৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০
ভারতীয় স্বাধীনতার ৭৬ বছরে আমাদের শপথ
অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করতে হবে
শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়
স্বাধীনতা দিবসের দিন বামফ্রন্টের সভায় বলছেন বিমান বসু।
ভারতের স্বাধীনতার ৭৭তম বর্ষে আমরা যখন পদার্পণ করছি তখন দেশ এক গভীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। দেশে শোনা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমাদের পার্টি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক পরিবেশকে রক্ষার জন্য বিজেপি বিরোধী সকল বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা ব্যাপক মঞ্চ গড়ার ডাক দিয়েছে। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যত গতি পাবে ততই এই মঞ্চে সকলকে সমবেত করা সম্ভব হবে। অবশ্যই তা হতে হবে একটি ন্যূনতম কর্মসূচিকে ভিত্তি করে। কমরেড জ্যোতি বসু তাঁর ‘‘যতদূর মনে পড়ে’’ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন ‘‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে বিপর্যয়কর সাম্প্রদায়িক বিষের বিরুদ্ধে লড়াই বর্তমান পরিস্থিতিতে গুরুত্ব পেয়েছে। এবং এই লড়াই করতে হবে কেবলমাত্র ব্যাপক সমাবেশ ঘটিয়ে।’’ ...এখন যা পরিস্থিতি তাতে এই সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।’’ (পৃঃ ৫৭২) ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, “Broadest possible unity of the secular democratic forces including concerned citizens, organisations and social movements should be forged to counter the activities of the Hidutva forces (Para III; Page-77)
এটা এই মুহুর্তে আমাদের আশু কাজ। সেই কাজে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু আমাদের পার্টির একটা দীর্ঘমেয়াদি কাজ হচ্ছে অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করা। এটাই হচ্ছে বর্তমানে আমাদের রাজনীতি। একে বলা হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যা অতীতে বুর্জোয়াশ্রেণি নেতৃত্ব করত। এযুগে এই নেতৃত্ব দিতে হবে শ্রমিকশ্রেণিকে। যাকে বলা হয়েছে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব - যা হবে জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামে মোর্চা।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের রয়েছে এক দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাস। এর ছিল তিনটি ধারা, প্রথম ধারাটি হলো মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন, যা একটা প্রকৃত ভাল আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল, দ্বিতীয় ধারা ছিল বিপ্লবী যুবকদের সশস্ত্র সংগ্রাম যাদের উদ্দেশ্যে কালিমা লেপন করে বলা হতো ‘সন্ত্রাসবাদী’। তাঁরা সন্ত্রাস করেছিলেন বৃটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নয়। এদের যৌবন কেটেছিল আন্দামান-সহ বিভিন্ন বন্দিশালায়। তৃতীয় ধারা ছিল শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রাম, যাদের সংগ্রামী শক্তি স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছিল। এই তিনটি ধারার মধ্যে ১৯২০ সালে তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাও ছিল। এই বিভিন্ন ধারার মধ্যে ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা কাজ করেছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছিলেন, ‘সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হলেন।’ আমাদের পার্টি কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতীয় জনগণের প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও বিপ্লবী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছে কমিউনিস্ট পার্টি।’’ ‘‘পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দাবি প্রথম তোলেন কমিউনিস্টরাই’’ ‘‘স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের পাশাপাশি একেবারে শুরু থেকেই কমিউনিস্টরা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে, কৃষকদের কৃষক সভায়, ছাত্রদের তাদের ইউনিয়নে সংগঠিত করেছিল।
তাই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তাদের নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল, যেমন পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২২) কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪), মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯), স্বাধীনতার প্রাক্কালে এবং পরে ঐতিহাসিক তেলেঙ্গানার সংগ্রাম, কাকদ্বীপের সংগ্রাম, ৪৬ সালের নৌবিদ্রোহ, তেভাগার সংগ্রাম, কেরালার পুন্নাপ্রা ভায়ালার সংগ্রাম ইত্যাদি উল্লেখ করা যেতে পারে। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রচার করা হয় যে, এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের কোনো ভূমিকা ছিল না। ইতিহাস তা বলে না। কমরেড বি টি রণদিভে ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘১৯৩৪ সালের এক পার্টি প্লেনামের একটি দলিলে উল্লেখ করা হয় ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভারতীয় সমাজের সমস্ত প্রাণবন্ত উপাদানগুলিকে ঐকবদ্ধ করে একটি মাত্র প্রবল শক্তি হিসাবে গড়ে তোলার বৈপ্লবিক কর্মসূচি একমাত্র এই কমিউনিস্ট পার্টিরই ছিল।’’ বরং বিজেপি যার রাজনৈতিক শাখা সেই আরএসএস’র স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো ভূমিকা ছিল না, তাদের নেতা সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন।
ভারতের রাজনীতির নানা বাঁক ও মোড়ে আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরে পার্টির অভ্যন্তরে কতকগুলি মূল বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন চলছিল বিতর্ক। সেগুলি হলো ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার চরিত্র, ভারতীয় রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র, ভারতে বিপ্লবের স্তর - জাতীয় গণতান্ত্রিক, জনগণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, কোন পথে বিপ্লব, চীনের পথ না রাশিয়ার পথ, কাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব, কোন শ্রেণি বিপ্লবের নেতৃত্ব করবে, তার সহযোগী কে হবে, সংসদীয় গণতন্ত্রকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে। অনেক বছর পার্টির কোনো রণনীতিগত কর্মসূচি ছিল না। মার্কসবাদ লেনিনবাদের মূল নীতিকে সামনে রেখে বিভিন্ন সময়ে যে সব পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতো, সেখানে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হতো সেটাই হতো এক একটি সময়ে কৌশলগত লাইন। ষাটের দশকে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে মতপার্থক্য দেখা দেয়, বিশেষকরে দুটি বড়ো কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়া ও চীনের পার্টির মধ্যেকার বিরোধ বিশ্বের সব দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রভাব ফেলে। ১৯৬০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত ৮১টি পার্টির যে দলিল গৃহীত হয় তাতে কিছুটা বোঝাপড়া হলেও বিরোধ থেকে যায়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি লেনিনকে নস্যাৎ করে যে ভূমিকা পালন করে তা বিতর্কের সৃষ্টি করে। তার সাথে সোভিয়েত পার্টির দ্বাবিংশ কংগ্রেসে বলা হয় সোভিয়েত রাষ্ট্র সমগ্র জনগণের রাষ্ট্র, সোভিয়েত পার্টি সমগ্র জনগণের পার্টি, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ। অপরদিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বলত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, তারা ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েতের সাথে যুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। এইসব বিষয়ে আমাদের পার্টির অভ্যন্তরেও বিতর্ক হয়েছে এবং বর্ধমানে ১৯৬৮ সালে অনুষ্ঠিত পার্টি প্লেনামে যে দলিল গৃহীত হয়েছিল যা পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে সময়োপযোগী করা হয়েছিল।
সেখানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ছিল - ভারতের স্বাধীনতার চরিত্র, ভারত রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র, বিপ্লবের স্তর জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব না জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, বিপ্লবের নেতৃত্ব, কোন শ্রেণির বিরুদ্ধে বিপ্লব, সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহার।
দীর্ঘদিন এই বিষয়গুলি নিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে মতপার্থক্য চলছিল, এই অবস্থার মধ্যেও পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহার করার পাশাপাশি আন্দোলনের ময়দানে ছিল। ১৯৫৭ সালে কেরালায় কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গড়ে ওঠে। লোকসভায় পার্টির শক্তি বাড়ে। পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশে পার্টি প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়, অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভাতেও পার্টির প্রতিনিধি জয়যুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অমৃতসরে আহূত হয় পার্টির ৫ম কংগ্রেস যা বিশেষ কংগ্রেস হিসাবে পরিগণিত হয়। ওই কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে ‘কেরালা পথ দেখাইয়াছে’ মুখবন্ধে একটা মোহ তৈরি হয়। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সম্পন্ন করার কথা বলা হয়। ১৯৫৯ সালে যখন নেহরু মন্ত্রীসভা অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে কেরালার সরকার ভেঙে দেয় তার পরে পার্টির তত্ত্বগত মাসিক পত্রিকা ‘‘New Age’’-এ কমরেড বি টি রণদিভে ‘‘Lessons of Kerala’’ শীর্ষক প্রবন্ধে পার্টির দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেন। পার্টির সাংগঠনিক কাঠামোতেও কিছু পরিবর্তন করা হয়। এগুলি পার্টির অভ্যন্তরে সংশোধনবাদের বিপদকে চিহ্নিত করল। পার্টির অভ্যন্তরে এই বিতর্ক চলতে চলতে বিজয়ওয়াদায় পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ দুটি খসড়া উত্থাপন করে। আলোচনায় পরিস্থিতি এমন জায়গায় যায় যে, পার্টি বিভাজনের সামনে দাঁড়ায়। পার্টি কংগ্রেসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক নেতা কমরেড সুসলভ উপস্থিত ছিলেন। তাঁর মধ্যস্থতায় এবং সাধারণ সম্পাদক কমরেড অজয় ঘোষের প্রচেষ্টায় বিভাজন সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও মতপার্থক্য থেকেই যায়। তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষের আকস্মিক মৃত্যু পার্টিতে সমস্যা সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত রফা হয় পার্টির সংবিধান সংশোধন করে চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হবে। কমরেড এস এ ডাঙ্গেকে চেয়ারম্যান এবং ই এম এস-কে সাধারণ সম্পাদক করে এবং পি সুন্দরাইয়া, জ্যোতি বসু ও হরকিষাণ সিং সুরজিৎকে সম্পাদকমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইতিমধ্যে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। সীমান্তবিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার প্রস্তাব যাঁরা দিলেন তাঁদের চীনপন্থী, দেশদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করে বিনা বিচারে জেলে পোরা হলো। পার্টি অফিস আক্রান্ত হলো। সমস্ত কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা ও ঘৃণা ছড়ায়। পার্টি নেতৃত্বের একটি অংশ ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। চীন যে একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ, তারা পররাষ্ট্র আক্রমণ করতে পারে না - এটা সীমান্ত বিরোধ, শান্তিপূর্ণভাবেই এর সমাধান করতে হবে - তা তাঁরা মানলেন না। পার্টির মধ্যে চলে আসা মতাদর্শগত বিতর্ক আরও তীব্র হলো এই পরিস্থিতিতে। ১৯৬২ সালের ৩ নভেম্বর যাঁরা শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পক্ষে তাঁরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত করলেন যে, এই অবস্থায় এক পার্টির মধ্যে থেকে পার্টিকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু পার্টির অভ্যন্তরে মতাদর্শের লড়াই চালিয়ে বেশিরভাগ পার্টি সভ্যকে আদর্শগতভাবে ঐক্যবদ্ধ করে নূতন পার্টি গঠনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। চীনাপন্থী, দেশদ্রোহী সংযোগে ভারত রক্ষা আইনের ৩০ ধারায় বিনা বিচারে এই সব নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কয়েকজন আত্মগোপন করে পার্টির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সময়ে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। খাদ্য ও বন্দি মুক্তির দাবিতে ‘গণদাবি আন্দোলন প্রস্তুতি কমিটি’-র নামে একটি মঞ্চ তৈরি হয়। সরকারি পার্টির নির্দেশ অমান্য করে হাজার হাজার মানুষ মনুমেন্ট ময়দানে সমবেত হন। ওই সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন কমরেড এ কে গোপালন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন যে, ‘আমি পার্টি ভাঙতে আসিনি। পার্টিকে শক্তিশালী করতে এসেছি।’ এই সব পরিস্থিতির মধ্যে নেতৃবৃন্দ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পার্টিকে আদর্শগতভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠিত করার প্রচেষ্টা আরও গতি পায়। পার্টির মধ্যে যখন বিভাজন অপরিহার্য হয়ে উঠল সেই সময়ে বিতর্কের নূতন মাত্রা যোগ হলো ব্রিটিশ আমলে সরকারের কাছে মুচলেকা দেওয়া এমন কাজের একটা চিঠি যা দিল্লির মহাফেজখানা থেকে বের হলো। দাবি উঠল তদন্ত কমিশন করা হোক এবং তদন্ত সাপেক্ষে ডাঙ্গে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। স্বাভাবিকভাবেই সিপিআই-এর তদানীন্তন নেতৃত্ব এই দাবি মানেননি। ইতিমধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ৩২ জন সদস্য সভা ত্যাগ করে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, ডাঙ্গে চক্রকে অস্বীকার করো, আমরাই প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি। তেনালিতে একটা কনভেনশন আহ্বান করা হয়। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত হয় কলকাতায় ৩১শে অক্টোবর ৭ই নভেম্বর ’৬৪ পার্টির সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। পার্টির কর্মসূচির খসড়া প্রস্তুত করে সমস্ত পার্টির মধ্যে তা সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া রাজনৈতিক সাংগঠনিক রিপোর্ট, পার্টির সংবিধান এই সব ছিল আলোচ্য বিষয়। এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল ‘‘This congress will go down in history as the congress of struggle against revisionism, as the congress which made the decision break with revisionism and class collaboration in the communist movement of our country. ’’ খসড়া কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল, ‘‘thus ended political rule of the British in India and a new class namely the Indian bourgeoisie came to power. With this the first stage of the Indian revolution. The stage of the general National United Front chiefly directed against foreign imperialist rule had come to an end.’’ পার্টির সময়োপযোগী কর্মসূচিতে বলা হয়েছে ‘‘শ্রমিক শ্রেণি কৃষক সমাজ, মধ্যবিত্ত শ্রেণিগুলি, বুদ্ধিজীবী, মহিলা, ছাত্র-যুবদের গণ অংশগ্রহণের ফলেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতীয় আন্দোলন সফল হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্ব থেকে যায় বুর্জোয়াদেরই হাতে। নতুন রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা বৃহৎ বুর্জোয়ারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মৌলকর্তব্য সম্পন্ন করতে অস্বীকার করে।’’ (৩.২) পার্টি কর্মসূচির খসড়ায় বলা হয়েছিল ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এই কথাই বলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম যদি শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত হতো তাহলে তা সম্পন্ন হতো এবং সমাজতন্ত্রের অভিমুখে যাওয়া সম্ভব হতো।
রাষ্ট্রের শ্রেণির চরিত্র ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছিল, ‘‘বর্তমান ভারত রাষ্ট্র বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে বুর্জোয়া ও জমিদারদের শ্রেণি শাসনের যন্ত্র, ধনতান্ত্রিক পথে বিকাশের লক্ষ্যে যারা ক্রমেই বেশি বেশি করে আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে।’’ (৫.১)
বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরকে ব্যাখ্যা করে ৬.২ ধারাতে বলা হয়েছে, ‘‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যের প্রতি একনিষ্ঠ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) অর্থনৈতিক বিকাশের এবং শ্রমিক শ্রেণি এবং তার রাজনৈতিক সংগঠনের রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত পরিপক্কতার মাত্রা বিবেচনা করে দৃঢ় মৈত্রীর ভিত্তিতে শ্রমিক ও কৃষকের সমস্ত প্রকৃত সামন্ততন্ত্র বিরোধী, একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির কোয়ালিশনের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকে আশু লক্ষ্য হিসাবে জনগণের সামনে উপস্থিত করছে।’’ আরও বলা হয়েছিল, ‘‘ভারতীয় বিপ্লবের অসমাপ্ত মৌল গণতান্ত্রিক কর্তব্যগুলি পালন করা এবং দেশকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে পরিচালনার পথ প্রস্তুত করার এটাই হচ্ছে একমাত্র রাস্তা।’’ তাই ‘‘বিকাশের বর্তমান স্তরে আমাদের বিপ্লবের প্রকৃতি মূলত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, সামন্ততান্ত্র বিরোধী, একচেটিয়া পুঁজির বিরোধী ও গণতান্ত্রিক।’’
এই বিপ্লবের নেতা হবে শ্রমিক শ্রেণি, তার সাথে কৃষকের দৃঢ় মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে। কৃষক বলতে খেতমজুর, গরিব চাষি, প্রান্তিক চাষি, মধ্য চাষি এবং ধনী চাষি সকলকে এই ফ্রন্টে যুক্ত করতে হবে। এটাই হবে জনগণতান্ত্রিক মোর্চার মূল শক্তি ও ভিত্তি। এর সাথে যুক্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যাদের মধ্যে আছেন মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শিক্ষক, পেশাজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এছাড়া যুক্ত হবে অবৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণি যারা সাম্রাজ্যবাদ, বৃহৎ পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রাম যত তীব্র হবে ততই এই সব অংশ জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টে যুক্ত হবে।
এই মৌল কর্তব্যকে সামনে রেখে পার্টিকে নানা ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন স্লোগানও হাজির করতে হবে। যার অন্যতম হলো সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা। আবার কর্মসূচিতে ছিল বিনম্র কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজ্যস্তরে সরকার অংশগ্রহণ পরবর্তীকালে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজ্য ও কেন্দ্রের উভয় সরকার অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কমরেড জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রশ্নে পার্টির অভ্যন্তরে যে বিতর্ক হয়েছিল সময়োপযোগী কর্মসূচি সেই বিতর্কের অবসান ঘটায়। তাই ৭.১৭ প্যারায় বলা হয়েছে, ‘‘তাই পার্টি সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজ্যগুলিতে অথবা কেন্দ্রে এই ধরনের সরকার গঠনের সুযোগ গ্রহণ করেও বর্তমান বৃহৎ বুর্জোয়ার নেতৃত্বাধীন বুর্জোয়া জমিদার রাষ্ট্র ও সরকারের অপসারণের আবশ্যকতা সম্পর্কে ব্যাপকতম জনসাধারণকে শিক্ষিত করতে থাকবে এবং এর দ্বারা গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করবে।’’
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে যে কর্তব্যগুলি নির্দিষ্ট হয়েছে তা পালন করতে চাই গণবিপ্লবী পার্টি - চাই পার্টিকে শিক্ষিত ও পুনঃশিক্ষিত করে তোলা। মতাদর্শগত-তত্ত্বগত মান পুনর্নবিকরণ এবং সাংগঠনিক শক্তি অর্জন। সকলেই জানি তত্ত্ব যতই সঠিক হোক, রাজনৈতিক লাইন যতই সঠিক হোক, সংগঠন সেই লাইনের ভাগ্য নির্ধারণ করে। একথা বুঝতে হবে যে, এই কাজে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। এতদিনের পুরাতন পার্টি, এত ত্যাগ, এত নীতিনিষ্ঠ কর্মীদল - তাসত্ত্বেও নানা কারণে আমরা ভারতীয় রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকায় আসতে পারিনি। যখনই পরিস্থিতির কোনো বাঁক ও মোড় এসেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারিনি। এসব নিয়ে আরও চর্চা প্রয়োজন। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ ‘‘অসমাপ্ত বিপ্লব, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা’’ সংকলনে লিখেছেন, ‘‘বামপন্থীরা যে দেশের রাজনীতিতে বিকল্প হিসাবে আবির্ভূত হতে পারেনি তার অন্যতম কারণ তাঁরা গান্ধী আন্দোলনের মূল ধারাটি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নে পৌঁছতে পারেনি।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘মার্কসবাদীরা জাতীয় সংগ্রামের সঙ্গে শ্রেণি সংগ্রামকে যেমন মেলাতে পারেনি, তেমনি জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে শ্রেণি সংগ্রামকেও সংযুক্ত করতে পারেনি।’’
‘‘রুশ বিপ্লবের মডেল বা চীন বিপ্লবের মডেল দিয়ে চুলচেরা তর্ক করেছে। কিন্তু ভারতীয় বিপ্লবের মডেল কী হবে তা নিয়ে মৌলিক চিন্তায় কখনও মনোনিবেশ করেনি।’’
শেষের বাক্যগুলি সঠিক নয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৭ম কংগ্রেসে যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল যা পরে সময়োপযোগী করা হয়েছিল তা রুশ বিপ্লব বা চীন বিপ্লবের শিক্ষার অন্ধ অনুকরণ নয়। ভারতীয় সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির সঠিক বিবেচনা করেই পার্টি তার রণনীতিগত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এবং তার ভিত্তিতে পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশলগত লাইন অনুসরণ করেছে।