৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮
রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের বাস্তব চিত্রটা কী?
ইন্দ্রজিৎ ঘোষ
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন রাজ্যে তৃণমূল আবার ক্ষমতায় এলে বিপুল পরিমাণ শিক্ষক নিয়োগ হবে। বলেন ডবল শিক্ষক নিয়োগ হবে।
নির্বাচনের পর জুন মাসে উনি এমন ভাবে প্রেস কনফারেন্স করলেন যেন প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ করবেন।
কিন্তু বাস্তবের মাটিতে আমরা কি দেখলাম -
অ্যাডভোকেট জেনারেল মাননীয় কিশোর দত্ত পদত্যাগ করলেন। এবং তার সাথে বর্তমান রাজ্য সরকারের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চরম দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে। মহামান্য হাইকোর্ট বেশ কিছু ক্ষেত্রে এমন রায়দান করেছেন তাতে সহজে অনুমান করা যায় বর্তমান সরকার শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কী চরম অন্যায় করেছে।
এই এমন একটি রায়ের পর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বেজায় ক্ষুব্ধ।
সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে বলেন কেন বারবার মামলা হচ্ছে?
রাজ্য সরকার নাকি চাকরি দেবে বলে বসে আছে আর কেউ কেউ মামলা করে আটকে দিচ্ছেন। কিছু কোর্টবাবু হয়েছেন। এরা কি সমাজের বন্ধু?
তার আগে একটু জানাবো প্রাইমারিতে কবে কী পরীক্ষা হয়েছিল, আর কবে কী নিয়োগ হয়েছিল।
আমাদের রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ প্রথম প্রাইমারি টেট পরীক্ষা হয়। ব্যাপক গণ্ডগোলে প্রায় ৪০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারেনি। তারপর ২০১৪ সালে নিয়োগ হয়।
এরপর ২০১৪ সালে নোটিফিকেশন করে। ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর পরীক্ষা হয়।
পরীক্ষার পরই কয়েকজন টেটের প্রশ্ন ভুল ছিল বলে মামলা করে। এটাই প্রশ্ন ভুল মামলা।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, রেজাল্ট প্রকাশ হয়। এরপর আবার আবেদন করার নোটিফিকেশন করা হয়। তারপর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ হয়।
তখন ব্যাপক অনিয়ম হয়। লিস্ট নেই, এসএমএস করে চাকরি হয়, অনেক যোগ্য প্রার্থী মামলা করে, তাদের অভিযোগ ছিলো, এমন অনেকে চাকরি পেয়েছে তারা টেট পাস নয়। কম নাম্বারে নিয়োগ হয়েছে কিন্তু বেশি নম্বর পেয়েও তারা পায়নি...
এরপর ২০১৭ সালে আবার নোটিফিকেশন করা হয়।
পরীক্ষা নেওয়া হয় ৩১ জানুয়ারি ২০২১। এখনো সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়নি।
২০২০ সালে নভেম্বর মাসে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন ১৬,৫০০ জনকে নিয়োগ করা হবে। যারা নাকি ২০১৫ সালে পরীক্ষা দিয়ে ২০১৬-তে পাস করেছিল কিন্তু ২০১৭ সালে নিয়োগ পায়নি। রেসিডিউ অংশ।
সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবং ব্যাপক গণ্ডগোল হয়েছে লিস্টে। প্রচুর মামলা হয়েছে।
আর একটা কেস আছে ২০০৯ সালের। তখন জেলাভিত্তিতে নিয়োগের নোটিফিকেশন হতো। পরীক্ষাও হতো। সব জেলার পরীক্ষার পর নিয়োগ হলেও উত্তর ২৪ পরগনা, মালদা, আর দক্ষিণ ২৪ পরগনাতে তৃণমূল ইচ্ছা করে মামলা করে নিয়োগ আটকে রেখেছিল। কোর্টে দীর্ঘ বিচার চলার পর কোর্ট রায় দেয় যে, সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল। এই সরকার তারপরেও সেই যোগ্যপ্রার্থীদের নিয়োগ দিচ্ছে না। তাই আবার আদালত অবমাননার দায়ে মামলা হয়েছে।
সংক্ষেপে কবে পরীক্ষা ও কী কারণে মামলা উল্লেখ করলাম।
আমরা অন্য শিক্ষক নিয়োগের মামলা ছেড়ে দিলাম কেবল প্রাইমারিতে শিক্ষক নিয়োগের মামলায় কী কী রায় এসেছে একটু দেখি...
২৭ আগস্ট, ২০২১
প্রাইমারি টেট পাস না করে চাকরি করছে ১২ জন।
প্রাইমারি টেট ২০১৪, বিজ্ঞপ্তি। পরীক্ষা গ্রহণ ৯ অক্টোবর ২০১৫। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ টেট ফল প্রকাশ। ফ্রেব্রুয়ারি ২০১৭ নিয়োগ। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এই ১২ জনের টেট পাশ করার কোনও প্রমাণ নেই।
নথি যাচাইয়ের কাজও সঠিকভাবে হয়নি। অথচ বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁরা চাকরি করছেন! এক-দু’জন নন, এক এক করে উঠে এসেছে এমন ১২ জনের নাম। যা দেখে স্তম্ভিত বিচারপতি! ক্ষোভে নিজেই মামলা থেকে অব্যাহতি নিলেন। পাশাপাশি ওই বিচারপতি বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির এজলাসে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিলেন। এমনটাই হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গেল বেঞ্চে।
৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১
প্রাইমারি টেট-২০১৪, প্রশ্ন ভুল মামলায় হাইকোর্টের রায়ঃ
প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি তৃণমূলের বিধায়ক মনি ভট্টাচার্য মহাশয়কে জরিমানার নির্দেশ।
মামলাকারীদের হেনস্তার অভিযোগে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার নির্দেশ। মামলাকারীদের দিতে হবে ৬ নম্বর। পাস করলে ইন্টারভিউ-এর সুযোগ দিতে হবে।
৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১
প্রাইমারি টেট- ২০১৪, প্রশ্ন ভুল মামলা হাইকোর্টের রায়ঃ
আদালত অবমাননার প্রক্রিয়া শুরু হাইকোর্টের। আগের নির্দেশ কার্যকর করতে ৩ সপ্তাহের সুযোগ পর্ষদ সভাপতিকে।
৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১
প্রাইমারি টেট-২০১৪, প্রাথমিক টেট-এ নথি ছাড়াই ১২ জন নিযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগে জনস্বার্থ মামলা। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সমস্ত নিযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষকের বিশদ তালিকা হাইকোর্টে পেশ করতে নির্দেশ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১
প্রাইমারি টেট-২০১৪, প্রশ্ন ভুল কনটেম্প মামলায় হাইকোর্টের রায়ঃ ১৩ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ১১ টায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সভাপতিকে সশরীরে তলব হাইকোর্টের।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১
প্রাইমারি টেট-২০১৪, প্রশ্ন ভুল কনটেম্প মামলায় হাইকোর্টে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য সশরীরে হাজিরা দেন এবং নিজ মুখে অবমাননার ভুল স্বীকার করেন। মুচলেকা দিতে হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১
প্রাথমিক টেট-২০১৪, প্রশ্নভুল মামলায় ১৭৫ জন পিটিশনার সুবিচার পেলেন আজ হাইকোর্টের রায়দানে। তিন সপ্তাহের মধ্যেই নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে।
বারবার এই চুরি যারা করছেন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যাবস্থা নিয়েছে? নাকি তারা আপনার মদতেই এই সব করে? এরা কারা, সমাজের বন্ধু না শত্রু?
কেন তৃণমূলের বিধায়ক প্রাইমারি শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান হবেন?
এই দুর্নীতির সাথে যারা যারা যুক্ত তাদের কি শাস্তি হবে? কেন তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হলো না?
কেন স্বচ্ছ তালিকা প্রকাশ না করে এসএমএস করে ইন্টারভিউতে ডাকা হবে?
চুরি করবেন আপনারা আর ফল ভোগ করবে সাধারণ মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা। তা হবে না।
কয়েক হাজার ফ্রেশ প্রার্থীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললো। অসংখ্য যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করল। অনেকের বয়স বেড়ে গেলো। আর পরীক্ষায় বসা সম্ভব নয়। কষ্ট তাদের জন্য।
এই অসভ্য বর্বর সরকার এর জন্য দায়ী।
এদের ন্যায় বিচারের দাবিতে লড়াই করতেই হবে।
এই প্রাইমারি চাকরি প্রার্থীরা ধারাবাহিক লড়াই করছে। কখনো বিকাশ ভবন, কখনো কলকাতার রাস্তায়, প্রাইমারি শিক্ষা সংসদের অফিসের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেছে। তাদের নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য বারবার রাস্তায় নেমেছে।
তৃনমূলের নেতারা আপার প্রাইমারি চাকরির নামে পাড়ায় পাড়ায় টাকা তুলেছেন। অনেকে এখন বিজেপি-তে গেছেন, ছাড় পাবে না কেউ।
২৫ শতাংশ আর ৭৫ শতাংশ ভাগ পাওয়া সবাই।
যতই বলুন ‘‘তুই কে যে হিসাব চাইবি?’’
হিসাব আপনাকে দিতেই হবে।
যা যা করলে যন্ত্রণা কমবে -
বর্তমানে চেয়ারম্যানকে সরিয়ে একজন আইএএস অফিসারকে চেয়ারম্যান করতে হবে। কারণ স্বশাসিত সংস্থা বলে সরকার দাবি করে (পিএসসি’র মতো) প্রসঙ্গত, আইএএস অফিসার পিএসসি’র চেয়ারম্যান হওয়ার পর অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। নিয়মিত পরীক্ষা হচ্ছে। দ্রুত পেন্ডিং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
৩১ অক্টোবরের মধ্যে অনলাইনে ২০১৫ সালের টেট পাস সার্টিফিকেট দিতে হবে।
দুর্নীতির সাথে যুক্ত সবাইকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
২০১৬ সালের পর যাঁরা ডিএলইডি/বিএড করেছেন তারা এখনো পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাননি। চাকরি তো দূরঅস্ত। অবিলম্বে নূতন পরীক্ষা নোটিফিকেশন দিতে হবে।
আগামীতে এই দাবিতে জান কবুল লড়াই হবে।