E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

গণনাগরিক চেতনাঃ বর্তমান ও ইতিহাস

সায়ন ভট্টাচার্য


একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট দখল করছে উগ্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী (অ্যনার্কিস্টও বলা যায়), কিংবা ২৬৯ দিনের বেশি অহিংস আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাঞ্জাবের চাষিরা, কিংবা চাকরির দাবিতে প্রতিবাদ করলে জেল অথবা বিষের পাত্রে চুমুক দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ পৃথিবী জুড়ে নাগরিক ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের মূল সমস্যা যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সে বিষয় আমাদের ধারণায় আছে।

একটি রাষ্ট্রে যদি সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকে, যদি আধুনিক ও উন্নত সমাজব্যবস্থা থাকে, যদি জাতিগত বিভেদ বা জনগণের মাঝে মতভেদ প্রকট না থাকে, যদি বহিঃশক্তির প্রভাব না থাকে এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলো বহুসংস্থার শাসনে বিশ্বাস ও চর্চা করে তবে সেই রাষ্ট্রে বহুসংস্থার শাসনের উদ্ভব হবে এবং সেটি টিকে থাকবে। আমাদের দেশে বর্তমানে শাসন করছে পুঁজিবাদী কর্পোরেট, যারা প্রতিদিন আরও তীব্রভাবে একটা বিত্তবান শ্রেণির দিকে ঝুঁকে কাজের পসরা তৈরি করছে। অন্যদিকে শিক্ষিত শ্রেণির হাতে কর্মসংস্থান বলতে ‘ডেলিভারি বয়’-এর চাকরি। কোনো বেসরকারি সংস্থা সামাজিক সমস্যাকে আমল না দিয়ে দিব্যি ছাঁটাইয়ের কাজ করে চলে।

কিন্তু ইতিহাস বলে, প্রায় দু’সহস্র বছরের আগে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল যেখানে সকল সদস্য একে অন্যের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে সমান এবং সমষ্টিগতভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ছিল। এই ব্যবস্থা অন্যান্য যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় উৎকৃষ্ট ছিল কারণ - প্রথমত, এই ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে।দ্বিতীয়ত,এই ব্যবস্থা মানবসভ্যতার উন্নয়ন করে। তৃতীয়ত, মানুষের সর্বজনীন ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করার এটাই সবচেয়ে উন্নত পন্থা। গণতন্ত্রের প্রথম রূপান্তরটি ঘটে গণতন্ত্র অথবা প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্রকে দূর করে ক্ষমতার কেন্দ্রে জনগণকে নিয়ে আসার মাধ্যমে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ছিল মূলত ক্ষুদ্র নগরকেন্দ্রিক এবং সরাসরি গণতন্ত্র। দ্বিতীয় রূপান্তরটি ঘটে যেখানে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের হাত ধরে নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র হতে দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বৃহৎ আকারের শাসনযন্ত্রের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য উদ্ভব হয় শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ, যেমন - সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বর্তমানে এই সব সংস্থার সামাজিক ভূমিকা জনগণের কাছে প্রশ্নের মুখে।

প্রাচীন গ্রিসের গণতান্ত্রিক ধারণার ছয়টি মূল উপাদান ছিল -
প্রথমত, নাগরিকগণের মাঝে একরকম ঐক্য থাকবে যেন তারা নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এড়িয়ে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, নাগরিকগণ হবে মানসিকগত, অর্থনৈতিকগতভাবে বৈষম্যহীন।
তৃতীয়ত, গণের আকার ছোটো থাকবে অর্থাৎ গণতন্ত্র হবে নগরকেন্দ্রিক।
চতুর্থত, গণতন্ত্রের ধরন হবে সরাসরি (Direct democracy), অর্থাৎ প্রতিনিধিমূলক (Representative) নয়।
পঞ্চমত, প্রতিটি নাগরিককেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শাসনযন্ত্রে অংশগ্রহণ করতে হবে। নগরটি হতে হবে স্বায়ত্তশাসিত।

বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের মৌলিক সাতটি উপাদান লক্ষ করা যায় -
নির্বাচিত প্রতিনিধি, প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, ইনক্লুসিভ সাফরেজ (Inclusive Suffrage), নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, বিকল্প তথ্যের অধিকার, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা।

শাসনযন্ত্রের জটিলতর আকার ধারণ করলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে সকল সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা অসুবিধা হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে অনির্বাচিত প্রতিনিধিগণ। বিভিন্ন অভিজ্ঞ কমিটি একধরনের ছদ্ম অভিভাবকত্ব (Guardianship) দেখায় যার দ্বারা নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপিয়ে দেয় না। বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত মিডিয়া কিংবা জনগোষ্ঠী নানানভাবে জনপ্রতিনিধিগণকে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এই ধরনের ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি বহুসংস্থার শাসনযন্ত্রের দ্বিতীয় রূপ। এই পর্যন্ত গণতন্ত্রের আধুনিকতম রূপ যা আমরা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখে থাকি।

প্রশ্ন হলো, এখন গণতন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে এত কথা বলছি কেন? কারণ জনগণ কোথাও গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে নিজেদের শোষিত অবস্থানকে চিনতে পারছে না। পৃথিবী জুড়ে নাগরিকদের যে অধিকার আসলে আরও একবার আমাদের পুনর্পাঠ করে নেওয়া এইসময় প্রয়োজন।

এখন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর কী অবশ্যম্ভাবী? সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক এলিটদের যে জ্ঞানের ব্যবধান রয়েছে তা কমিয়ে ক্ষমতার আরোহীরা সাধারণ জনগণের চেয়ে অধিকতর বোঝদার এমনটা নয়। আসলে তাঁরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি তথ্যভাণ্ডারে সমৃদ্ধ। তাই তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া এবং অভিভাবকদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে জনগণের উপর নির্ভরতা বাড়ানো বর্তমানে অধিক প্রয়োজন।

আমাদের দেশেও সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও ইতিহাস ও সাম্প্রতিক বাস্তব আদপে গণতন্ত্রের প্রহসন মাত্র। তাই ইতিহাস সর্বদাই নাগরিকের জীবনের প্রশ্ন তোলার হাতিয়ার হওয়া উচিত।

সারা বিশ্বে এ গণতন্ত্র, এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় বা জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ, এখানে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ রয়েছে। আর এ সুযোগ আছে বলেই জনগণের কাছে জবাবদিহিতা আছে। আর জবাবদিহিতা আছে বলেই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত আছে। এখানেই এ শাসনব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব এবং গুরুত্ব। সবশেষে বলা যায়, ভোটের মাধ্যমে মতামত প্রকাশের বা সঠিক রায় প্রদানে জনগণ ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। এখানেই গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অথবা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব, এবং গুরুত্ব। একটি মোটরগাড়ি উন্নতমানের নাও হতে পারে। তাই বলে আমরা গোরুর গাড়িকে সমর্থন করতে পারি না। কারণ, একটি অনুন্নত মানের মোটরগাড়ি একটি উন্নত মানের গোরুর গাড়ির চেয়ে উৎকৃষ্ট । তাই এই গণতান্ত্রিক যুগে, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার অগ্রগতির যুগে, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিযোগিতার যুগে আমরা অতীতের রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং সামরিক শাসনের খড়্গতলে বলি হতে পারি না।

গণতন্ত্রকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার বলে আখ্যায়িত ও প্রচার করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার হতে পারে না।

ধরুন, কোনো দেশে ১০০ জন মানুষ, আর নির্বাচনে তিনজন প্রার্থী। নির্বাচনের ফলাফলে একজন ৪০ ভোট, দ্বিতীয়জন ৩৫ ভোট, তৃতীয়জন ২৫ ভোট পেলেন। গণতন্ত্রের বিচারে ৪০ ভোট যিনি পেয়েছেন তিনি নির্বাচিত হবেন। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোথায়? ৪০-এর বিপরীতে ৬০ জনের সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য।

কাজেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বয়ং গণতন্ত্রের সংজ্ঞারই বাস্তবতা নেই। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, ওয়েস্টমিনিস্টার, জ্যাকসনিয়ান, উদারনৈতিক, ধর্মীয়, তৃণমূল, অংশীদারি, সামাজিক, ডেমার্কি বা লট্টোক্রেসি (কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও অন্টারিও প্রদেশে বিদ্যমান) বা লটারিভিত্তিক গণতন্ত্রসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায়োগিক দিক থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের ৩২টিরও বেশি প্রকারভেদ দেখা যায়।

পরিস্থিতির প্রয়োজনেই এসব প্রকারভেদের জন্মলাভ ও বিকাশ ঘটেছে। আমাদের দেশের জন্য কোন্‌ ধরনের গণতন্ত্র উপযুক্ত, সেটা বাছাই করাও কম ঝক্কির ও ঝুঁকির নয়। ৫ শতাংশ মানুষের বাংলাদেশি গণতন্ত্রকে ৯৫ শতাংশ মানুষের গণতন্ত্রে রূপদানের চেষ্টা করতেই গণতন্ত্র হত্যার অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলোঃ পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনেও গণতন্ত্রের গোলকধাঁধার নানা চমকপ্রদ তথ্যের সন্ধান মিলবে।

১৬৭টি দেশকে নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিংয়ে ২০১৬ সালে বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র চালু ছিল। ৫৭টি দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবনমন হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো আমেরিকান গণতন্ত্রের পদাবনতি হয়েছে। দেশটি ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ দেশের শ্রেণি থেকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নেমে গেছে।

অন্যান্য কারণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভাবনীয় বিজয়ের কারণে আমেরিকান গণতন্ত্রের পদাবনতি হয়েছে বলে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচকে উল্লেখ করা হয়েছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গদিনশিন এক ট্রাম্প সাহেবের তুরুপে ২৫০ বছরের পুরনো আমেরিকান গণতন্ত্র পূর্ণ গণতন্ত্র শ্রেণি থেকে এক লহমায় ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে অবনমন ঘটল। কত ঠুন্‌কো আমেরিকান গণতন্ত্র!