকারের নির্মম আক্রমণে একজন শহিদ হন। কিন্তু আন্দোলন চলতে থাকে। বাধ্য হয়ে হরিয়ানার বিজেপি সরকারকে পিছু হটতে হয় - দাবিসনদ মেনে চুক্তিবব্ধ হয় সরকার। আবার ৫ সেপ্টেম্বর অভূতপূর্ব নজির গড়েছে মুজফ্ফর নগর। এক দশক আগে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তস্রোত বয়েছিল। সেই মুজফ্ফর নগরকে ভাসিয়ে দিল হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ জনস্রোত। বাংলার কৃষকরাও এই মিলনতীর্থের সাক্ষী হয়ে রইল।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু বর্তমান সংগ্রামের ফলে কুচক্রী সরকারের সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ। তাদের জোট ভেঙেছে। স্থানীয় নির্বাচনে জনতার রায়ে তারা পরাস্ত।
এমনি করেই কৃষক সংগ্রাম তীব্রতা অর্জন করেছে। দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আরও বড়ো আঘাত হানতে ২৭ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত কিষান মোর্চা ভারত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। পশ্চিম বাংলায় ধর্মঘট কার্যকর করতে রাজ্যস্তরে গণসংগঠনের কনভেনশন হয়ে গেল গত ১০ সেপ্টেম্বর। এরাজ্যেও ধর্মঘটে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে। রাজ্যর শাসকরা কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সুস্পষ্ট অবস্থান তাদের নিতে হবে।