E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র মৃত্যুর নৃশংস ঘটনা

পৈশাচিক বর্বরতার প্রতিবাদ সর্বস্তরে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর রহস্য মৃত্যুর ঘটনায় এই মুহূর্তে নানা প্রশ্নে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। ৯ আগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের তিন তলার বারান্দার নিচে গুরুতর জখম অবস্থায় বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের (স্নাতক)ছাত্র স্বপ্নদীপকে পাওয়া যায়। তাঁকে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। ১০ আগস্ট সকালে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় র্যাতগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। কী ভাবে বারান্দা থেকে পড়ে গেলেন ওই ছাত্র? কেনই বা তাঁর শরীরে কোনও পোশাক ছিল না? তিনি কী ধরনের র্যােগিংয়ের শিকার হয়েছিলেন? ঘটনার পর থেকে এই ধরনের নানা প্রশ্নের পাশাপাশি উঠে আসছে চরম প্রশাসনিক গাফিলতির দিকটিও। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হস্টেলে র‌াগিং’-য়ের অভিযোগ প্রবল হয়েছে। ওই নির্দিষ্ট হস্টেলে নতুন বা জুনিয়র ছাত্রদের ওপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চলে এবং তা রীতিতে পরিণত হয়েছে বলেও অভিযোগ আসছে।

স্বপ্নদীপের পরিবারের পক্ষ থেকে খুনের অভিযোগও করা হয়েছে। পরিবারের বক্তব্য, স্বপ্নদীপ ৯ আগস্ট বুধবার নাকি বারবার ফোনে বলছিল, ‘চাপে আছি বাবা, তোমরা এসে আমাকে বাঁচাও।’ বুধবার রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত বার কয়েক বাবা-মার কাছে ফোন এসেছিল স্বপ্নদীপের। স্বপ্নদীপের বাবা, মায়ের দাবি, ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত হোক।

অভিযোগ এই ঘটনাকে ‘সুযোগ’ হিসাবে ব্যবহার করে সমগ্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেই সচেতনভাবে কুকথা রটানো হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাবে দক্ষিণপন্থীদের তরফ থেকে। যাদবপুরে মুক্ত চিন্তা, গণতান্ত্রিক মতবিনিময়ের যে পরিসর রয়েছে তাকেও আক্রমণ করা হচ্ছে।

ঘটনায় খুনের মামলা দায়ের করে র‌াগিংয়ের তদন্ত চালানোর দাবি তুলেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সেলিম বলেছেন, ‘‘আমরা চাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হোক। যাতে কেউ আর র‌াগিং করার সাহস না পায়। তা সে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোক বা আইআইটি।’’

১১ আগস্ট নদীয়ার রানাঘাটে স্বপ্নদীপের বাড়িতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করেন এসএফআই রাজ্য সম্পাদক। এদিন সৃজনের সঙ্গে ছিলেন সবুজ দাস, সৌরভ দে সহ এসএফআই নেতৃবৃন্দ। সৃজন বলেন, আমাদের দাবি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা স্বপ্নদীপের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তি চাই। পরিবারের পাশে থাকবে এসএফআই। সুবিচারের দাবিতে লড়াই করব আমরা।

এই ঘটনা সম্পর্কে পার্টি নেতা ও যাদবপুরের প্রাক্তনী সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘...এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা স্বপ্নদীপের এমন মৃত্যুর ঘটনা ভাবাই যায় না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটি ছেলে এখানে পড়তে আসে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গভীরভাবে তদন্ত হ‌ওয়া উচিত।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌াগিং রোধ কমিটি আছে কি এখন? থাকলে তাদের ভুমিকা কী? ‘‘প্রকাশ্যে আসা উচিত সম্পূর্ণ বিষয়। অপরাধীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হ‌ওয়া উচিত।’’

এই প্রতিবেদন লেখার সময় স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে ৮দিন। ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে এখনও পর্যন্ত মোট ৯জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা হস্টেলের আবাসিক সৌরভ চৌধুরীকে, তার পর আরও দুই পড়ুয়া মনোতোষ ঘোষ এবং দীপশেখর দত্তকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় জম্মুর বাসিন্দা মহম্মদ আরিফ, পশ্চিম বর্ধমানের আসিফ আফজল আনসারি, উত্তর ২৪ পরগনার অঙ্কন সরকার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার অসিত সর্দার ও সুমন নস্কর এবং পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বাসিন্দা সপ্তক কামিল্যাকে। এঁদের মধ্যে অসিত, সপ্তক এবং সুমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। ধৃতদের আপাতত পুলিশি হেফাজতে থাকতে হবে। অভিযোগ, ঘটনায় তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ডবলিউটিআই বা ‘উই দ্যা ইনডিপেন্ডেন্ট’ এবং ফাকাল্টি অফ আর্টস স্টুডেন্টস বা ফ্যাস নামের দু’টি সংগঠনের সদস্যরা যুক্ত।

এই ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন এসএফআই রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য। স্বপ্নদীপ খুনের বিচার চেয়ে ১৪ আগস্ট বিকেলে যাদবপুর থানা থেকে ৮বি বাসস্ট্যান্ড অবধি মিছিল করেন এসএফআই কর্মী সমর্থকরা। সংগঠনের তরফে দাবি করা হয়েছে, স্বপ্নদীপ খুনে জড়িত প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে পুলিশকে। এর পাশাপাশি রাজ্যের সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং হস্টেলকে র‌াগিং মুক্ত করতে হবে। কলকাতা জেলার এসএফআই নেতৃত্বের পাশাপাশি সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এবং রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমানও এদিনের মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। ৮বি পৌঁছে আধঘণ্টার বেশি সময় ধরে পথ অবরোধের পরে যাদবপুর ৮বি মোড়ে বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীক উর রহমান প্রমুখ। যাদবপুরের পাশাপাশি এদিন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ইস্যুতে মিছিল করে এবং কলেজ স্ট্রিটে পথ অবরোধ করে এসএফআই।

এসএফআই’র তরফে প্রকাশিত এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে, র‌াগিং বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে লড়াই চালিয়ে এসেছে এসএফআই। স্বপ্নদীপের ঘটনায় যাতে ন্যায় বিচার হয়, তারজন্য তাঁর পরিবারের পাশে থাকবে এসএফআই। পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে স্বপ্নদীপের জন্য বিচার চেয়ে আন্দোলন করবে এসএফআই। প্রেস স্বপ্নদীপের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএফআই সংগঠনের তরফে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চিঠিতে র‌াগিং আটকানোর পাশাপাশি হস্টেল থেকে বহিরাগত এবং প্রাক্তনীদের বের করে দেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই দাবি মানেনি। তারফলেই দুষ্কৃতীদের হাতে ১৭ বছরের স্বপ্নদীপকে প্রাণ হারাতে হল।

প্রেস বিবৃতিতে এসএফআই বলেছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেল দখল করে থাকা প্রাক্তনী এবং দুষ্কৃতীরা ছাত্র সংগঠন ডিএসএফ’র সদস্য। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও ডিএসএফ’র নেতাকর্মীরা তৃণমূলের হয়ে প্রচার চালায়। এর পাশাপাশি এই ঘটনায় নাম জড়ানো ফ্যাস কিংবা ডবলিউটিআই’র সঙ্গেও তৃণমূলের ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। স্বপ্নদীপ হত্যাকাণ্ডে ধৃত সৌরভ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফআই’র হেল্প ডেস্কে হামলা চালিয়েছিল। এসএফআই আরও বলেছে, স্বপ্নদীপের মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন এড়িয়ে যেতে পারেনা। তৃণমূলের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পাসগুলির গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস করা হয়েছে। তারফলেই এই ধরণের ঘটনা ঘটার সুযোগ পেয়েছে।

প্রেস বিবৃতিতে এসএফআই দাবি জানিয়েছে, রাজ্যের বহু ক্যাম্পাসকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ এবং তাদের সহযোগীদের মদতে র‌ািগিং হয়ে চলেছে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে র‌াগিংয়ের মদতদাতার নাম এবিভিপি। রাজ্য এবং দেশের ক্যাম্পাসগুলিকে র‌াগিং মুক্ত করার লড়াই চালিয়ে যাবে এসএফআই।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা দোষী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে একটিও শব্দ খরচ না করে সিপিআই(এম)কে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মর্মান্তিক ঘটনায় প্রমাণ ছাড়াই রাজনীতির কৌশলে ব্যবহারের তীব্র বিরোধিতা করেছে এসএফআই। এসএফআই নেতৃত্ব বলেছেন দায়ী সংগঠনের সঙ্গে তৃণমূলের স্পষ্ট যোগ রয়েছে। তৃণমূলই এদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। পুলিশের পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জলপাইগুড়িতে সিপিআই(এম) জেলা পার্টি অফিসে তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের হামলা রুখলেন ছাত্রযুবরা।