E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীন ভারতের সংবিধানের মর্মবস্তু ধ্বংস করতে চায় আরএসএস

আভাস রায়চৌধুরী


ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, অঞ্চল নির্বিশেষে ভারতবর্ষের মানুষদের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এই সংগ্রামী রাজনৈতিক ঐক্যের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ১৮৫৭’র সিপাহি মহাসংগ্রাম। ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের মূল্যায়নে এটি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। তারও আগে বাংলা সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের বিক্ষোভ-বিদ্রোহের ইতিহাস রয়েছে। সাঁওতাল, মুন্ডা, সন্ন্যাসী, ফকির ইত্যাদি বিদ্রোহগুলি এবং তিতুমীরের লড়াই ছিল মূলত কোম্পানি শাসন ও মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধে গরিব ও অত্যাচারিত কৃষকদের বিদ্রোহ। আঞ্চলিক এই লড়াইয়ের পথ ধরেই সিপাহি মহাসংগ্রাম।

ভারতে উপনিবেশিক শাসন ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সিগুলিতে শাসক অনুগামী নতুন শ্রেণি গড়ে তুলেছিল। উপনিবেশিক শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে চালু হওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান অবশ্যই আধুনিক শিক্ষা। তৎকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গনে উচ্চবিত্ত ব্যতীত অন্যদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রাচীন সমাজের দিকে মুখ ফেরানোর উপাদানও যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী ছিল। প্রথমদিকে এই উপাদানটিই ছিল প্রধান। শিক্ষার অঙ্গনে উপস্থিত হওয়া তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে উপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতার মানসিকতা থেকে যে স্বদেশ চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল প্রথম দিকে তা ছিল মূলত হিন্দু পুনরুত্থানবাদের আধারে লালিত।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে গতি বৃদ্ধি পায়। জাতীয় সংগ্রামের প্রথম সর্বভারতীয় সাধারণ মঞ্চ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫)। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের ইতিহাসে নরমপন্থী এবং চরমপন্থী পথের বিতর্ক-বিরোধ সবাই জানেন। নরমপন্থীরা সাধারণভাবে বার্ষিক অধিবেশনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া জানাতেন। বিপরীতে সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতার চরমপন্থী পথ। তরুণ প্রজন্ম এবং সেই সময়ের ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষদের মধ্যে তিলক, অরবিন্দ প্রমুখের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এই আন্দোলনের মধ্যে ব্রিটিশের বিরোধিতা তীব্র ছিল। কিন্তু তা পরিচালিত হতো হিন্দু ধর্মের আচরণের উপর ভিত্তি করে। এই আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ সচেতন বা অসচেতনভাবে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের ভাবনা বহন করেছিল। ফলে এই পথের সঙ্গে অ-হিন্দু ভারতবাসীর কোনো সংযোগ ছিল না।

গান্ধীজির অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গণআন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছিল। আবার ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের প্রভাবে অন্যান্য উপনিবেশগুলির মুক্তি সংগ্রামের মতোই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও গুণগত পরিবর্তন করে। গান্ধীজির নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলনে যে ভারতীয় জনগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সিংহভাগ দরিদ্র কৃষক এবং শ্রমজীবী ও খেটেখাওয়া মানুষ। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। একই বছরে গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন। ১৯৩৬ সালে গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় কৃষক ও ছাত্র সংগঠন। সমকালীন পৃথিবীর সমাজতন্ত্রের প্রতি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মতাদর্শগতভাবে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে যথাক্রমে আমেদাবাদ ও গয়াতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্টরা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছেন। ১৯২৯ সালে জাতীয় কংগ্রেস লাহোর অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই সময়ের পৃথিবীতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়। বিপরীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও পুঁজিবাদী দুনিয়ায় নতুন করে সংকট এবং আর একটা বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের হাতে ফ্যাসিবাদের পরাজয় - এই প্রেক্ষাপটে ভারতের স্বাধীনতা লাভ। সমাজের উচ্চস্তরে থাকা মানুষদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের দাবিতে যাত্রা শুরু হলেও অনেক বাঁক-মোড়ের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্র শেষ বিচারে সাধারণ ভারতবাসীর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম। সংগ্রামের শেষ তিন দশক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সবথেকে উন্নত, আধুনিক ও প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম। এই সময়েই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ‘স্বাধীন ভারত ভাবনা’ দৃঢ় হয়েছে। এই ধারণায় বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো,সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ইত্যাদি আধুনিক, প্রগতিশীল, অগ্রগামী মতাদর্শ ও প্রত্যয়গুলি গড়ে উঠেছে। সংবিধান পরিষদে বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের যে সংবিধান আমরা গ্রহণ করেছি, তাতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও, তা শেষ তিন দশকের আধুনিক প্রগতিশীল মতাদর্শের ভিত্তিতে আধুনিক ভারত নির্মাণের একটি সৎ দলিল। এবং অবশ্যই এই নির্মাণের মেরুদণ্ড হলো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। উপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় যে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের জন্ম হয়েছিল, পৃথিবী ও ভারতের প্রগতিমুখী পরিবেশে একটা বড়ো সময় পর্যন্ত তা নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারেনি। সেই ধারাটি কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জনগণনায় হিন্দু এবং মুসলমানকে দুটি পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এই সূত্রেই একই বছরে রাজনারায়ণ বসু হিন্দু ধর্মের মানুষদের একটি ‘জাতি’ হিসেবে দাবি করেন। ধর্মের ভিত্তিতে জাতিসত্তার ধারণার এটাই হলো সূত্রপাত। ভারতে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের ধর্মের ভিত্তিতে জাতিসত্তা নির্মাণ এই ভাবনার সূত্র ধরেই। ১৯২৩ সালে সাভারকর নির্মাণ করেন ‘হিন্দুত্ব’র ধারণা। সাভারকর স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন এই হিন্দুত্বের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি হলো ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের এই মতাদর্শে ভিত্তি করেই ১৯২৫ সালে নাগপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএস’র প্রতিষ্ঠা। হিন্দুত্বের মতাদর্শের সঙ্গে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও সাংগঠনিক ধাঁচার ঐক্য গড়ে তুলে বি এস মুঞ্জে ১৯২৭ সালে আরএসএস-কে পুনর্গঠিত করে আরও জঙ্গি সংগঠনে পরিণত করেন। আরএসএস’র প্রথম প্রধান হেডগেওয়ার চেয়েছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির পুনর্জীবন। ১৯৩৮ সালে হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্প’ এবং মুসোলিনির ‘চার্টার অফ রেস’ রচনার ভিত্তিতে রচিত জাতি শ্রেষ্ঠের তত্ত্বের নির্মাণ ঘটেছিল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পরের বছরেই ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় গোলওয়ালকরের ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন’।

এখানে গোলওয়ালকর বলেছেন, “এক অর্থে আমরা হলাম ‘অনাদি’, যার কোনো শুরু নেই।... আমরাই উত্তম, আলোকিত জনসমষ্টি। আমরাই সেই জনসমষ্টি যারা প্রকৃতির সূত্র ও চৈতন্যের সূত্র আয়ত্ত করেছে। আমরা একটা মহান সভ্যতা গড়ে তুলেছি এবং গড়ে তুলেছি এক অনন্য সামাজিক শৃঙ্খলা। মানবজাতির কাছে যা উপকারী তার প্রায় সর্বাংশ আমরা বাস্তব জীবনে আনয়ন করেছি। মানবজাতির বাকিরা হলো কেবলমাত্র দু’পেয়ে এবং তাই আমাদের কোনো বিশেষাত্মক নাম দেওয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে, আমাদের জনসমষ্টিকে অন্যান্যদের থেকে পৃথক করার জন্য আমাদের ‘আলোকিত’ আর্য বলা হয় - বাকিরা হলো ম্লেচ্ছ।”

রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মতবাদে জাতি বিদ্বেষ ও ঘৃণাকে উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে হাজির করা হয়েছে। নিজেদেরকে সংগঠিত করার জন্য অপর অপর সম্প্রদায়গুলিকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। গোলওয়ালকর বলছেন, “হিন্দুস্তানে থাকবে এবং অবশ্যই থাকবে প্রাচীন হিন্দু জাতি এবং হিন্দু জাতি ছাড়া আর কেউ নয়। আর যারা এই জাতীয় অর্থাৎ হিন্দু জাতি (রেস), ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার মধ্যে পড়েন না, তারা স্বাভাবিকভাবে ‘প্রকৃত’ জাতীয় জীবনের গণ্ডির বাইরে থাকবেন।... যারা একমাত্র জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক, যারা হৃদয় থেকে হিন্দু জাতি (রেস) ও নেশনকে গরিমান্বিত করতে আকাঙ্ক্ষিত, তারা কার্যকলাপে নেমে পড়তে প্রণোদিত এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে কঠোরভাবে নিবেদিত। আর যারা আছেন তারা হয় বিশ্বাসঘাতক বা জাতীয় স্বার্থের শত্রু, অথবা সহৃদয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে, মূর্খ।...

যারা এই ধারণার আওতার বাইরে পড়েন তাদের জাতীয় জীবনে কোনো স্থান নেই। তাদের নেশনের অংশ হিসেবে গণ্য তখনই করা যাবে, যখন তারা সমস্ত পার্থক্যগুলিকে বর্জন করবেন, নেশনের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষাকে গ্রহণ করবেন এবং নেশনের জাতির (রেস) সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশে যাবেন। যতদিন তারা তাদের জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলিকে বজায় রাখবেন, তাদের শুধু বিদেশি হিসেবে গণ্য করা যাবে।” হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান আওয়াজ কিংবা জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণাকে মিলেমিশে একাকার করে দেওয়ার ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় এখানে।

এই ভ্রান্ত, জঙ্গি, যুক্তিবিনাশী রাজনৈতিক হিন্দুত্বের তত্ত্বে গড়ে উঠেছে আরএসএস। আরএসএস একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী, জঙ্গি, হিন্দু জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক ও আধা সামরিক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন। ফাসিস্তধর্মী আরএসএস’র আজকের প্রধান রাজনৈতিক মঞ্চ ভারতীয় জনতা পার্টি। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদের পরিবর্তে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করা আরএসএস’র ঘোষিত লক্ষ্য। তাই মুসলমান সহ অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ, উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও সেকুলারিজমে বিশ্বাসী আধুনিক মানুষ, বামপন্থীরা এবং বিশেষভাবে কমিউনিস্টরা আরএসএস’র চিহ্নিত শত্রু। এরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি বরং বিরোধিতা করেছে। দেশবাসীর স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গুণগত পরিবর্তনের দিনগুলিতে কিছু করে উঠতে পারেনি। তবুও সুযোগ পেলে বা সুযোগ তৈরি করে বারেবারে সাম্প্রদায়িক ছোবল মেরেছে। ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বাধা তৈরি করবার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে নীরবে জনসমাজে হিন্দু জাতীয়তাবাদের চাষ করে গেছে। আজ তারাই বিজেপি’র আবরণে ভারত রাষ্ট্র কাঠামোর শীর্ষে।

আরএসএস ভারতের সংবিধানকে মানে না। তারা চায় ভারতের বর্তমান সংবিধানের যে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতান্ত্রিক আদর্শগুলি আছে তাকে ভেঙে দিয়ে কয়েক শত বছরের পুরনো মনুস্মৃতিকে ভিত্তি করে ভারতীয় সমাজকে পিছনের দিকে ঠেলে দিতে। লোকসভায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পাবার পর আরএসএস-বিজেপি দেশের সংবিধানকে বদলে দেবার কাজে একটা দিনও নষ্ট করছে না। তারা এখন ভারত রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি অলিন্দে প্রবেশ করেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস সম্পর্কিত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং পরবর্তীতে এক-দু’জন বিচারপতির অবস্থান ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবাসীর মনে এই আশঙ্কা জোরদার করেছে। সামাজিকভাবে ও ফলিত রাজনীতিতে আরএসএস’র হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ এখন কার্যত দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বর্তমান সময়ে লুটেরা আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির সঙ্গেই আরএসএস-বিজেপি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও আদান-প্রদান। প্রতিদিনের রাজনীতি, মিডিয়া, নির্বাচনী সংগ্রাম এবং খেটে খাওয়া মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনাগুলিতে এটা স্পষ্ট। বাবরি মসজিদের ধ্বংসের সময় এদেশে নয়া উদারবাদের পথ চলা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। এখন ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি কার্যত নয়া উদারবাদের লুটেরা অর্থনীতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সংবিধানকে বদলে দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া বিপদের মাত্রাকে আরও অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। অযোধ্যা পর্বের পর এখন হিন্দুত্ববাদী শক্তির অ্যাজেন্ডা বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ। সাংবিধানিক পথে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পাওয়ার ফলে আইনি পথে সংবিধান ও আইনকে ইচ্ছেমতো বদলে দিয়ে সংবিধানের প্রাণকে ধ্বংস করে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের এই নয়া কৌশল আরএসএস প্রয়োগ করে চলেছে।

কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে নোয়াম চমস্কি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্রাজিল, ভারত, ইউনাইটেড কিংডম, মিশর, ইজরায়েল এবং হাঙ্গেরি সমন্বিত একটি নতুন ‘প্রতিক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক’-এর মাথা বলে বর্ণনা করেছেন। ওই সাক্ষাৎকারেই তিনি উল্লেখ করেছেন, মোদি ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে ট্রাম্প এবং বোলসোনারো পরাজিত হয়েছে। কিন্তু যে আন্তর্জাতিক লুটেরা পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করছে এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, তা আরও আগ্রাসী ও বেপরোয়া হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতে উত্থাপিত হিন্দুরাষ্ট্রের দাবিকে বিচার করতে হবে। এখনও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মানুষ এই দাবির সঙ্গে সহমত নয় বলেই মনে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠিতভাবে এই দাবি প্রচার করছে। শুধু তাই নয় কয়েক বছর আগে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ - ভারতের প্রাণের এই মর্মবস্তুকে হত্যা করে সমগ্র জনসমাজে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের যুক্তিবিনাশী চিন্তা ও কাজের প্রতি সম্মতি নির্মাণে আরএসএস বেপরোয়া। এদেশে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের এই প্রচেষ্টা শতাব্দী প্রাচীন। আজকের অনুকূল পরিবেশে দ্রুততার সাথে আগ্রাসীভাবে জনসম্মতি নির্মাণে তৎপর সংঘ পরিবার। একদিকে ভারত রাষ্ট্র কাঠামোর ব্যবহার, পাশাপাশি আরোপিত জনসম্মতির ভিত্তিতে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে সাংগঠনিকভাবে ওরা তৎপর। ভারতের সংবিধানের প্রতি এটা সবথেকে বড়ো হামলা।

১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার সভাপতি হিসেবে সাভারকর বিভিন্ন স্থানে ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এই বলে হিন্দুদের সতর্ক করছি, এমনকী ইংল্যান্ড যদি কখনও এ দেশ থেকে চলে যায়, তখনও মুসলমানেরা আমাদের হিন্দুরাষ্ট্র এবং একটি সাধারণ ভারতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক বলে প্রমাণিত হবে।’ সাভারকরের চিন্তায় স্বরাজের অর্থ হলো, “পৃথিবীতে ভারত নামক একটি অঞ্চলের শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়। হিন্দুদের কাছে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা তখনই উপযুক্ত বিবেচিত হবে যদি তা তাদের হিন্দুত্ব, তাদের ধর্মীয় জাতিগত (রেসিয়াল) ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নিশ্চিত করে। আমরা এমন ‘স্বরাজ্য’র জন্য সংগ্রামে নেমে পড়ব না বা প্রাণ দেব না যার বিনিময়ে আমাদের ‘সত্তা’ হিন্দুত্ব অর্জিত হয় না।” এ থেকে স্পষ্ট, কেন রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের কাছে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বিরোধিতা যারা করেন, যারা ভারতের বহুত্ববাদের পক্ষে, ভারতের সংবিধানকে রক্ষার জন্য লড়াইয়ে রয়েছেন তারা সকলেই দেশদ্রোহী। আজকের কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায় থাকা আরএসএস-বিজেপি এই কারণেই ‘ভারত ভাবনা’, ভারত রাষ্ট্র ও ভারতবাসীর পক্ষে বিপদজনক।

ভারতীয় সংবিধানের মর্মবস্তু, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করতে মোদি সরকারের উদ্যোগের শিকড়ের সন্ধান পাওয়া যায়, ১৯৬১ সালে ন্যাশানাল ইন্টিগ্রিটি কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশনে গোলওয়ালকরের পাঠানো প্রস্তাবের মধ্যে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধরনের সরকার শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদেরই জন্ম দেয় না, তা এই অনুভূতিকে পুষ্ট করে এমনভাবে যে, তা এক নেশনকে স্বীকার করতে প্রত্যাখ্যান করে। একে সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত করতে হবে, সংবিধানকে বিশুদ্ধ করতে হবে এবং এককেন্দ্রিক ধরনের সরকার স্থাপন করতে হবে। ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ আরএসএস মুখপত্র অর্গানাইজার ‘হুইদার’ শিরোনামে সম্পাদকীয় কলমে লেখে, ‘আমাদের আর জাতীয়তার ভ্রান্ত ধারণায় প্রভাবিত হওয়া চলবে না। হিন্দুস্তানে শুধু হিন্দুরাই নেশন গঠন করেছে এবং জাতীয় কাঠামোকে এই নিরাপদ ও সবল ভিত্তির উপর গঠন করতে হবে। এই সরল সত্যটাকে স্বীকার করে নিলেই অনেক মানসিক বিভ্রান্তি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের অনেক সমস্যা দূরীভূত হবে। নেশনকে শুধুমাত্র হিন্দুদের দ্বারা, হিন্দু ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মতাদর্শ ও আকাঙ্ক্ষার উপর গঠিত হতে হবে।’ এর ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় নাথুরাম গডসের হাতে শহিদ হন গান্ধীজি।

২০১৭-তে কর্নাটকের কোপ্পাল জেলায় ব্রাহ্মণ যুব পরিষদের সভায় বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘এখন ধর্মনিরপেক্ষদের এক নতুন সংস্কৃতি আমদানি হয়েছে। কেউ যদি বলে আমি মুসলমান অথবা খ্রিস্টান কিংবা আমি হিন্দু, তাহলে আমার ভালই লাগে কেননা তাদের একটা উৎস আছে। কিন্তু যে সমস্ত লোকেরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে আমি জানিনা আমি তাদের কী বলে ডাকবো। তারা হলো ঠিক সেরকম লোক যাদের বাবা-মায়ের ঠিক নেই অথবা তারা জানে না যে তাদের রক্তরেখা কী। তারা নিজেরাই নিজেদের জানেনা। তারা বাবা-মাকে জানে না, কিন্তু তারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে। কিছু লোক বলে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি উল্লিখিত আছে, আমি তাকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু অদূরেই তা পালটে যাবে। সংবিধান আগেও নানা সময় পালটেছে। আমরা এখানে আছি এবং এখানে এসেছি সংবিধান পালটে দেব বলেই। আমরা এটা পালটে দেব।’ কোন জড়তা নেই, আরএসএস-বিজেপির নেতা স্পষ্টভাবেই তাদের উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেছেন। ভারত ভাবনাকে ধ্বংস করতে মোদি সরকার এই পথেই এগিয়ে চলেছে।

ভারতের বর্তমান সংবিধানে সমস্ত ধর্ম পালনের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে। যদিও আরএসএস-বিজেপি’র শাসনকালে এই অধিকার আক্রান্ত। এমনকী আরএসএস’র জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক জমি চাষ করা তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে মানুষের এই অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। ব্রিটিশদের দেখানো মনোলিথিক হিন্দু কনসেপ্টের উপরেই সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধারণা গড়ে উঠেছে। এই রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আকর ভাবনা মনুস্মৃতি। এই রাজনৈতিক হিন্দুত্বের সঙ্গে নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে। এবং এই রাজনৈতিক হিন্দুত্ব আসলে হিন্দু পরিচয় ও হিন্দু আবেগকে ব্যবহার করে ব্রাহ্মণ্যবাদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার বেপরোয়া প্রক্রিয়া। আরএসএস’র তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্রে হিন্দু ধর্মের তথাকথিত বর্ণ ব্যবস্থার নিচের দিকে থাকা বিশেষত দলিত মানুষের কোনো স্থান নেই। অথচ সমাজে এরাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের প্রায় সকলেই খেটেখাওয়া সাধারণ পর্যায় ভুক্ত প্রান্তিক মানুষজন। মনুস্মৃতি অনুযায়ী জগতের সমৃদ্ধির জন্য ব্রহ্মা যথাক্রমে নিজের মুখ, বাহু, উরু ও পদদ্বয় থেকে সৃষ্টি করেন যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের (সূত্র ১/৩১)। শূদ্রদের জন্য একটি মাত্র পেশাই নির্দিষ্ট করেছেন ঈশ্বর, অন্য তিন বর্ণের সেবা করা, অন্যথায় কঠিন অমানবিক শাস্তির বিধান রয়েছে (সূত্র ১/৯১)। শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করা নয়, তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্রে গণতন্ত্রেরও কোনো স্থান নেই।

খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব ও সংগ্রামী ঐক্য ভেঙে ফেলা করপোরেট এবং আরএসএস-বিজেপি উভয়ের প্রয়োজন। অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজন থেকেই গড়ে উঠেছে করপোরেট হিন্দুত্ব। আজ নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রকে রক্ষার সংগ্রাম পরস্পরের পরিপূরক। সচেতন শ্রমিকশ্রেণিকেই অন্যান্য আক্রান্ত শ্রেণিগুলি এবং সাধারণ ও সকল প্রান্তিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ভারতীয় জনগণের এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে। বামপন্থীদের নিজের শ্রেণির মানুষদের মধ্যে এবং বৃহত্তর জনসমাজে গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও শ্রমিকশ্রেণির মতাদর্শের প্রচার গড়ে তুলতে হবে। ক্রমশ শ্রেণি ও গণ-আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার যে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে তাকে আরও গতিশীল ও প্রসারিত করতে হবে। ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি আশঙ্কাজনকভাবে ক্রমশ ফাসিস্ত আক্রমণের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। অথচ জনচেতনায় সচেতনতা গড়ে তোলার এখনও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আরএসএস-বিজেপি সব সময় চাইবে যাতে এই সচেতনতা গড়ে না ওঠে। উলটোদিকে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আরএসএস-বিজেপি-কে পরাস্ত ও বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভারতের বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্যই এ এক ইতিবাচক সম্ভবনা। মানুষের মধ্যেও লড়াই করার একটা মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। আরএসএস-বিজেপি-কে পরাস্ত করা বর্তমান সময়ের প্রধান কর্তব্য। পশ্চিমবাংলার অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত না করে আরএসএস-বিজেপি-কে পরাস্ত ও বিচ্ছিন্ন করার সর্বভারতীয় সংগ্রামে বাংলাকে সংযুক্ত করা যাবে না। তাই এখানে লড়াই আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।