৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০
স্মার্ট মিটারিং ও বহুরূপী
প্রশান্ত নন্দী চৌধুরী
আমাদের বাড়ির আশে পাশে ঝোপে জঙ্গলে একটি সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী চোখে পড়ে - যে প্রাণীটি ঘন ঘন রঙ বদল করতে পারে। এই ক্ষমতা প্রাণীটি প্রয়োগ করে আত্মরক্ষার তাগিদে। কিন্তু আমাদের রাজ্যে একজন বহুরূপী আছেন যিনি ভোল পালটে ফেলার ক্ষমতা প্রয়োগ করেন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে।
আমাদের রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কথার ছলে ভুলিয়ে রেখে এতদিন তিনি তাঁদের পকেট কেটেছেন তা ধরা পড়েনি। এখন পর্দা ফাঁস হয়ে গেছে।
২০০০ সাল থেকে অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজত্বে এনডিএ সরকার দেশের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সংস্কারের জন্য বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩ পাশ করিয়েছিল, তখন আমাদের রাজ্যের বহুরূপী ওই সময়ে কেন্দ্রের মন্ত্রী। ২০০৪ সালে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ সংখ্যায় (৬১ জন) বামপন্থী সাংসদ নির্বাচিত করলেন। যাদের সমর্থন ছাড়া ইউপিএ-১ সরকার ক্ষমতাসীন হতে পারত না। ওই সময়ে বামপন্থীদের চাপে ২০০৩-এর বিদ্যুৎ আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধিত হয়। রাজীব গান্ধী গ্রামীণ বৈদ্যুতিকীকরণ যোজনা প্রণয়ন করে দেশের সর্বাধিক সংখ্যক গ্রাম বৈদ্যুতিকীকরণ করা হয়। গরিব মানুষের সাধ্যের মধ্যে বিদ্যুৎ মাশুল রাখার জন্য বিদ্যুৎ আইনের সংশোধন করা হয়। সোজা কথায় বলতে গেলে বলতে হবে - এখনও যে গরিব মানুষ, গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারেন - তার জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওই ৬১ জন বাম সাংসদের।
২০১৪ সালে আবার এনডিএ ক্ষমতাধীন হয় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে। শুরু হয় বিদ্যুৎ আইনের পরিবর্তনের নতুন উদ্যোগ। ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সংসদে পেশ হয় বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল- ২০১৪ - যা পাঁচ বছরের চেষ্টায় নানা সংশোধনের পরেও পাশ করাতে পারেনি। তথ্যের অধিকার আইন অনু্যায়ী কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ দপ্তরের নিকট প্রশ্ন করা হয়েছিল ২০০৩-এর আইনের সংশোধনী প্রয়োজন এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য গত ১৫ বছরের মধ্যে কোনো সমীক্ষা, বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল কিনা - উত্তর আসে, না - সেরকম কিছুই করা হয়নি। তাহলে বিদ্যুৎ আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন এটা কীভাবে ঠিক হলো? সরকার নিরুত্তর।
মোদি সরকারের নিকট থেকে জবাব না পেলেও আমরা জানি তাগিদ কোথায়? যারা পিএম কেয়ার ফান্ড আর ইলেকশন বন্ডের নামে বিজেপি তহবিলে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেয় তাদের চাপ ছিল বিদ্যুৎ আইনের পরিবর্তন করার জন্য।
দেশের মানুষের মধ্যে বিশেষত, বিদ্যুৎ শিল্পের কর্মী-ইঞ্জিনিয়ারদের এবং কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিত্বকারী সংযুক্ত কিষান মোর্চার ধারাবাহিক আন্দোলনের সাথে সংসদের মধ্যে বিরোধীদের চাপে আইন পাশ করাতে ব্যর্থ মোদি সরকার নতুন কৌশল নেয়। কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলির বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্পদগুলি নিলাম ডেকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করে। দাদরা-নগর হাভেলিতে কর্মী-ইঞ্জিনিয়ারদের সচেতন আন্দোলন না থাকায় সেটা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপরে জম্মু-কাশ্মীর, চণ্ডীগড়, পণ্ডিচেরীতে সম্মিলিত বাধায় সেটা করে উঠতে পারেনি।
এর পরের ধাপ হচ্ছে, রাজ্যগুলির জন্য নিলাম ডেকে বিদ্যুৎ বিতরণ পরিষেবার সম্পদ বেচে দেবার জন্য নিলাম ডাকার দরপত্রের খসড়া করে রাজ্যে রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বিষয়টা এমন রাজ্যের সম্পত্তি রাজ্য বেচবে কিনা সিদ্ধান্ত নেয়নি। দালালি খাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আগবাড়িয়ে টেন্ডারের খসড়া পাঠাচ্ছে। মজার কথা হলো, এই যে তাবড় তাবড় আরএসএস তথা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও কিন্তু ওই খসড়া অনুযায়ী টেন্ডার ডেকে বিতরণ কোম্পানির সম্পত্তিগুলি বেচে দেয়নি।
ওইসব পন্থাগুলি ডাহা ফেল করার পরে নতুন কৌশল হলো আরডিএসএস অর্থাৎ বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষেত্রের পুনরুজ্জীবনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ১৫ শতাংশ অনুদান পেতে হলে রাজ্যকে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের মিটারগুলি পালটে দিতে হবে। যে মিটারগুলি হবে প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার। মোবাইল ফোনের মতো আগে টাকা ভরে পরে ব্যবহার করতে হবে। বর্তমান সাধারণ মিটারগুলির দাম ৬০০-৭০০ টাকা, যা চলে ১৫-২০ বছর বা তার বেশি, পরিবর্তিত স্মার্ট মিটারগুলির দাম হবে ৭০০০-৮০০০ টাকা, চলবে ৭-৮ বছর। এই মিটার পালটানোর দাম বহন করতে হবে গ্রাহককে। যেহেতু ৭/৮ বছরের জন্য ৭/৮ হাজার টাকা দাম দিতে হবে, তার অর্থ বছরে এক হাজার টাকা। মাসে আশি থেকে একশো টাকা আপনার বিদ্যুৎ মাশুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। কেরালার বাম গণতান্ত্রিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছে - যারা কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন সেই সব গ্রাহকের জন্য এই দামি মিটার ব্যবহার করে গ্রাহকদের উপর বাড়তি মাশুলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে না।
এবার দেখা যাক এই মিটার পালটানোর প্রয়োজন হলো কেন? বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা আইন করে প্রাইভেট করে দেওয়া বিলম্বিত হচ্ছে। মানে গত ৯ বছরে হয়নি। তাই এই ভিন্ন পন্থা। পুরনো মিটারগুলিতে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী মাশুলের তারতম্য ঘটিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার রেকর্ড করা যায় না। পুরনো বিদ্যুৎ আইনে বিদ্যুৎ ছিল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপাদান। বর্তমান আইনে বিদ্যুৎ হয়েছে বাজারি পণ্য। দিনের বিভিন্ন সময়ে চাহিদা কমে বাড়ে। তাই বাড়তি চাহিদার সময়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বেচার জন্য একটি আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত নিলাম ডাকার মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছে। যার নাম ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জ। খুব নিখুঁতভাবে বললে বলতে হবে বিদ্যুতের ফাটকা বাজার। এই শতাব্দীর গোড়ায় বিদ্যুৎ শিল্পে একটা নতুন শব্দবন্ধের সৃষ্টি হয়েছিল। যার নাম ক্যালিফোর্নিয়া ক্রাইসিস। শীতের দেশে প্রচণ্ড শীতে ঘর গরম করার জন্য হিটার চালাতে হলে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। ওই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলি বেশি দর হেঁকে বললো - এই দাম না দিলে আমার প্ল্যান্ট আমি চালাব না। পুঁজি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সংকট তহবিল থেকে টাকা দিয়ে শীতের প্রথম ২/১ সপ্তাহ চালানো হলে সরকারের ওই তহবিল শেষ হয়ে গেল - তখন রাতের পর রাত মানুষকে হিটার ছাড়া ঠান্ডা ভোগ করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে ‘‘আচ্ছে দিন’’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে - তারা তো আপনাকে বলেনি ‘‘আচ্ছে দিন’’ তো আসবে, সেটা কার ‘‘আচ্ছে দিন’’ হবে। যাদের ‘‘আচ্ছে দিন’’-এর কথা বলা হয়েছিল - তারা একবার আচ্ছে দিনের দেখা পেয়েছে - ২০২২ সালের গ্রীষ্মের গোড়ায়। আদানির আমদানি করা কয়লা ওয়াগনের সংকটে কোল ইন্ডিয়ার খনি মুখে লক্ষ লক্ষ টন উত্তোলিত কয়লা থাকা সত্ত্বেও তিন টাকার বিদ্যুৎ ২২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। তাদের এখন বায়নাক্কা ছিল ঊর্ধ্বসীমা ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। যদিও নাকি খুব কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা ৫০ টাকা করা হয়েছে। উল্লম্ফনগুলি লক্ষ করা যাক। ১২ টাকা থেকে ২২ টাকা, তারপর ৫০ টাকা। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারব ‘‘আচ্ছে দিন’’ কাদের এসেছে।
এই স্মার্ট মিটার বসবে দেশের ২৬ কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহকের জন্য - ৩১ মার্চ, ২০২৫-এর মধ্যে।
সৌরবিদ্যুৎ সংস্থাপন যখন দুর্মূল্য ছিল, তখন তার দায় ছিল সরকারের। সরকারি উদ্যোগে প্রকল্প গড়ে মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল প্রত্যন্ত গ্রামে, পাহাড়ে, দ্বীপে। এখন সৌর বিদ্যুতের বাজার তৈরি হয়েছে - ব্যবসা লাভজনক। তাই ওটা একশো শতাংশ প্রাইভেট প্রকল্প। তেমনি স্মার্ট মিটারগুলিও কিনতে হবে প্রাইভেট কোম্পানিগুলি থেকে। এমন স্কিম করা হয়েছে যে, টাকা জমা নেবার দায়িত্বও পাবে ওই মিটার সংস্থাপনকারী কোম্পানিগুলি। ওই মিটারগুলির মাধ্যমে বিদ্যুতের চাহিদা, সরবরাহ, আমদানি, রপ্তানি সব তথ্য থাকবে ওই কোম্পানির হাতে। সম্পত্তি সরকারের, গ্রাহক জনগণ - চাবিকাঠি থাকবে আদানিদের হাতে। দেশের ১৪টি রাজ্য যখন বিদ্যুৎ বিল ২০২০-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার, তখন আমাদের রাজ্যের বহুরূপী চিঠি লিখে প্রতিবাদ করলেন। এখন কেন্দ্রীয় সরকার জোর করে স্মার্ট মিটারিং চালু করে গ্রাহকের বিদ্যুৎ মহার্ঘ্য করে তুলেছে - তখন উনি চুপ কেন? কেন বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমে যাওয়ার জন্য মাশুল না কমিয়ে ১ এপ্রিল থেকে এক লাফে অনেক মাশুল বাড়িয়ে দেওয়া হলো? এই প্রশ্ন রাজ্যের মানুষের, বহুরূপী চুপ কেন?