৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮
বর্তমান পরিস্থিতি আর তৃতীয় ঢেউ
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
সামনে উপনির্বাচন। তারপর আসবে একের পর এক উৎসব। তারপর আসবে তৃতীয় ঢেউ। চাই বা না চাই এগুলো পরপর আসবে। তৃতীয় ঢেউ কতটা আক্রমণাত্মক চেহারা নিয়ে কত দ্রুত আসবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে আমাদের উপরে। নির্ভর করছে প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আমাদের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন জীবনে তার প্রয়োগের মাত্রার ওপর, একইসাথে টিকা নিয়ে সরকারের সক্রিয়তার ওপরেও বটে। একথা ঠিক মৃত্যু মিছিল, শ্রদ্ধাহীন গণচিতা, গণকবর, নদীতে ভেসে যাওয়া লাশের দৃশ্য দেখার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে আমাদের অনেকের মনে। পরিচিত কাউকে জিজ্ঞাসা করুন এই অতিমারীতে তিনি কী কাউকে হারিয়েছেন। সকলের উত্তর একই আসবে। কারণ আমরা সকলেই হারিয়েছি আমাদের প্রতিবেশী, পরিবার, পরিজন, সাথী, বন্ধু, স্বজন সহ কোনো না কোনো সহনাগরিককে। যদিও নিজেরা প্রিয়জন হারানোর শোকে কাতর থাকার ফুরসত পাইনি, আতঙ্ক আমাদের নিজেদেরকেই এমন মানসিক জরাগ্রস্ত করে রেখেছিল। এমন অসহায়তাবোধ, আতঙ্ক শরীরে মনে নিয়ে মাসের পর মাস বাঁচা যায়, কোভিড-১৯ না এলে আমরা হয়তো জানতেও পারতাম না আমাদের এত সহ্য ক্ষমতা।
অন্যদিকে, অর্থনীতির জগতে নানান নাটকীয় ঘটনার ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়েছে। দেশের সম্পত্তি বেচে দেবার ধুম পড়েছে দেশজুড়ে। সংসদে সংখ্যার জোর বড়ো জোর। ‘সরকার’ তার নিজের সম্পত্তি দেখলেই বেচে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। মন্দির, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দিয়েই তো পার হয়েছে কয়েকটা নির্বাচন, তাই বোধহয় আত্মবিশ্বাস আকাশ ছুঁয়েছে। বাজারে জিনিসের দাম আগুন, কাজের নিশ্চয়তা নেই, নতুন কাজের সন্ধান নেই, ঘরে ঘরে বেকারদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, চাষির, শ্রমিকের, ছোটো ব্যবসায়ীর, খেটে খাওয়া মানুষের ঘরে ভাতের হাহাকার। তাও তাপ-উত্তাপ নেই দেশের সরকারের। দেশের চাষিরা রাস্তায় মাসের পর মাস - সরকার বোবা-কালা হয়ে আছে।
সরকারের ভরসা কী তবে পেগাসাস, আর রসেবসে থাকা শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীরা? নাকি সরকার ধরেই নিয়েছে যে, "গণমাধ্যম যেহেতু একচেটিয়া কর্পোরেটের করায়ত্ত", তাই তাদের ব্যবহার করে মানুষকে বারবার বোকা বানানো যাবে, মানুষ কি নিয়ে ভেবে দিনযাপন করবে সেটাও ঠিক করে দেওয়া যাবে অতীতের মতো বারবার। মানুষকে সক্রিয় দেখলেই অতীতের মতো তাদেরকে বার্তা পাঠানো যাবে - “একপাশে সরে দাঁড়ান আপনি। এবং যা চলছে তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিন। বরং অন্য কিছু দেখুন... জনতাকে তখন অবশ্যই তাড়া দিয়ে ফেরত পাঠাতে হবে উদাসীনতা, বাধ্যতা আর নিষ্ক্রিয়তার জগতে...”। (নোয়াম চমস্কি, গণমাধ্যমের চরিত্র, মনফকিরা পৃঃ-২২-২৩) এই যেমন, আফগানিস্তানে সরকার বদল হয়ে গেল - কী হলো, কেন হলো, দিস্তা দিস্তা লেখা শেষ, আরও দিস্তা দিস্তা লেখা চলবে। ‘সত্য’টা সামনে আসতে আসতে হয়তো তার প্রাসঙ্গিকতাই থাকবে না সাধারণের মনে। ইতিহাস কিন্তু আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে বারবার যে, ‘সংবাদ’, ‘সত্য’, ‘সম্মতি’ সবই নির্মিত হয় সরকারের না হয় সরকারের নিয়ন্ত্রিত বা বহুজাতিকদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের প্রচারের কৌশলে। মিথ্যার সওদাগররা জানে যে, মিথ্যা থেকে সত্যে পৌঁছনোর পথটা বড়ো দীর্ঘ। তাই তারা নানা সময়ে নানা ছল-চাতুরি, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মানুষের ঐক্যকে বিপথে পরিচালিত করে।
প্রথম দুটো ঢেউয়ের সময়ে, যে দেশে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে বা সরকার পাঠিয়ে দিয়েছে, সেই দেশ অতিমারী পরিস্থিতিতে খুবই অসহায় অবস্থায় পড়েছে। কারণ বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুনাফায় আছে, কিন্তু রোগ-মহামারী প্রতিরোধের মতো অলাভজনক কাজে নেই। তাই আমেরিকা সহ তথাকথিত উন্নত দেশগুলি ভাইরাস প্রতিরোধে কাহিল হয়ে পড়েছে। ঘাড়ের কাছে কোভিড-১৯-এর তৃতীয় ঢেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। এই অবস্থায় দেশকে যদি বাঁচাতে হয় তবে রাজ্যে রাজ্যে ও দেশে সমন্বয়ের কাজে, আর্থিক সংস্থানের প্রশ্নে প্রধান নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে। এই ভূমিকা সদর্থকভাবে পালন করতে গেলে সর্বদলীয় সভা নিয়মিতভাবে করতে হবে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে শিরোধার্য করে এগোতে হবে। দায়িত্ববান ভূমিকা নিতে হবে মিডিয়াকেও, সাধারণ মানুষকেও। প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা ষোল আনা কাজে লাগাতে হবে। শরীর আর মন দু’টোকেই শিথিল করে এমন সামান্যতম কোনো ফাঁক রাখা চলবে না। প্রায় সব মানুষ নিজেদের ঘরবন্দি রেখেছেন মাসের পর মাস। ঘরবন্দি থাকাটা ছেলেখেলা নয়। এর জন্য দরকার প্রবল মনোবল, ধৈর্য ও অচেনা পরিস্থিতি সামলে এগিয়ে চলার দক্ষতা। মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকা, আর্থিক ও অন্যান্য অনিশ্চয়তার স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মানসিক ডাক্তারের চেম্বারে ভিড় উপচে পড়ছে, জ্যোতিষীর চেম্বারেও পা ফেলার জায়গা নেই, শনি মন্দিরেও মহিলাদের ভিড়, খোল-করতাল নিয়ে কীর্তনের আওয়াজের সাথে উদবাহু নৃত্য বেড়েই চলেছে, মন্দিরে-মসজিদে লোক থিকথিক করছে, সরকার বিরোধী মিছিলে, মিটিংয়েও মানুষে মানুষে ছয়লাপ। এই ঘটনাগুলো কিসের ইঙ্গিতবাহী? আমার মতে, “মানুষ বড়ো কাঁদছে, মানুষ বড়ো অসহায়”। অথচ সরকার যেন ঠিক করেই রেখেছে “আমরা শুধু তাদের জন্যই কাজ করব, আসল ক্ষমতা যাদের হাতে আছে, অর্থাৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর” (তদেব, পৃ-১০)।
এখন দরকার -
(১) ন্যায্য মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের নিশ্চয়তা,
(২) দেশের মধ্যে সংহতি,
(৩) বিশ্ব সংহতি,
(৪) হাতে হাত মেলানোর আন্তরিক উদ্যোগ,
(৫) যৌথ উদ্যোগে গবেষণা,
(৬) টিকাকে দেশি-বিদেশি বহুজাতিক ব্যবসায়িক সংস্থার নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা।
সরকারকে মানুষকে, বিরোধী দলগুলোকে পাশে নিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে, প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে খাদ্য নিয়ে, অর্থ নিয়ে আর সর্বোপরি টিকা নিয়ে। মানুষ মাসের পর মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সব যুদ্ধকে সমন্বয় করে সৃজনশীলতার সাথে সঠিক গতিপথে নিয়ে যেতে হবে সব কল্যাণকামী রাষ্ট্রকেই। মানুষে মানুষে, দেশে দেশে লড়িয়ে দেওয়ার চালাকি মানবসভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই রোগ সীমানা মেনে চলার রোগ নয়। একে কুর্নিশ না করলে অন্ধ গলি থেকে রাজপথ ও কাউকে মানবে না।