৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮
আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিরোধের আগুন জ্বলুক দ্বিগুণ
রথীন রায়
পাহাড়ের উপর থেকে একটা ভেড়া নিচে ঝাঁপ দিল। ওই একই জায়গা থেকে একইভাবে পরপর ভেড়াগুলি ঝাঁপ দিতে থাকল। ৫০০ ভেড়াই ঝাঁপ দিল। সবাই মারা গেল। কেন সব ভেড়া প্রথমটার অনুসরণ করল কোনো ভেড়াই জানেনা। প্রথম ভেড়াটাই কেন ঝাঁপ দিল সেও জানতো না। একেই বলে ভেড়ার আচরণ (Sheep’s Behaviour) ভাল বাংলায় গড্ডালিকা প্রবাহ।
পৃথিবীব্যাপী গভীর সঙ্কটগ্রস্ত ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ জনগণের কাছ থেকে এরকম আচরণই আদায় করে নেয়। গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত পুঁজিবাদের পরিত্রাণের কোনো পথ নেই। শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য যত নিচে নামা দরকার নামছে। এতকাল যাবত ইতিহাস থেকে, শ্রমলব্ধজ্ঞান থেকে, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে, শ্রেণিসংগ্রাম থেকে মানুষ উজ্জ্বল দিকগুলি অর্জন করেছিল। চিন্তা করার ক্ষমতা, ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, ব্যক্তি ও সামাজিক মর্যাদা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মানসিকতা, ব্যক্তির দ্বারা ব্যক্তির শোষণের বিরোধিতা করা, যে কোনো জুলুমের বশ্যতা স্বীকার না করার জেদ, যূথ/জোটবদ্ধ হওয়া, সংগঠন গড়ে তোলা এবং গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক কাঠামো - যার মাধ্যমে মানুষের ইচ্ছার মর্যাদা দেওয়া সম্ভব। এ সমস্ত কিছুই পুঁজিবাদের অবদান। পুঁজির বিকাশের যুগের অবদান। পুঁজির বিকাশের যুগ শেষ। এখন শুধু মারণাস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের যুগ। ভয় দেখিয়ে নতজানু করার জন্য মারণাস্ত্র বিকাশ দরকার। পৃথিবীব্যাপী হাজার বছর ধরে যেখানে যত সম্পদ তৈরি হয়েছিল তার সবটুকু চেটেপুটে খাবার জন্য তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ প্রয়োজন। নতুন সম্পদ তৈরি হচ্ছে না। শিল্পপুঁজির অস্তিত্ব নেই। উন্নতমানের দ্রব্য উৎপাদনের কারখানা তৈরি হচ্ছে না। শুধু ‘সার্ভিস সেক্টর’। নিজের কোনো হোটেল নেই, অথচ পৃথিবীর সব থেকে বড়ো হোটেল চেনের মালিক, নিজের কোনো গাড়ি নেই কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ গাড়ি সরবরাহকারী, নিজের কোনো দোকান বা পণ্য নেই অথচ পৃথিবীর সব বড়ো বড়ো পণ্য সরবরাহকারী - আদা থেকে জাহাজ যা চাইবেন। নিজের কোনো ব্যাঙ্ক নেই কিন্তু বিশ্বের বড়ো ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মালিক। নতুন কোনো সম্পদ উৎপাদন নয়, শুধু অতীতের তৈরি সম্পদের হাতবদল। কোটি কোটি শ্রমিকের আর প্রয়োজন শেষ। তারা ভিড় জমাচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জমায়েতে। কাজহীন, স্বপ্নহীন, অন্নহীন, মর্যাদাহীন খুটে খাওয়া মানুষের দলে। বিপরীতে তাবৎ সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে কতিপয় মানুষের হাতে।
একদিকে সম্পদের চূড়ায় অধিষ্ঠিত কিছু গর্বিত মানুষ, যারা নিজেরা কোনো সম্পদ তৈরি না করেই সম্পদশালী - বিপরীতে কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষ, যাদের সংখ্যা প্রতিদিনই স্ফীত হচ্ছে - এই দ্বন্দ্বের অবসান হবে কীভাবে? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে আসতেই দেওয়া যাবে না।
যদি একান্তই প্রশ্নটা কোথাও এসেই যায় তবে বলপ্রয়োগ করা হবে। যেমন ইরাক, লিবিয়া, প্যালেস্তাইন, আফগানিস্তান ইত্যাদি। মার্কিন আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন? ভেঙে গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে দাও। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, আফগানিস্তান প্রত্যেকটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পৃথিবীর কোনো প্রান্ত থেকে কোনো প্রতিবাদ শোনা যায়নি। সবাই ভীত। আমার দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কত ঠুন্কো। ভালো ছেলের মতো মার্কিন তাবেদারি করো, তুমি স্বাধীন থাকবে। অথচ ব্রিটিশরা যখন সুয়েজ ক্যানেল আক্রমণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের এক ধমকে পিছু হটেছিল। সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর শক্তির ভারসাম্য নিশ্চিতভাবে সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে। পৃথিবীতে এখন প্রতিক্রিয়ার দাপাদাপি।
আরও সহজপথ গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যুদ্ধ ধ্বংস মৃত্যু সাধারণভাবে পছন্দ করে না। কোন্ যুদ্ধ কোন্ দিকে বাঁক নেবে বলা যায় না। মানুষের মগজগুলিরই মালিক হয়ে যাও। সকলেরই চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সম্পত্তিবানরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। শ্রেণিসংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ভোঁতা করার জন্য বহুরকম তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে। কখনো বলা হয়েছে প্রান্তিক মানুষ নিয়ে ভাবার কোনো কারণ নেই। মাথায় বেশি করে তেল ঢাললে চুঁইয়ে পা পর্যন্ত যাবে।
ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবিস্তার পুরনো খেলা। সে খেলা চলছেই। বিভেদ সৃষ্টি করো - শাসন করো। যেমন আমাদের দেশে ইংরেজরা করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ইংরেজদের সহায়তা করেছিল, তারাই আজ শাসন ক্ষমতায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজদের সেবাদাস এখন কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাস। দেশের সংবিধানের মৌল বিষয়কে ধ্বংস করে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সম্পদ দেশি-বিদেশি পুঁজির হাতে তুলে দিয়ে বলছে এটার নামই দেশপ্রেম। কৃষকের স্বার্থ জলাঞ্জলি, কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিতে জবরদস্তি আইন পাশ করিয়েছে। কৃষকরা সঙ্গবদ্ধ বিরোধিতা করছে। কর্পোরেট পুঁজির বিরোধিতা হলো দেশদ্রোহ। এরসাথে ধর্মীয় বিভাজনকে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি যেসব দাবি আদায় করেছিল সব বাতিল করা হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে। নির্বাচনের সময় সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীব্র করে ভোটে জিতছে। মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। ধর্মকে ব্যবহার করে সব সময় কার্যসিদ্ধি নাও হতে পারে। আর্থিক দাবিতে তীব্র শ্রেণি সংগ্রাম ধর্মীয় ভেদাভেদ মুছে দিতে পারে। সুতরাং, পরিচয়সত্তার রাজনীতি জরুরি। এই রাজনীতিতে পৃথিবীর অনেক দেশ টুকরো হয়ে গিয়েছে।
মাথায় তেল ঢাললে চুঁইয়ে তোমার পা পর্যন্ত আসার কথাই ছিল, কিন্তু অন্যরা মাঝখান থেকে সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে। সবাই মিলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করলে তোমার লাভ নাই। সুতরাং, ভাষাগত, স্থানগত, আদিবাসীরা তাদের মতো, বাউড়ি, বাগদি, ডোম, মেজ, লেপচা, নেপালি, ভুটিয়া, কোচ, মাহাতো সব পৃথকভাবে দাবির কথা বলো। এইভাবে ছোটো ছোটো বদ্ধ জলায় পরিণত হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্পদবানদের সম্পদ অক্ষত থাকবে শুধু নয়, বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। করোনা পরিস্থিতিতে যখন ছাঁটাই, রেল লাইনে রক্তমাখা রুটি, কাজহীন, গৃহহীন হাজার মাইল হাঁটছে। উৎপাদন নাই কিন্তু কর্পোরেট পুঁজির মুনাফা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। উপর তলার লোকেরা তাদের সেবাদাস। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও গদিমিডিয়া মজা করে দেখছে নিচের তলার লোকেরা নিজেদের মধ্যে কেমন সুন্দর ঝগড়া করছে। গদি মিডিয়ার প্রচারে বিভ্রান্ত কৌম্য সমাজে বিভক্ত মানুষেরা সেই শয়তানদের সমর্থন করছে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন দুর্বল হওয়ার কারণে গড্ডালিকা প্রবাহে কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।
কেন্দ্রে যারা সরকার চালাচ্ছে তারা মানুষের সমর্থন নিয়েই লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। এদের নীতি হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজিকে সেবা করা। তারজন্য কোনো মূল্যবোধেরই তোয়াক্কা করছে না। অতীত থেকে সৃষ্ট সমস্ত সম্পদই বিক্রি করতে দ্বিধান্বিত নয়। সেই কার্টুনটার কথা মনে পড়ে। ফুটপাথে শুয়ে থাকা বালক জিজ্ঞাসা করছে, ‘‘বাবা, ওরা ফুটপাথটাও বেচে দেবে?’’
কেন্দ্রের সরকারের না হয় বেচার মতো সম্পদ আছে। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় যারা, তাদের নীতি কী? একই।
বিক্রি করার মতো সম্পদ কমই আছে। সবটাই ধমক-চমকে হচ্ছে না। দেশে-বিদেশে গবেষণায় স্থির হয়েছে, পপুলিস্ট স্লোগান, পপুলিস্ট অর্থনীতি,পপুলিস্ট প্রশাসন। সবই পপুলিস্ট। পপুলিস্ট স্লোগান - সব শ্রী, কন্যাশ্রী, বেকার শ্রী, চিকিৎসা শ্রী এবং লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদি। পাবলিক খাচ্ছে ভালো। গদি মিডিয়াও সমানতালে সুশ্রী বিতরণ করছে। কোনো প্রাক্তন মন্ত্রী এবং মেয়র অন্য একজন বিবাহিত মহিলার সহিত কেমন দিনাতিপাত করছে তার রসালো বিবরণ। কিংবা কোনো মহিলা এমপি-র সন্তান কত ওজন নিয়ে জমালো তার ধারাবাহিক বিবরণ সবই শ্রীমণ্ডিত। পরিযায়ী শ্রমিকের কথা নাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের কথা নাই, অক্সিজেনের অভাবে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুর কথা নাই, লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় দিনআনা দিন খাওয়া মানুষদের দুর্বিষহ জীবনের কথা নাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গরিব ঘরের ছাত্রদের স্কুলছুটের কথা নাই। ধর্ষকের শাস্তি হয় না। এখন ধর্ষণ স্বাভাবিক ঘটনা। কাটমানি খাওয়া লোকদের শাস্তি হয় না। কোভিড-ভ্যাকসিনের জালিয়াতি চলে নকল আইএএস অফিসারের নেতৃত্বে। টিকার লাইনে পদপিষ্ট হয়ে আহত হওয়া প্রাত্যহিক ঘটনা। স্কুল ফাইনাল ও উচ্চমাধ্যমিকে শতকরা ১০০ জনই পাশ। আগেকার দিনের ঢাকার কুট্টিদের কথা মনে পরে, ‘‘বাবু আস্তে কন ঘোড়ায় হাসব।’’ এ সবই পপুলিস্ট কর্মসূচি। ক্লাবকে টাকা দেওয়া, দুর্গাপূজা কমিটিকে টাকা দেওয়া - সব পপুলিস্ট। দুয়ারে সরকারের নামে প্রশাসনিক কাঠামোটাই গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। গড্ডালিকা প্রবাহের মতো হাজার মানুষের জমায়েত হচ্ছে। এখন নতুনভাবে দারুণ পপুলিস্ট কর্মসূচি চলছে - লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। মহিলারা বাড়ি বসে পাঁচশত করে টাকা পাবে। এই ভাণ্ডারে অর্থ জোগান নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার থেকে আসবে না। বাজার থেকে ধার নেওয়া হচ্ছে। বামফ্রন্টের আমলের দেড় হাজার কোটি ইতিমধ্যে ৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়েছে। এই ঋণ শোধের কার্যত কোনো উপায় নেই। সম্পদ তৈরির নতুন উৎস তৈরি হচ্ছে না। সিঙ্গুরে গাড়ির কারখানা এবং নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা ধ্বংস করা হয়েছে। বামফ্রন্টের সময় লাইন দিয়ে যে সব শিল্প আসার কথা হয়েছিল সব হাতগুটিয়ে নিয়েছে।
এই ধরনের পপুলিস্ট ব্যয় ফুটো পাত্রে জল ঢালার মতো - open end expenditure। এই অর্থ পুনরায় ব্যবহার করার সুযোগ থাকে না। পুঁজি বিশ্ব সঙ্কট, করোনায় দীর্ঘদিনের লকডাউন দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এইসব কর্মসূচি ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে না। কিন্তু নির্বাচনে জেতাতে পারবে। এই পপুলিজমের অর্থ হচ্ছে মানুষকে সুবিধাভোগী করে দাও, কর্মসংস্থান নয় ডোল দাও, নিজের শ্রমে অর্জিত আয় নয়, অন্য কারও অনুগ্রহে জীবনধারণ। আর যাইহোক অনুগ্রহ ভাজনরা প্রতিবাদী হতে পারে না। সুতরাং, প্রতিবাদ নয় অনুগ্রহ পেতে হলে আমার ভজনা করো। একটা জাতির মনন, সংস্কৃতি, মর্যাদাবোধ শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা, বিজ্ঞান মনস্কতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার আবেগ ধ্বংস হচ্ছে। সমষ্টির স্বার্থ নয়, ব্যক্তিস্বার্থই বড়ো। ধান্দার ধনতন্ত্রে ধান্দাবাজিই নীতি। হাত গুটিয়ে বসে থাকা অপরাধ। প্রতিরোধ গড়ে তোলাই আজকের দিনের প্রধান কাজ।
***
হতাশ হবার কোনো কারণ ঘটেনি। পুঁজিবাদের চরম সঙ্কটে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কোনোটাই কার্যকর হচ্ছে না।
বামপন্থীরা আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এত বড়ো দেশে তিনটি রাজ্যে বুর্জোয়া দলগুলির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে সরকারও গড়েছে। একথা ঘোর নিন্দুকেও বলে না যে, ওই সব রাজ্যে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র গড়ার চেষ্টা হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের কথা বলাও হয় না। আসলে এই কাঠামোর মধ্যেই সংবিধান স্বীকৃত উপাদানগুলি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিকে রক্ষার জন্য একটি গণতান্ত্রিক বিকল্প তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। ধান্দার ধনতন্ত্রে সেটুকুও বরদাস্ত হয়নি।
সোভিয়েতের পতন এবং উদারবাদী-অর্থনীতির প্রভাব বিস্তারে বিশ্বে দক্ষিণপন্থার অন্যতম কর্মসূচি হলো বামপন্থাকে অস্তিত্বহীন করা।
ভারতও ব্যতিক্রম নয়। সমস্ত কর্পোরেট পুঁজি, সমস্ত ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদ, কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া, উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থক সমস্ত ধরনের বুর্জোয়া দল উচ্ছিষ্টভোগী একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সকলেরই ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা বামপন্থাকে অস্তিত্বহীন করা।
পৃথিবীতে এক মেরুর বিশ্ব সফল হয়নি, ভারতেও হবে না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণি শোষণ থাকবে আর শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রেণিসংগ্রাম হবে না, বামপন্থা অস্তিত্বহীন হবে - এমন সোনার পাথরবাটি হয় না।
আজকে দেশে দক্ষিণপন্থার দাপট, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাজ্যগুলির স্বাধিকার, সংবিধান নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির নিরপেক্ষতা ও সংবিধানের দায়বদ্ধতা, শিক্ষার গৈরিকীকরণ সঙ্গে বাণিজ্যিকীকরণ, তার সঙ্গে যাবতীয় কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, অর্থনীতির ক্ষেত্রে দ্রুত অধোগতি যা করোনা অতিমারীর আগে থেকে শুরু হয়েছে, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্ব সঙ্কট, অতীতে অর্জিত সাফল্যগুলিকে হেয় করা। ৭০ বৎসর যাবত সম্পদ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির স্বার্থে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, নতুন কোনো শিল্প নাই, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি, এ যাবত অর্জিত শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অভাবী বিক্রি থেকে রক্ষার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের রক্ষা কবচ তুলে তিনটি কালা কানুন জোর করে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে, যার নগ্ন উদ্দেশ্য হলো কৃষি থেকে উৎপন্ন সম্পদ কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দেওয়া, স্বাধীনতার পর বেকারির হার সর্বোচ্চ, প্রতিদিন রান্নার গ্যাসসহ পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ছে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। চিকিৎসার ব্যয় আতঙ্ক জাগায়, করোনা অতিমারীর মোকাবিলায় চূড়ান্ত ব্যর্থ, এমনকি অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হয়, পরিকল্পনাহীন হৃদয়হীন লকডাউন - হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক হাজার মাইল হাঁটছে, অমানবিক দৃশ্য - এরকম অসংখ্য উদাহরণ। তথাপি পার পেয়ে যাচ্ছে বিভেদের রাজনীতির কল্যাণে এবং বুর্জোয়া দলগুলির শ্রেণিস্বার্থে অনৈক্যের জন্য।
ঘোর অমানিশা শেষ কথা বলবে না। প্রতিরোধের মাটি তৈরি হচ্ছে। দিল্লির সীমান্তে মাসের পর মাস কৃষকের বিক্ষোভ চলছে। ভারত বন্ধ হচ্ছে। কাজের দাবিতে যুবকরা পথে, ছাত্রদের প্রতিবাদী জমায়েত বাড়ছে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে, রেড ভলান্টিয়ার্সরা রাত জাগছে।
অন্ধকারে সব আলোর স্ফূলিঙ্গ। একদিন সব মশাল হয়ে জ্বলবেই।
কথায় বলে গরিবের কথা বাসি হলে সত্যি হয়। এই অবস্থা একদিনে হয়নি। বামপন্থীরা বহুদিন সতর্ক করছিল। বিশাল দেশে বামপন্থী শক্তি দুর্বল থাকার জন্য সাধারণ মানুষ তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
বৃহৎ পুঁজির দুই নির্ভরযোগ্য দল কংগ্রেস এবং বিজেপি ভিন্ন অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলিই কর্ণপাত করেনি। আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরের বিরোধিতার ক্ষেত্র খুব কম। উদারবাদী অর্থনীতির সকলেই সমর্থক।
বামপন্থীরা যখন ডাংকেল প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পথে পথে ঘুরছে, কারও কানে জল ঢোকেনি। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার থেকে কাঠামোগত পরিবর্তন মেনে চুক্তি করার সময় বামপন্থীরা বিরোধিতা করেছিল, কেউ গুরুত্ব দেয়নি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল কৃষিতে ভরতুকি তুলে দেওয়া। বামপন্থীরা বিরোধিতা করেছিল। দেশে উদ্বৃত্ত থাকলেও একটা নির্দিষ্ট কৃষিপণ্য বিদেশ থেকে আমদানির শর্ত - একমাত্র বামপন্থীরাই বিরোধিতা করেছিল। কৃষিপণ্যে আগাম বাণিজ্যের বিরোধিতায় কেউ কর্ণপাত করেনি। পেট্রোপণ্যের দাম নির্ধারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার বিরোধিতা বামপন্থীরাই করেছিল। খুচরো বিক্রয়ে বহুজাতিক ও কর্পোরেট হাউসের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার দাবি বামপন্থীরাই তুলেছিল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতা বামপন্থীদের অন্যতম অ্যাজেন্ডা। স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির কথা বামপন্থীরা বলে এসেছে। মার্কিন বিদেশ ও প্রতিরক্ষার নীতির অংশীদার হওয়ায় কোনো লাভ হয়নি। সমস্ত প্রতিবেশীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে আমাদের দেশ।
এভাবে চলতে পারে না। ফ্যাসিস্তসুলভ ক্রিয়াকাণ্ড সঙ্গে পপুলিস্ট কর্মসূচি - সমস্যার সমাধান আনতে পারে না। ঘাসের উপরিভাগ আপাতত চকচক করলেও মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে। এর পরিকাঠামো খাতে ব্যয় করার সামর্থ্য থাকবে না। একটি মাত্র স্ফূলিঙ্গই শুকনো কাণ্ডে দাবানল সৃষ্টি করবে।
ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবিস্তার পুরনো খেলা। সে খেলা চলছেই। বিভেদ সৃষ্টি করো - শাসন করো। যেমন আমাদের দেশে ইংরেজরা করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ইংরেজদের সহায়তা করেছিল, তারাই আজ শাসন ক্ষমতায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজদের সেবাদাস এখন কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাস। দেশের সংবিধানের মৌল বিষয়কে ধ্বংস করে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সম্পদ দেশি-বিদেশি পুঁজির হাতে তুলে দিয়ে বলছে এটার নামই দেশপ্রেম। কৃষকের স্বার্থ জলাঞ্জলি, কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিতে জবরদস্তি আইন পাশ করিয়েছে। কৃষকরা সঙ্গবদ্ধ বিরোধিতা করছে। কর্পোরেট পুঁজির বিরোধিতা হলো দেশদ্রোহ।