৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০
একষট্টিতে দেশহিতৈষী
শংকর মুখার্জি
গত শতকের ষাটের দশকে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে কলকাতায় ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। তারিখটা ১৯৬৩ সালের ১৬ আগস্ট। এবছরের ১৬ আগস্ট ছিল সেই আত্মপ্রকাশের ৬১ বছর।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পরিচালনার লক্ষ্যে যে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম চলেছিল তারই এক সফল পরিণতি ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গড়ে ওঠা। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কলকাতায় সপ্তম কংগ্রেসে এই পার্টি গড়ে ওঠে। এক দশক ধরে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে চলা এই মতাদর্শগত সংগ্রামের এক পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার। এবং খুবই অল্প সময়েই এই সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ হাতিয়ার হয়ে ওঠে ‘দেশহিতৈষী’। ১৯৬৪ সালেই ‘দেশহিতৈষী’ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাপ্তাহিক মুখপত্রে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়েও বামপন্থী সংকীর্ণতাবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামে ‘দেশহিতৈষী’ নিরলস থেকেছে।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠামোয় একটা কমিউনিস্ট পত্রিকার নিরবচ্ছিন্নভাবে ছয় দশক ধরে প্রকাশ হয়ে-চলা নিঃসন্দেহে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এবং এই অনুশীলন এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক গৌরবজনক অধ্যায়। সপ্তম কংগ্রেসের মধ্যদিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তার এগিয়ে চলাটা ফুল-বিছানো পথে হয়নি। সারা দেশের সাথেই এরাজ্যেও পার্টিকে রাষ্ট্রশক্তির আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, জরুরি অবস্থার সময়ে স্বৈরাচারী আক্রমণ, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্র এবং একেবারে হালআমলে তৃণমূল সরকারের ফ্যাসিস্তসুলভ হামলাকে মোকাবিলা করেই পথ চলতে হয়েছে। শতসহস্র শহিদের জীবনদানের বিনিময়ে পার্টির লালঝান্ডা উড্ডীন থেকেছে। পার্টি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই ছয়দশকের সমগ্র কালপর্বটা প্রতিক্রিয়াশীলশক্তির আক্রমণের নিশানায় থেকেছে ‘দেশহিতৈষী’ও। প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই পত্রিকা দখলের উদ্দেশে ‘দেশহিতৈষী’র ১৭২নং ধর্মতলা স্ট্রিটের দপ্তরে হঠকারীরা হামলা চালায়। যারা পরে নকশাল হয়। পার্টিকর্মীরা সেই হামলার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। পরবর্তীতে জরুরি অবস্থার সময় পত্রিকায় খবর, প্রবন্ধ ছাপায় রাষ্ট্রশক্তি কাঁচি চালিয়েছে। পত্রিকা তার সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী প্রকাশ হতে পারেনি। পাতার বিভিন্ন অংশ শাদা রেখেই পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে। আর ২০১১-উত্তর সময়ে তৃণমূল শাসনে পত্রিকা প্রচারে সরাসরি আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে পার্টিকর্মীদের ওপর। ‘দেশহিতৈষী’ প্রতিক্রিয়াশীলশক্তির আক্রমণের কাছে মাথানত করেনি, আত্মসমর্পণ করেনি। হাজারো বাধা- সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়েও ‘দেশহিতৈষী’র প্রকাশ ওরা বন্ধ করে দিতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য-কর্মী আর লক্ষ-নিযুত সমর্থক বুক আগলিয়ে ‘দেশহিতৈষী’-কে রক্ষা করে চলেছে। লেনিনের কথায় - ‘‘পার্টি পত্রিকা শুধু প্রচারকের কাজ করে না, সংগঠকের ভূমিকাও পালন করে।’’ ‘দেশহিতৈষী’ও লেনিনের এই অমোঘ নির্দেশকে স্মরণে রেখেই পথ চলেছে, আগামীদিনেও চলবে। আর পার্টি সংগঠন - মতাদর্শে বলীয়ান লৌহকঠিন পার্টি সংগঠন, শ্রমিকশ্রেণির অগ্রগামী বাহিনী চোখের মণির মতো নিপীড়িত মানুষ, পার্টি এবং পার্টি পত্রিকাকে আগলে রাখবে, তা যতই হিংস্র প্রাণঘাতী আক্রমণ আসুক না কেন। এটাই কমিউনিস্ট নৈতিকতা, কমিউনিস্ট সংস্কৃতি।
এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কোনো সংবাদপত্রই শ্রেণিনিরপেক্ষ নয়। আমরাও নই। বাজারি সংবাদপত্রগুলি নিরপেক্ষতার ভান করে। ওরা আসলে পুঁজির পক্ষে। ‘দেশহিতৈষী’ শুরুর দিন থেকেই বলে এসেছেঃ আমরা শোষিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। আমরা তাঁদের দঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার কথা বলব। আমরা তাঁদের দাবিতে সোচ্চার হবো। এমনিতেই ১৯৯১ সালের পরবর্তী সময়ে দেশের সংবাদমাধ্যমের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই উদার অর্থনীতির প্রকাশ্য সমর্থক হয়ে ওঠে। এই নীতির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি সহ সাধারণ মানুষের যেকোনো আন্দোলনেই তারা ব্যারিকেডের ওপারে থেকেছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করে আন্দোলন-সংগ্রাম দমনে রাষ্ট্রশক্তির হাতকে শক্ত করেছে। তবে তখন চক্ষুলজ্জার একটা বিষয় অবশ্যই ছিল। তাই মাঝেমধ্যে তাদের বাধ্য হয়ে শাসকশ্রেণির নীতির বিরোধিতা করতে হতো।
তবে ২০১৪-উত্তর সময়ে, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আাসার-পর একটা সার্বিক গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে দেশের সংবাদমাধ্যমের। হাতেগোনা কয়েকটাকে বাদ-দিলে, সব - সবাই কেন্দ্রের ক্ষমতায় যে ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদী ও করপোরেটের রাজনৈতিক জোট হয়েছে তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন দেশের সংবাদমাধ্যম চলছে মূলত করপোরেট নিয়ন্ত্রণে। এদের অলঙ্কৃত করতে নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে - গোদি মিডিয়া। এদেরই হিন্দুত্ববাদী-করপোরেটদের ‘পবিত্র’ জোট অর্থ, প্রশাসনিক সুযোগসুবিধা দিয়ে নগ্ন পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ব্যতিক্রমী যে কয়েকটা সংবাদমাধ্যম কিংবা সাংবাদিক রয়েছেন তাঁদের ওপর চলছে সরকারি এজেন্সিগুলির আক্রমণ, প্রশাসনিক সন্ত্রাস, সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করা, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, আবার কখনও কখনও দেশদ্রোহিতার ধারাতে অভিযুক্ত করার চেষ্টা। গৌরী লঙ্কেশের মতো কয়েকজনতো হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুনই হয়ে গেলেন। আমাদের রাজ্যের ছবিটাও এর ব্যতিক্রম নয়। শাসকদলের এক সর্বব্যাপী দুর্নীতি আমাদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনকে একেবারে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে এসেছে। সেই দুর্নীতির অর্থ দিয়ে সরাসরি চেষ্টা চলছে কুৎসিতভাবে সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করার। একইসাথে দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সেই দুর্নীতির অর্থের ব্যাপক ব্যবহার করা হচ্ছে বামপন্থীদের অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে।
এসবের মোকাবিলা করেই আগামীদিনে আমাদের পথ চলতে হবে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শ, তার ভিত্তিতে দেশের পরিস্থিতি বিচার করে রচিত পার্টির রণনীতি-রণকৌশল এই লড়াইয়ে আমাদের অন্যতম হাতিয়ার। আর এই পথ চলায় লক্ষ-কোটি নিপীড়িত শোষিত মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম, তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের প্রতিমুহূর্তে প্রাণিত করবে, শিক্ষিত করে। আমরাও আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সেই লড়াইয়ের পাশে থাকব। এ আমাদের অঙ্গীকার।
‘দেশহিতৈষী’ প্রকাশের একমাস পর কলকাতা মেডিকেল কলেজের রোগশয্যা থেকে এক শুভেচ্ছাবার্তায় কাকাবাবু বলেছিলেনঃ ‘‘একটি কথা আমি শুধু বলব। ‘দেশহিতৈষী’ যেন সত্যিই মেহনতী মানুষের মুখপত্র হয় এবং ধনিক-বণিক-জমিদারি সরকারের লেজুড় না হয়, সেদিকে আপনারা সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন।’’ কাকাবাবুর নির্দেশিত সেই ‘‘সত্যিই মেহনতী মানুষের মুখপত্র’’ হওয়ার অনুশীলনে-সংগ্রামে আমরা নিয়োজিত থাকব।