৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০
‘‘যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে, উচ্ছ্বসিয়া উঠে...’’?
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তা’রা;’। জীবনানন্দ দাশ-এর এই পঙ্ক্তি এর আগেও বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকেই করে থাকেন। যেহেতু নিজের খামতি ঢাকতে লেখায় কবিদের টেনে আনার বদ অভ্যাস আমার আছে, তাই আমিও হয়তো করেছি। আসলে এভাবে খ্যাতনামাদের ধরে ঝুলে পড়ে লেখার ধার ও ভার যতটুকু বাড়ানো যায়। নচেৎ, ব্যস্তসমস্ত মানুষজনের কাছে হোয়াটস অ্যাপ আর সোশ্যাল মিডিয়ার বেড়া টপকে পৌঁছানো কঠিন। যেখানে সকাল থেকে রাত তথ্যের ক্লাউড বার্স্ট। তথ্যের সেই অবিরাম হড়কা বানে গুরুতর বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্তি নেই। নিট ফল শূন্য। যেখানে মাঝরাতেও ‘দেশপ্রেমী আর দেশদ্রোহীদের চিনে নেবার সহজ উপায়’ গোছের মেসেজ ঢোকে। আর ‘দেশ কে গদ্দার’ কে আর ‘কোন শালাকে গোলি’ মারতে হবে তা তো আমাদের মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরই বলে দিয়েছেন।
বাঙলা অভিধান ‘ঘৃণা’ শব্দের অর্থে জানাচ্ছে - ‘সেই মনোবৃত্তি, যা কাউকে খুব খারাপ ভেবে সর্বদা তার থেকে দূরে থাকার প্রেরণা যোগায়।’ কেমব্রিজ ডিকশনারি ‘ঘৃণাসূচক মন্তব্য’ বা ‘হেট স্পিচ’ অর্থে বলেছে - ‘জনসাধারণের বক্তৃতা, যা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা যৌন অভিমুখের মতো কিছুর বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ঘৃণা প্রকাশ করে বা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি হিংসাকে উৎসাহিত করে’। মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে হিংসা ছড়িয়েছিলেন কিনা তাঁর দল বলতে পারবে। কারণ নির্বাচন কমিশনের কাছে ওই বক্তব্যের জন্য তিনি ‘মৃদু তিরস্কৃত’ হলেও বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ বিষয়টা পরিকল্পিতই ছিল। তিনি কোন ‘সম্বন্ধী’দের দেশের ‘গদ্দার’ বলেছিলেন বা ‘তাঁদের’ উদ্দেশ্যে ‘গুলি চালাতে’ বলেছিলেন সেটা অনেকের কাছে তখনই স্পষ্ট হয়ে গেছিল। যদিও তখন আমরা সেভাবে গায়ে মাখিনি। ঠিক যেভাবে গত শতাব্দীর তিন-এর বা চারের দশকে জাতীয়তা প্রেমে ভেসে যাওয়া জার্মানির একটা বড়ো অংশের মানুষও গায়ে মাখেননি। এর পরের নিধন যজ্ঞটা ইতিহাস। এই দেশেও নিধন যজ্ঞ বড়ো কম হয়নি। কারা কারা সে সবে হাত পাকিয়ে আজ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছেন সেটাও অনেকেরই জানা। এখন অপেক্ষা, ক্রমাগত ঘৃণার চাষ আমাদের কোন ইতিহাসের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে তার জন্য।
‘ঘৃণাসূচক বক্তব্য’কে ভারতের কোনো আইনে সেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর কোনো সাধারণ আইনি সংজ্ঞাও নেই। অনেকের মতে, ‘হেট স্পিচ’কে সরাসরি কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা কঠিন। কারণ, এর সঙ্গে নাকি বাক্ স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। তাই এই জাতীয় যে কোনও প্রচেষ্টা নাগরিকদের বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারে গুরুতর হস্তক্ষেপ ঘটাতে পারে এবং যার ফলস্বরূপ এই মূল্যবান স্বাধীনতাকে দমন করতে পারে। বিষয়টা বেশ জটিল সন্দেহ নেই। তাই বাক্ স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সমাজে কতটা ঘৃণা ছড়ানো যায় তারও কোনো মানদণ্ড নেই। অতএব, ফুলে ফলে ক্রমশ হৃষ্টপুষ্ট আকার ধারণ করছে ‘হেট স্পিচ’ নামক মানবঘাতী দৈত্য।
‘রামভক্ত গোপাল’-এর কথা নিশ্চই অনেকের মনে আছে। ২০২০ সালে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি চালিয়েছিল এই ‘নাবালক’। কালো জ্যাকেট পরা যে তথাকথিত ‘নাবালক’-এর ছবি রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেছিল। নাবালক হওয়ার কারণে সেই সময় কয়েকদিন সংশোধনাগারে রেখে মুক্তি দেওয়া হয় তাকে। এরপর ২০২১ সালের জুলাই মাসে হরিয়ানার পাতৌদিতে এক মহাপঞ্চায়েতে ফের উসকানিমূলক মন্তব্য করে সেই ‘রামভক্ত’। যেখানে তার বক্তব্যের পুরোটা জুড়েই ছিল কীভাবে মুসলিমদের আক্রমণ করতে হবে এবং মুসলিম মেয়েদের অপহরণ করতে হবে। এরপর ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩এ (বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে শত্রুতা ছড়ানো) এবং ২৯৫এ (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত) ধারায় মামলা দায়ের করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ওই মাসেই হরিয়ানার গুরুগ্রামের এক আদালত রামভক্ত গোপালের জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয় এবং বিচারপতি জানান - ধর্মের ভিত্তিতে আপত্তিকর কথা বলা এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এই ধরনের মানুষরা ঘৃণা ছড়িয়ে অতিমারীর চেয়েও বেশি ক্ষতি করছে দেশের ও সমাজের। সময় এসেছে, এই ধরনের অসামাজিক উপাদান যারা ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়ায় তাদের কঠোর বার্তা দেওয়ার, যে দেশে আইনের শাসন এখনও রয়েছে। যদিও ওই বছরেরই আগস্ট মাসের ৩ তারিখ সেশন কোর্টে জামিন পেয়ে যায় ‘রামভক্ত’। ২০২০ সালেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় শাহিনবাগকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বলে তুলনা করে টুইট করেন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি বিজেপি।
এই প্রসঙ্গে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় মেরুকরণের প্রচারের অভিযোগ ওঠে। বিরোধীদের আনা অভিযোগে সেই সময় গুরুত্ব দেয়নি কেউই। যদিও ২০১৪ সালের পর থেকেই দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বাড়তে শুরু করে। ঝাঁ চকচকে ডিজিটাল প্রচারে বিরোধীদের টেক্কা দেয় বিজেপি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও যে ভোট ব্যাঙ্ককে প্রভাবিত করা যায় তা এই দেশের কিছু মানুষ বুঝতে পারেন ২০১৮ থেকে ২০২০ এই সময়কালে। অভিযোগ ছিল, দ্বিতীয়বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুককে হাতিয়ার করে বিজেপি। অধুনা মেটা, তৎকালীন ফেসবুকের প্রাক্তন কর্মী ফ্রান্সেস হাউজেন জানিয়েছিলেন, ওই সময় ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণ, ভুয়ো খবর, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে অবমাননাকর পোস্টের অসংখ্য অভিযোগ ফেসবুকের দফতরে জমা পড়ে। সংস্থার কর্মীরাই সেই অভিযোগ তুললেও পাত্তা দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও বলেছিলেন, বিজেপি’র আইটি সেল কীভাবে ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে, তা ফেসবুক জানে। কিন্তু ফেসবুক কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়নি এর বিরুদ্ধে।
‘অ্যান ইন্ডিয়ান টেস্ট ইউজার’স ডিসেন্ট ইনটু এ সি অফ পোলারাইজিং’ শীর্ষক ৪৬ পৃষ্ঠার এক রিপোর্টে সংস্থার গবেষক জানান, এই নিউজফিড দেখতে গিয়ে তিন সপ্তাহে আমি যত মৃতদেহের ছবি দেখেছি, আমার সারা জীবনে আমি তা দেখিনি। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ মুসলিমবিরোধী ভাষার প্রচার চালাচ্ছে আর সেটা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানত। ফেসবুক আর সরকারের আঁতাতের অভিযোগ কিন্তু বিরোধীরা বহুদিন ধরেই করে আসছেন। এই ঘটনার পরেই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত দাবি করা হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য জানাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে ঘৃণাসূচক মন্তব্য সংক্রান্ত সর্বাধিক ৫৯টি অভিযোগ জমা পড়েছিল ২০১৯ লোকসভা ভোটের সময়। ২০২০ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় মোট ৩৪টি এই জাতীয় ঘটনার রিপোর্ট করা হয়। ২০২১ সালে, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং পুদুচেরি বিধানসভা নির্বাচনের সময় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ঘৃণাসূচক মন্তব্যের মোট ২৯টি ঘটনা কমিশনে রিপোর্ট করা হয়েছিল। একইভাবে, গোয়া, মণিপুর, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশের ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই ধরনের মোট ৮টি ঘটনার অভিযোগ জমা পড়ে। এবার আরও কিছু অন্য ঘটনার কথা বলি।
২০২১ সালের ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর হরিদ্বারে ‘ধর্ম সংসদ’-এর আয়োজন করেছিল একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। সমাবেশ থেকে সমস্ত হিন্দু জাতিকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘সাফাই অভিযান’ শুরু করার আহ্বান জানানো হয় হিন্দু নেতৃত্বের পক্ষে। যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন একাধিক বিজেপি নেতা-নেত্রী। ধর্ম সংসদের আয়োজক ইয়াতি নরসিংহানন্দ বিশ্বজুড়ে সমস্ত জিহাদিদের হত্যা করার আহ্বান জানান। হিন্দু জাতিকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বলেন তিনি। ওই ধর্ম সংসদে ‘হিন্দু রক্ষা সেনা সংগঠনের’ সভাপতি, বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ এবং পুষ্কর সিং ধামী ঘনিষ্ঠ স্বামী প্রবোধানন্দ গিরি বলেন, এখানকার প্রত্যেক হিন্দু, রাজনীতিবিদ, পুলিশকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাফাই অভিযান শুরু করতে হবে। এক ভিডিয়োতে স্বামী ধরমরাজ মহারাজকে বলতে দেখা যায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন সংসদে বলেছিলেন জাতীয় সম্পদের ওপর সংখ্যালঘুদের প্রথম অধিকার, আমি যদি তখন সেখানে উপস্থিত থাকতাম তাঁকে গুলি করে হত্যা করতাম। রিভলবারের ছ’টা গুলিই তাঁর বুকে ঢুকিয়ে দিতাম। আমাদের প্রত্যেকের নাথুরাম গডসে হওয়া উচিত।’’
প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলেও দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে সমালোচনা ধেয়ে আসার পর ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি মামলা দায়ের করা হয় ইয়াতি নরসিংহানন্দ, সাগর সিন্ধু মহারাজ, সাধ্বী অন্নপূর্ণা, ধরম দাস এবং জিতেন্দ্র ত্যাগীর নামে। এই ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতার প্রতিবাদে চিঠি লেখে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এর ছাত্র এবং ফ্যাকাল্টি পরিষদের ১৮৩ জন সদস্য। যে চিঠিতে লেখা হয়েছিল, ‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার নীরবতা এই ঘৃণা-ভরা কণ্ঠগুলিকে আরও উৎসাহিত করছে এবং আমাদের দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি, আমাদের বিভক্ত করতে চায় এমন শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ান।’’
২০২২ সালেরই ৩১ মে এক রিপোর্টে ফেসবুক জানায়, এপ্রিল মাসে ফেসবুকে ঘৃণাসূচক মন্তব্য বেড়েছে ৩৮ শতাংশ, আর ইন্সটাগ্রামে বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে ফেসবুকে ২০২২-এর মার্চ মাসে যা ছিল ৩৮,৬০০ তা এপ্রিল মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ৫৩,২০০। ইন্সটাগ্রামে মার্চ মাসে এই ধরনের পোস্ট হয়েছিল ৪১,৩০০ আর এপ্রিল মাসে তা হয় ৭৭ হাজারের বেশি। উল্লেখযোগ্যভাবে, বছর পাঁচেক আগে মাইক্রোসফট এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, ২০১৬ সাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণাসূচক পোস্ট বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
হেট স্পিচ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট এক মামলার পর্যবেক্ষণে জানায় - ‘‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘বিদ্বেষ মূলক’ বক্তৃতাগুলি অনিয়ন্ত্রিত। কেউ যাতে ঘৃণাত্মক বক্তব্য রাখতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব অ্যাঙ্করদের। আলোচনার ক্ষেত্রে কোথায় থামতে হবে, থামাতে হবে তা জানা উচিত সকলের।’’
এই বছরেরই অক্টোবর মাসে ঘৃণাসূচক মন্তব্য প্রসঙ্গে এক জনস্বার্থ মামলায় শীর্ষ আদালত জানায়, দেশে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ক্রমশ বাড়ছে। সুস্থ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। মামলাকারী হরপ্রীত মনসুখানি আদালতে জানিয়েছিলেন, ‘সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে। আর এই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোট জিততে, সমস্ত পদে ক্ষমতা দখল করতে, গণহত্যা সংগঠিত করতে এবং ২০২৪ সালের আগে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার জন্য।’
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে এক মামলায় বিচারপতি কে. এম. জোসেফ এবং বিচারপতি বি. ভি. নাগরত্নের বেঞ্চ জানায়, টিভি চ্যানেলে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেশের পক্ষে বিরাট বিপদ। এখনই এটি বন্ধ করা দরকার। টিভি সঞ্চালকের চেয়ারে বসে যদি কেউ বিদ্বেষ ও ঘৃণা ভাষণ দেওয়ার পথে হাঁটেন, তাহলে তাঁকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। দরকারে তাঁর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত আর্থিক জরিমানাও করতে হবে বলে জানায় শীর্ষ আদালত।
গত ৮ আগস্ট শীর্ষ আদালতে এই প্রসঙ্গিত এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে জানা গেছে ২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট ঘৃণাসূচক মন্তব্য প্রসঙ্গে কড়া অবস্থান নিলেও মাঝের ৭ দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ২৭টি ঘৃণাসূচক মন্তব্য করার ঘটনা ঘটেছে। যে তিন রাজ্যের কথা এখানে উঠে এসেছে তার মধ্যে আছে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের নাম।
বিগত কয়েক বছরে দেশে যত ঘৃণাসূচক মন্তব্য করা হয়েছে তার বেশিরভাগই এসেছে বিজেপি, ভিএইচপি, বজরং দল জাতীয় সংগঠনের নেতা কর্মীদের মুখ থেকে। সেখানে সাংসদ, মন্ত্রী, বিধায়ক থেকে ছোটো নেতা - বাদ নেই কেউই। হরিয়ানায় কয়েকদিন আগেই এক সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো ভিডিয়ো ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল, তারাও নাকি বজরং দল সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। যদিও এক অভিযুক্ত বাবু বজরঙ্গীর গ্রেপ্তারের পর বজরং দল জানিয়েছে তাদের সঙ্গে ওই সংগঠনের কোনো যোগ নেই।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে, উচ্ছ্বসিয়া উঠে...’’। হেট স্পিচের রমরমার দিনে এই বাক্যবন্ধকে ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ‘এরা’ ‘কারা’ যাদের মুখ দিয়ে শুধু ঘৃণাই নিঃসরিত হয়। এই প্রেম প্রীতিহীন মানুষগুলোর গ্রাসেই আজ আক্রমণ মস্তিষ্কে, আঘাত শুভবুদ্ধিতে। এদের চিহ্নিতকরণই বোধহয় এই সময়ের প্রথম ও জরুরি কাজ।