৫৯ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৩১ ভাদ্র, ১৪২৮
মিশন পাম তেলঃ অরণ্য বাণিজ্যিকীকরণের রোডম্যাপ
তপন মিশ্র
কালিমান্তানের বর্ষাবন।
দেশজুড়ে ভোজ্য তেলের হাহাকার। বাজারে গড় দাম কিলো প্রতি ২০০ টাকার বেশি। গত এক বছরে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৫২ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ। এই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার ১১,৪০০ কোটি টাকার মিশন পাম তেল ঘোষণা করে। National Mission on Edible Oils-Oil Palm (NMEO-OP)-এর অধীনে এই ঘোষণা। আমাদের দেশের পাম তেলের মোট চাহিদার ৬৬ শতাংশ ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া থেকে আমদানি হয়। কিন্তু দেশে সাধারণভাবে চাষ হয় যে তৈলবীজ তার চাষ উৎসাহিত করতে সরকার উৎসাহী নয়। তাহলে পাম তেলের মিশন ঘোষণার পেছনে কী অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?
পাম তেলের সরাসরি খাদ্য হিসেবে বেশি ব্যবহার উন্নয়নশীল দেশে। খাদ্যে জৈব রাসায়নিক গঠনের দিক দিয়ে আমরা মূলত দুই ধরনের ভোজ্য তেল ব্যবহার করি। (১) হাইড্রোজেনেটেড অর্থাৎ সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে (বনস্পতি তেল) এবং (২) নন-হাইড্রোজেনেটেড, সাধারণ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। পাম তেল প্রাকৃতিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড। খাদ্যে স্বাস্থ্যের কারণে হাইড্রোজেনেটেড তেলের ব্যবহার কম করা হয়। সম্ভবত একারণেই পশ্চিম দেশগুলিতে পাম তেল খাদ্যে সরাসরি কম ব্যবহৃত হয়।পাম তেল প্রকৃতির দ্বারা হাইড্রোজেনেটেড।তবে আইসক্রিম ইত্যাদি এবং সাবান, লিপস্টিকের মতো প্রসাধন সামগ্রী এবং কিছুটা জৈব জ্বালানি তৈরিতে ব্যবহার হয়। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় বনাঞ্চল ধ্বংস করে পাম তেলের চাষের প্রবণতা বাড়ছে। এরই সুযোগ তৈরি করার জন্য ‘পাম অয়েল মিশন’।
পাম তেল চাষ ছোটো বা মাঝারি কৃষকের জন্য উপযুক্ত নয়। প্রথমত, এর জন্য চাই বড়ো জমি, বেশি পুঁজি এবং চাই বেশি সময় যা সাধারণ কৃষকের পক্ষে ব্যয় করা সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে (২.৫ একর) মাত্র ১৪০ থেকে ১৪৫টি গাছ লাগানো যায়। যথেষ্ট ব্যবধান রেখে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগাতে হয় এবং গাছ লাগানোর ৩-৪ বছর পর প্রথম ফলন আসে। দ্বিতীয়ত, এই সময় জমিকে অব্যবহৃত রাখা এক সাধারণ কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে প্রথম তিন বছর, যখন পাম গাছ ছোটো থাকে, তখন কলা, ওল, আনারস ইত্যাদি ইন্টারক্রপিং করার উদাহরণ আছে। কিন্তু তারপর করা যায় না কারণ গাছের মাঝখানে সূর্যালোকের অভাব হয়। তৃতীয়ত, এই চাষ শ্রমনিবিড়।
দোআঁশ আর্দ্র, কিছুটা গভীর এবং জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ পলি মাটি এবং যেখানে জল ভালভাবে নিষ্কাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই মাটিতে পাম গাছের উৎপাদন ভালো হয়। আমাদের দেশে রেন ফরেস্ট (বর্ষা বন) অঞ্চল যেমন আন্দামান নিকোবর, পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, এবং উত্তর পুর্ব ভারতে এই বর্ষা বন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ২০০ সেন্টিমিটারের বেশি। আন্দামান-নিকোবর এবং উত্তর-পুর্ব ভারতের বনভূমি একারণেই উপযুক্ত। একারণে পৃথিবীজুড়ে বর্ষা বন পাম চাষি করপোরেটদের শিকার। সরকার এই মিশন ঘোষণা করে বলেছে যে, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় পাম তেল চাষে বাড়তি গুরুত্ব আরোপ করবে। বনভূমি কর্পোরেটদের দীর্ঘ সময়ের জন্য লিজ (lease) আকারে দিতে পারলে বেশি পরিমাণে উৎপাদন এবং লাভ সুনিশ্চিত করা যাবে।
কালিমান্তানে বর্ষাবন কেটে পামচাষ।
ইন্দোনেশিয়ার কালিমান্তান এবং রিয়াউর কথা
এক সময়ে দুর্ভেদ্য ঘন বানাঞ্চল ছিল কালিমান্তান এবং তা এশিয়ার ফুসফুস নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯০ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার ঘন জঙ্গল পুড়িয়ে এখন পাম চাষের রমরমা। পৃথিবীর যে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ পাম গাছের চাষ এবং তেল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তার মধ্যে কেবল ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়াতে ৮৫ শতাংশ তেল উৎপাদন হয়। এখানে চাষ এবং তেল প্রক্রিয়াকরণ মূলত কর্পোরেট নির্ভর। এই দুই দেশের বর্ষা বন নিশ্চিহ্ন করে ব্যাপক পাম চাষ হয় ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে। তার পরের সময়ে এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা রাশ টানা হয়। দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার আরও কিছু দেশ আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে বাকিটা উৎপাদিত হয়। প্রত্যেকটি দেশের বনভূমি একারণে বিপদের মুখে এবং অনেকাংশেই বিধ্বস্ত। বোর্নিওর এরিক মেজার্দ (Erik Meijaard)-এর নেতৃত্বে ইয়োরোপ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, আফ্রিকার কয়েকটি দেশের ৩১ জন বিজ্ঞানী একটি গবেষণাপত্র (The environmental impacts of palm oil in context, Dec. 2020, PubMed) প্রকাশ করে বলেন যে, অরণ্য ধ্বংস করে পাম তেল চাষে পরিবেশের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে চলেছে। গবেষণার কাজটি মূলত হয়েছে কালিমান্তানে। আমার এক পরিবেশকর্মী বন্ধু বললেন যে, জঙ্গল কাটলে যদি পাম গাছ লাগানো হয় তাহলে কী এমন ক্ষতি হবে? পাম গাছের কার্বন শোষণ জঙ্গল কাটার ক্ষতি পূরণ তো করবে। এই ভুল ভাঙতে আর একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা দরকার মনে করছি। জাপানের তহুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী ফতওয়া রামদানির নেতৃত্বে দীর্ঘ গবেষণার পর ২০১৩ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন (Land use changes and GHG emissions from tropical forest conversion by oil palm plantations in Riau Province, Indonesia, PubMed)। গবেষণার স্থান ছিল ইন্দোনেশিয়ার রিয়াউ প্রদেশ। স্যাটেলাইট ছবি এবং পাম চাষের জমি থেকে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল এবং ২০১২ সালের কার্বন শোষণের তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁদের গবেষণা বলছে যে, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক অরণ্য ধ্বংস করে পাম গাছ লাগানোর ফলে কার্বন শোষণ তো দূরের কথা প্রতি বছর গড়ে ২৬৬ লক্ষ টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে। ২০১২ সালের তথ্য বলছে যে, পাম চাষের জন্য বনভূমি ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণের কারণে এই পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
২০২০ সালে মালয়েশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নরমা বেসারের নেতৃত্বে ৬ জন গবেষক ‘Forests’ পত্রিকায় তাঁদের গবেষণাপত্রে (Carbon Stock and Sequestration Potential of an Agroforestry System in Sabah, Malaysia) লেখেন যে, প্রাকৃতিক অরণ্য (যে অরণ্য ধ্বংস করে পাম চাষ হচ্ছে) পাম রোপিত অঞ্চলের তুলনায় প্রতি হেক্টরে ২৮৭ টন TEC (total ecosystem carbon- টিইসি) বেশি কার্বন জমা রাখে। টিইসি হলো গাছ, আগাছা এবং মাটিতে জমে থাকা কার্বনের যোগফল। পাম গাছ হেক্টরে মাত্র ৬০-৭৬ টন টিইসি জমা রাখতে পারে।
সবুজ মরুভূমির পথে
২০০২ সালের মে মাসে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে যে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক ভিত্তিতে একক প্রজাতির রোপণ (monoculture or commercial plantations on Forest Land) নিষিদ্ধ করে বলে “There should be no expansion of monoculture or commercial plantations on Forest Land. The existing plantations of oil palm, rubber and teak are reportedly no longer viable and should be phased out.”। এখানে সেগুন, পাম এবং রাবারের রোপণ নিষিদ্ধ হয়। বিজেপি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবার এই ঘৃণ্য উদ্যোগ শুরু হয়। ২০১৮ সালে Indian Institute of Oil Palm Research (IIOPR)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় পরিকল্পনা তৈরি করতে। তারা লিটল আন্দামান, বারাটাং, কামোর্তা, কাটচাল এবং টেরেসা দ্বীপকে উপযুক্ত স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে। ২০১৯ সালে আন্দামান-নিকোবর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে এই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে একক প্রজাতির রোপণের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আবেদন করা হয়। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ৮৩.৪১ শতাংশ বনাঞ্চল এবং অধিকাংশটাই রিজার্ভ ফরেস্ট। লিটল আন্দামানের আয়তন ৭০৭ বর্গ কিলোমিটার এবং ৭০৬ বর্গ কিলোমিটার রিজার্ভ ফরেস্ট এবং এক প্রাচীন জনজাতি ওঙ্গেদের বসবাস। বারাটাং ঘন সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সংরক্ষিত উপজাতি জারোয়াদের মূল বাসভূমি। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাতচালে আদিবাসীদের ৫ টি গ্রাম আছে এবং পুরো দ্বীপটাই সংরক্ষিত বনাঞ্চল। টেরেসা দ্বীপ আদিম আদিবাসী নিকোবরি’র বসবাস ও ঘন বনাঞ্চল অধ্যুষিত। কামোর্তা দ্বীপ ভারতীয় নৌসেনার একটি বন্দর, কিন্তু ১৯৫৬ সালের ‘আন্দামান-নিকোবর প্রোটেকশন অফ ট্রাইবস রেগুলেশন’ আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত।
উত্তর-পুর্ব ভারতে বনাঞ্চল মোট ভূমির ৬৫.০৫ শতাংশ। এই পরিমাণ এমনিতেই কমছে (সূত্রঃ FSI Report 2019)। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার প্রদর্শিত পথে আমাদের দেশ চলতে শুরু করলে এর যে যে কুফল পড়বে সেগুলি সহজে অনুমেয়। প্রথমত, আন্দামান এবং উত্তর পুর্ব ভারত পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ‘বায়োডাইভারসিটি হটস্পট’। তাই জৈব বৈচিত্র্য এবং কার্বন সংরক্ষণের উপর বিরাট চাপ পড়বে। পাম চাষে সার এবং কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়। এর ফলে জলের দূষণ বৃদ্ধি পাবে। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের মধ্যে ভবিষ্যতে অজানা অতিমারীরও সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৮ সালের পর থেকে নতুন বননীতি এবং বন আইন প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অরণ্যে কর্পোরেটদের জন্য প্রোডাকশন ফরেস্ট (Production forest) আলাদা করার প্রয়াস পুরোদমে চলছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের ২৩ শতাংশ বনাঞ্চলের মধ্যে কর্পোরেটদের হস্তক্ষেপ সহজ হয়ে গেছে। ২০০৬ সালের অরণ্যবাসীদের জন্য তৈরি অরণ্য অধিকার আইন খর্ব করার সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি। আন্দামানের বারাটাং-এর জারোয়াদের আবাসস্থল যদি চুরি হয়ে যায় তাহলে মূল ভূখণ্ডের যে কোনো বনভূমি দখল করে পামচাষে ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার করা কঠিন হবে না।
বিকল্প কী হতে পারত
সরকার অয়েল-পাম মিশনের মাধ্যমে কর্পোরেট (কৃষক)-দের ১৫ হেক্টরের জন্য ৮০ লক্ষ টাকা অনুদান দেবে এবং বিশেষক্ষেত্রে এই পরিমাণ ১ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের দেশের বৈচিত্র্যপুর্ণ বাস্তুতান্ত্রিক গঠনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৮ ধরনের ভোজ্য তৈলবীজ যেমন বাদাম, রেপসিড, সরিষা, সোয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, এবং সরগুজা (নাইগর) দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষ হয়। এছাড়াও রেডি এবং তিসি চাষও হয়। এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় ৭২ শতাংশ তৈলবীজ বৃষ্টিনির্ভর চাষ। এখানে সরকার কোনো ভরতুকি দিতে প্রস্তুত নয় এবং উৎপাদিত ফসলের দাম দিতে অক্ষম। দেশের ছোটো এবং মাঝারি কৃষকদের পাশে না দাঁড়িয়ে অরণ্যভূমিতে কর্পোরেটদের অনুপ্রবেশ সরকারের দ্বারা সংঘটিত এক ঘৃণ্য অপরাধ।